গত ৩০ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের ২০২৪ সালের বাজেট পেশ করেছেন দেশটির ইতিহাসের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী রেচেল রিভস। জুলাই মাসে ক্ষমতায় আসার ফলে প্রায় দেড় দশক পর ব্রিটেনে লেবার পার্টি দেশের বাজেট পেশ করার সুযোগ পেল।
সুতরাং বর্তমান বাজেটের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটিকে বেশ কিছুটা ঐতিহাসিকই বলা চলে। তাঁর বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী রিভস বলেছেন, গত নির্বাচনে জনতা পরিবর্তনের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। তাই বলা যায়, জাতীয় পরিবর্তনের জন্য লেবার পার্টি একটি আজ্ঞানামা আছে।
জনগণের থলেতে অধিকতর অর্থ লভ্য করে দেওয়া এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের অঙ্গীকার করেছেন রেচেল রিভস। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অর্থনৈতিক স্থিরতার, উচ্চতর প্রবৃদ্ধির। সেই সঙ্গে বলছেন, এ সব অর্জনের জন্য মূল কথা হচ্ছে ‘বিনিয়োগ’, ‘বিনিয়োগ’ ও ‘বিনিয়োগ’।
সামনের দিনগুলোতে অর্থমন্ত্রীকে বাজেটটিকে এমনভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে, যাতে মানুষের মনে হয়, উন্নততর সামাজিক সেবা পেয়ে তাঁদের যাপিত জীবন আরও ভালো হয়েছে এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
অর্থনৈতিক বিষয়ে কতগুলো প্রক্ষেপণের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের বাজেটটি পেশ করা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, আগামী তিন বছরে ব্রিটিশ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ খেকে ২ শতাংশের মধ্যে থাকবে।
একই সময়কালে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৩ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করবে। ২০২৪ সালের বাজেটে ঘোষিত হয়েছে যে দৈনন্দিন ব্যয়ভারের জন্য সরকার কোনো ঋণ গ্রহণ করবে না এবং তিন বছরের মধ্যেই বাজেট ভারসাম্য অর্জিত হবে।
২০২৬ সালে ২৬ বিলিয়ন পাউন্ডের বাজেট ঘাটতি হবে, যা কি না ২০২৮ সাল নাগাদ ১১ বিলিয়ন পাউন্ডের উদ্বৃত্তে পরিণত হবে। ২০২৪ সালের ১২৭ বিলিয়নের সরকারি নিট ঋণ ২০২৯ সাল নাগাদ ৭০ বিলিয়ন পাউন্ডে নেমে আসবে।
সত্যিকার অর্থে, ২০২৪ ব্রিটিশ বাজেটের সফলতা দুটো বিষয়ের ওপরে নির্ভর করবে। এক. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে কি না এবং দুই. দেশের মূল্যস্ফীতি নিচুস্তরে বেঁধে রাখা হবে।
২০২৪ সালের যুক্তরাজ্যের বাজেটের লক্ষ্য হচ্ছে, অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সরকারি আয়-ব্যয়ে ২২ বিলিয়ন পাউন্ডের যে ফোকর রয়েছে, তা বন্ধ করা এবং ধনী এ বিত্তশালী গোষ্ঠীর ওপরে বেশি করভার আরোপ করা।
অর্থমন্ত্রী রিভস অভিযোগ করেছেন, পূর্ববর্তী রক্ষণশীল সরকারের ২২ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ের প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো অর্থায়নের ভিত্তি ছিল না। সুতরাং সেটা শোধরানোর জন্য ২০২৪ সালের বাজেট ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।
এর ফলে সরকারি কর আয় জাতীয় আয়ের ৩৮ শতাংশ হবে—যা একটি মাইল ফলক। এই ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড কর বৃদ্ধির অর্ধেকেরও বেশি—২৫ বিলিয়ন পাউন্ড আসবে জাতীয় বিমায় মাসিক পক্ষের অবদান ১৫ শতাংশে বৃদ্ধি করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জাতীয় বিমায় মালিকপক্ষের অবদানের জন্য বর্ধিত করভারকে মালিকপক্ষ একধরনের কর্ম নিয়োজন-কর হিসেবে উপস্থাপন করবে, যা কর্ম নিয়োজন এবং প্রবৃদ্ধিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
খুচরা ব্যবসায়ী কিংবা বিনোদন খাতের ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবসার পরিমাণ যদি ১০ হাজার পাউন্ডের কম হয়, তাহলে তাদের ২০২৬ সাল পর্যন্ত করছাড় দেওয়া হবে। দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ৭ শতাংশ বাড়িয়ে ঘণ্টায় ১২.২১ পাউন্ড করা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে ভোটপ্রাপ্তির জন্য এ কৌশলটি সব সময়ে কাজ করে, কিন্তু কর্ম নিয়োজনের ওপরে এ বৃদ্ধির সম্ভাব্য প্রভাবও বিবেচনায় রাখতে হবে।
সম্পদের ওপরে যে লাভ অর্জিত হয়, তার ওপরে করহার বাড়বে। এই লাভের ওপরে নিম্নতম কর ১০ থেকে ১৮ শতাংশে এবং উচ্চতম কর ২০ থেকে ২৪ শতাংশে বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করেছে নতুন বাজেট। এর ফলে সরকারি রাজস্ব ২.৫ বিলিয়ন পাউন্ড বাড়বে। উত্তরাধিকার করের ক্ষেত্রে নানান ফাঁকফোকর বন্ধ করে অতিরিক্ত ২ বিলিয়ন পাউন্ড আদায় করা যাবে।
ব্যবসা ও কৃষিতে সম্পদের ওপরে বর্তমান করকাঠামোয় সংস্কার করা হবে। ইতিমধ্যেই অবশ্য কৃষি খাত থেকে এর সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এতে কৃষি খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে, যার কারণে ব্রিটেনের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। ব্যক্তিগত আয়কর বর্তমানে বৃদ্ধি পাবে না।
শুধুমাত্র ২০২৮ সাল থেকেই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয়কর বাড়ানো হবে। ফলে জনগণকে এ মুহূর্তেই বর্ধিত করের বোঝা বইতে হবে না। বিত্তবান ব্যক্তিদের সন্তানদের বেসরকারি খাতে যেসব বিদ্যালয় রয়েছে, তারা এত দিন ২০ শতাংশ করছাড় ভোগ করত।
ওই রেয়াত বন্ধ করে সেই সব বিদ্যালয়ের ওপরে মূল্য সংযোজন কর বসানো হবে। এর ফলে ব্রিটেনের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য কি কমবে? ভবিষ্যতই তা বলতে পারবে।
২০২৪ সালের বাজেট পেশকালে রেচেল রিভস বলেছেন, আগামী বছর জ্বালানির ওপর শুল্কহার বাড়ানো খুব ভুল কাজ হবে। কারণ, এর ফলে শীতের সময়ে গৃহ-জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে। সুতরাং জ্বালানি শুল্ক অপরিবর্তিত থাকবে। বর্তমান সময়ে জ্বালানি শুল্কের বৃদ্ধি রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত হঠকারী হতো এবং এটাকে সাধারণ মানুষের ওপরে করবৃদ্ধি বলেই বিবেচনা করা হতো।
তামাকের ওপরে শুল্ক ২ শতাংশ বাড়ানো হবে এবং হাত ডলে বানানো সিগারেটের শুল্ক ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মাদকদ্রব্য এবং চিনিযুক্ত কোমল পানীয়ের ওপরেও কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে এ বাজেটে। মনে হচ্ছে ২০২৪ সালের ব্রিটেনের বাজেটে ‘পাপের ওপরে শুল্ক’ বর্ধিত করা হয়েছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য এ গৃহায়ণের মতো সামাজিক খাতের বিভিন্ন অঙ্গনে বরাদ্দ বাড়িয়েছে ২০২৪ সালের যুক্তরাজ্যের বাজেট। নতুন বাজেটে শিক্ষা বিভাগের জন্য মূলধন বিনিয়োগ প্রকৃত অঙ্কে ২০ শতাংশ বেড়ে ৭ বিলিয়ন পাউন্ড হবে।
এর মধ্যে ১.৪ বিলিয়ন ব্যয়িত হবে ৫০০ দুর্দশাগ্রস্ত বিদ্যালয়গুলোর জন্য, অতিরিক্ত ২.৩ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করা হবে শিক্ষক নিয়োগের জন্য, ২ বিলিয়ন পাউন্ড বিদ্যালয় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য, ১ বিলিয়ন পাউন্ড বিশেষ প্রয়োজন শিক্ষার জন্য, ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ড উচ্চশিক্ষার জন্য।
দুটি পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। এক. এসব ব্যবস্থার ফলে নতুন ও পুনর্গঠিত স্কুলের উদ্ভব হবে। দুই. রাজস্ব নীতির পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে কতটা রাজস্ব যে জোগাড় করা যায়, শিক্ষা খাতে মূলধন বিনিয়োগ প্রকৃত অঙ্কে ২০ শতাংশ বৃদ্ধিই তার প্রমাণ।
বর্তমান বাজেট ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার জন্য ১০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনার প্রস্তাব করেছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, আগামী বছর স্বাস্থ্য খাতে ২ শতাংশ উৎপাদনশীলতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। স্বাস্থ্য বাজেটের দৈনন্দিন খরচের জন্য ২৩ বিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্য খাতে মূলধন বাজেট ৩ বিলিয়ন পাউন্ড বাড়ানো হয়েছে, যার মধ্যে ১ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করা হবে সেবা উন্নীতকরণের জন্য, দেড় বিলিয়ন পাউন্ড হাসপাতাল শয্যা বাড়ানো এবং পরীক্ষা সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য। স্বাস্থ্য খাতের দৈনন্দিন ব্যয়ভার বহন করার জন্য অতিরিক্ত ২৩ বিলিয়ন পাউন্ড কি যথেষ্ট?
না, কাঠামোগত পরিবর্তনের অনুপস্থিতিতে এ সংখ্যাটি যথেষ্ট নয়। কিন্তু তবুও এই অর্থ দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ৪০,০০০ নতুন রোগী দেখা যাবে, যার ফলে রোগীদের প্রতীক্ষার সময় হ্রাস পাবে।
২০২৪ সালের আগস্টের শেষে ৮ মিলিয়ন রোগী চিকিৎসার জন্য প্রতীক্ষা তালিকাতে ছিল। অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে শল্যচিকিৎসার জন্য নতুন কেন্দ্র খোলার মাধ্যমে প্রতিবছর ইংল্যান্ডে অতিরিক্ত দুই মিলিয়ন লোককে চিকিৎসা সেবা দেওয়া যাবে।
২০২৪ সালের বাজেট ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপরে গুরুত্ব দিয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে ব্রিটিশ অর্থনীতিতে সরকারি বিনিয়োগ ১০০ বিলিয়ন পাউন্ড বাড়বে। দেশে ৭০ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি জাতীয় সম্পদ ভান্ডার খোলার মাধ্যমেই এই এই বিনিয়োগ বর্ধন সম্ভব হবে।
ব্রিটিশ সরকার গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য ২০ বিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত বিনিয়োগ করবে, যার মধ্যে থাকবে প্রকৌশল, জীবপ্রযুক্তি ও চিকিৎসার জন্য ৬ বিলিয়ন পাউন্ড। স্থানীয় সরকারগুলোর জন্য অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় সরকার ১.৩ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করা হবে, যার মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়িত হবে সামাজিক সেবার লক্ষ্যে।
গৃহায়ণে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সরকার ৫ বিলিয়ন খরচ করবে, যাতে ব্যয়সাধ্য গৃহের জোগান বৃদ্ধি পায়। শীতকালে গৃহের উষ্ণতা বৃদ্ধি করা এবং গৃহের জ্বালানি ব্যয় হ্রাস করা লক্ষ্যে ৩.৪ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করা হবে।
এর সবকিছু করার মাধ্যমে জনগণের জন্য সামাজিক সেবাতে ব্যপ্ত করা হবে।
২০২৪ সালের যুক্তরাজ্যের বাজেটের তিনটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এক. প্রয়োজনীয়, কিন্তু জন-হৃদয়গ্রাহী নয়, এমন শক্ত ব্যবস্থা নিতে ২০২৪ সালের বাজেট পিছ পা হয়নি। করবৃদ্ধি, অর্থব্যবস্থার অজানা ফাঁকফোকর বন্ধ করা, ‘পাপ করের’ মতো জননিন্দিত বিষয়গুলোর দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যাবে। দুই. ২০২৪ সালের বাজেট বিত্তবানদের ওপরে নানান করারোপ করেছে, কিন্তু সাধারণ মানুষকে করাব্যহতি দিয়েছে। যেমন আয়কর বাড়ানো হয়নি, জ্বালানি শুল্ক পূর্বের অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়েছে। তিন. বর্তমান বাজেট সামাজিক খাত। যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গৃহায়ণ বিষয়ে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে।
তবে অনেক সময়েই এই বাজটের বিষয়গুলো পুরোপুরি সাদা-কালো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছে এবং নানান নীতিমালায় যে ‘সুযোগ ব্যয়’ আছে, তাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি।
কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে দেশের একটি ক্রান্তিকালে যুক্তরাজ্যের ২০২৪ সালের বাজেট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র