প্রাচীন ভারতের ন্যায়দর্শনে ‘নিগ্রহস্থান’ বলে একটি শব্দ আছে। এখানে ‘নিগ্রহ’ মানে দৈহিক বা মানসিক নিগ্রহ বা নির্যাতন বোঝানো হচ্ছে না। অত্যাচারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। দুজন নৈয়ায়িক তর্ক করছেন নিজেদের প্রমাণ করতে। নৈয়ায়িকের একজন যে যুক্তি দিয়ে অন্যজনের যুক্তিদোষ নির্ণয় করেন, সেটাই নিগ্রহস্থান। এখানে ‘নিগ্রহ’ শব্দের অর্থ পরাজয়, অন্যভাবে বললে যুক্তি দ্বারা খারিজ করা। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনপূর্ব যে যুক্তি-প্রতিযুক্তির লড়াই চলে, তা বিশ্ববাসীর তুমুল আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে। একে অপরের ‘নিগ্রহস্থান’ খুঁজে পরাস্ত করাই উদ্দেশ্য। আমাদের সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে এমন নৈয়ায়িক নিগ্রহস্থান খোঁজার ইতিহাস সাধারণ পাঠকের কাছে খুব আগ্রহের নয় হয়তো, কিন্তু সংবিধান-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো নবীন ন্যায়যোদ্ধা মাঝেমধ্যেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে নানা ছুতোয় সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে চাইলে প্রত্যুত্তরে প্রাজ্ঞ পক্বকেশধারী সদস্যরা পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নসংক্রান্ত জটিলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। দীর্ঘসূত্রতা ছিল পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংস্কৃতির এক অনপনেয় কলঙ্ক। কোনটি বেশি প্রয়োজন—খসড়া কমিটির প্রস্তাব, নাকি পুরো পরিষদের অংশগ্রহণ, এ প্রশ্নে স্থিতপ্রজ্ঞ দার্শনিকের দৃঢ়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু নির্মোহভাবে খসড়া কমিটির কাজ এগিয়ে নিতে প্রণোদিত করেন। নবীন-প্রবীণের এই অহেতুক দ্বৈরথে অভীষ্ট দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বেশ প্রজ্ঞা নিয়ে মোকাবিলা করা হয়।
নিবন্ধকারের যোগ্যতার সংশয়াতীত সীমাবদ্ধতাও বইটি পাঠপরবর্তী প্রতিক্রিয়া প্রকাশ প্রশমিত করতে পারেনি। আমাদের সংবিধান মুসাবিদার যে পদ্ধতি, ইতিহাস, গঠনমূলক তর্কবিতর্ক গণপরিষদে, সে বিষয়ে আলোচনা নিদারুণভাবে কম। আমাদের এ উপমহাদেশেই এ-সংক্রান্ত চর্চার অভাব রয়েছে। পশ্চিমের সংবিধানবিষয়ক তাত্ত্বিক গ্রানভিল অস্টিনই হলেন অন্যতম পুরোধা বিশেষজ্ঞ, যিনি একটা আকরস্থানীয় গবেষণা ভারতীয়দের উপহার দিয়েছিলেন। ‘ওয়ার্কিং আ ডেমোক্রেটিক কনস্টিটিউশন: আ হিস্ট্রি অব দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স’ বইতে, যেটিও করতে পার হয়েছিল পাঁচ দশক। আমাদের সংবিধান নিয়ে এ ধরনের কাজের খুব যে ছিল, তা বলা যাবে না। আইনের শিক্ষক আসিফ নজরুল ‘সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২: গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা’ নামের প্রথমা প্রকাশনের যে বই নিয়ে এসেছেন, তা ধন্যবাদ দাবি করে।
বর্তমান সাক্ষ্য বা লেখ্যপত্রের ভিত্তিতে অতীত কেমন ছিল, সে ‘রেট্রোডিকশন’ বিষয়টি ইতিহাসচর্চায় বেশ প্রচলিত। আমাদের সংবিধানচর্চার সঙ্গে এর যোগ অনুপস্থিত। সংবিধান রচনাকালে গণপরিষদে এবং এর বাইরে দেশ-সমাজে সংবিধান বিষয়ে যে আলোচনা চলছিল সভায় বা পত্রিকার পাতায় পাতায়, তার পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে লেখক গণপরিষদ সদস্যরা ঠিক কী ধরনের রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, তা একালের পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন ‘রেট্রোডিকশন’-এর মধ্য দিয়ে। যেসব সাংবিধানিক পরিবর্তন নিয়ে এখন আলোচনা হয়, ৫০ বছর আগে গণপরিষদেও তা আলোচনার বিষয় হয়েছিল। যেমন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ইত্যাদি। সমকালের মতো দ্বন্দ্বরক্তিম হয়েছিলেন তাঁরাও।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর প্রধান কাজ ছিল স্বাধীন দেশের জন্য একটি আধুনিক ও মানবিক সংবিধান রচনা করা। গণপরিষদ সংবিধান রচনা করেছিল, যদিও গণপরিষদের বৈধতা এর সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা আছে কি না, এসব প্রশ্নও উঠেছিল, এ বইয়ে এসবের উত্তর দেওয়া আছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে রিপোর্টসহ গণপরিষদে উপস্থাপন করে। সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবনার বিভিন্ন বিধান নিয়ে গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়। এ বিতর্কের কার্যবিবরণী দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়া ‘কনস্টিটিউশনাল জুরিসপ্রুডেন্স’-এর ইতিহাসে দারুণ এক সংযোজন।
একটি জাতির নৈতিক জীবনের জন্য একটি টেকসই ভিত অন্বেষণের ইচ্ছা, জাতিসত্তার বিকাশের পথ ও সামাজিক সম্পর্কের সূত্র সন্ধান এবং তার সাংবিধানিক যথার্থতা পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা থেকে আমরা সংবিধান নিয়ে চিন্তা করতে আগ্রহী হই। এ চিন্তাই নতুন নির্মাণের পথনির্দেশক। বইটি সে ধারার একটি কাজ।
গণনাতীতবার সংবিধানের রেফারেন্স দিয়ে থাকেন আমাদের রাজনৈতিক দলের মুখপাত্ররা। কেবল তাঁরাই নন, এমনকি অন্য সাধারণ নেতারাও। এতে জাতি হিসেবে আমাদের সংবিধাননিষ্ঠতার দিকে ইঙ্গিত করে। আসলে কি তা-ই? গণপরিষদ বিতর্ক নিয়ে গ্রান্ড ন্যারেটিভের চর্চা ও এই ধারার গবেষণা নিদারুণভাবে কম। সাংবিধানিক ব্যবহারিক ইতিহাসের দিক থেকে এর প্রায়োগিক মূল্য অনিঃশেষ। বিদ্যায়তনিক ধারার কিছু বই থাকলেও ব্যবহারজীবীদের অবদান নেই প্রায়।
প্রতিটি প্রজন্মকেই তার বুদ্ধিবৃত্তিক দায় থেকে ইতিহাসকে পুনঃপরীক্ষা করতে হয়। নতুন করে তাকাতে হয় ঘটে যাওয়া ঘটনার দিকে, চিন্তা ও আলোচনা করতে হয় বারবার। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাস খুঁড়ে তার চর্চা ইতিহাসের জন্য দরকার।
মাথায় ঘোরে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন:
‘...ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি
ভেদ ক’রে শোনা যায় শুশ্রূষার মতো শত-শত
শত জলঝর্ণার ধ্বনি...’
তার্কিক শেখ মুজিব-তাজউদ্দীনের বিতর্কগুলো তো শত শত জলঝরনাই!
গণপরিষদের বিতর্ক সংবিধান গভীর ভাবের জানার সোপান। গণপরিষদ বিতর্কগুলো আদতে রাষ্ট্রসাধনার এক ঐতিহাসিক আকর, যা থেকে উৎসারিত চিন্তারাজি প্রাণিত করতে পারে আমাদের এ ভাবনা-কারবালা।
আসিফ নজরুল গবেষকের নির্লিপ্ততা নিয়ে সক্রিয় আছেন ক্লাসরুমে, সেমিনারে, আলোচনাচক্রে, অভিসন্দর্ভের পাতায়। তাঁর একাডেমিক অ্যাকটিভিস্ট মানস অন্য প্রিজমে দেখতে প্রণোদিত করেছে গণপরিষদ বিতর্ককে। মনে রাখা দরকার, এককালের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা তাঁর উপস্থাপনায় এনেছে সহজিয়া ভাব, যার অভাবে সংবিধানসংক্রান্ত সব চর্চা এখনো একাডেমিয়ায় ও সেমিনারের গণ্ডিতে সীমিত, এমনকি এর প্র্যাকটিক্যাল ইউটিলিটি থাকা সত্ত্বেও।
হোয়াট ইজ হিস্ট্রি বইটি ই এইচ কারের অনবদ্য এক বই। তিনি বলছেন, প্রত্যেক ঐতিহাসিকই একটা বিশেষ সময়ের কোনো বিশেষ শ্রেণির লোক এবং তার সহজাত রুচিপ্রবণতা আর অর্জিত সংস্কার তার ধারণা ও ব্যাখ্যাকে প্রভাবিত করবেই। এ ধরনের কাজের জন্য অনতি-অতীত পার হওয়াটা দরকার, সে বিবেচনায় সংবিধানের পঞ্চাশ বছর পার হওয়ার পর একে সময়োপযোগী বলা যায়।
এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট