জেন-জিরা ‘বখে যাওয়া প্রজন্ম’ নাকি তাদের হাতেই পরিবর্তনের চাবি

জেন-জি প্রজন্মই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তারাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে।

আজ জেন-জি প্রজন্ম নিয়ে লিখতে গিয়ে ১৯৯৭ সালের কথা বেশ মনে পড়ছে। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন চারপাশে কারও কাছে মুঠোফোন দেখেছি কি না, মনে পড়ে না। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে কোনো কক্ষে কম্পিউটারও বিশেষ ছিল না।

পরের বছরেই (১৯৯৮) আজকের কাগজ পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। তখন আমি ও আমরা প্রায় সবাই হাতে নিউজ লিখতাম। আমি নিজে কম্পিউটারে লেখা শিখেছি ২০০১ সালে। তবে ২০০০ সাল থেকেই মুঠোফোন, কম্পিউটার একটু একটু সহজলভ্য হতে শুরু করে।

তখন ইন্টারনেটের স্পিড ছিল ভয়ানক রকমের দুর্বল। আজকের মতো ইউটিউব, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কিছুই ছিল না। আমরা ভিসিআরে সিনেমা দেখতাম, ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতাম।

১৯৯৭ সালের কথা যে কারণে এল, অর্থাৎ ওই বছর থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের (২০১২) মধ্যে যাদের জন্ম তারাই জেনারেশন জেড, সংক্ষেপে জেন-জি প্রজন্ম নামে পরিচিত। এখন জেন-জি প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের সর্বোচ্চ বয়স ২৭ বছর, আর সর্বনিম্ন বয়স ১২।

এরা জন্মের পরপরই নানা ধরনের গ্যাজেটের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। এদের আমরা ‘প্রযুক্তি প্রজন্ম’ বলতেই পারি।

জেন-জি প্রজন্মের যাঁদের বয়স ২৭, তাঁরা ইতিমধ্যে লেখাপড়া শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। উন্নত বিশ্বে ২৬-২৭ বছর বয়সী জেন-জি ‘বস’ও আছেন হাজার হাজার। আবার বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য জুতোর সুকতলা ক্ষয় করছেন জেন-জি প্রজন্মের অনেকেই।

লক্ষণীয় হলো, জেন-জি প্রজন্মের জন্য বড় আঘাত হয়ে আসে করোনা মহামারি। ২০২০ সালে পৃথিবীব্যাপী যখন এই ভাইরাস আতঙ্ক ছড়ানো শুরু করে, জেন-জি প্রজন্মের ‘সিনিয়র সিটিজেন’দের বয়স তখন ২৩ বছর। কেউ স্নাতক শেষ করেছেন। কেউ করতে পারেননি। কেউ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন, কিন্তু কাজ করতে হয়েছে ঘর থেকে।

চাকরির শুরুতেই ‘হোম অফিস’ করতে বাধ্য হওয়ায় অনেকেরই যোগাযোগদক্ষতায় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আর যাঁরা স্নাতক শেষ করতে পারেননি, তাঁদের বারবার শুনতে হয়েছে পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার দুঃসংবাদ। অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। শুনতে হয়েছে ‘অটো পাসে’র বদনাম। অনেকেই কম্পিউটার-মুঠোফোন নিয়ে দিনরাত পড়ে থেকেছেন। পরিবারের সঙ্গে অনেকেরই ব্যবধান তৈরি হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা সন্তানদের নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়াতেই জেন-জি প্রজন্মের মধ্যে এমন চিত্র দেখা গেছে।

২.

জেন-জি প্রজন্মের চিন্তা ও পেশাগত ভাবনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহুমুখী গবেষণা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান গবেষণা করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের স্যানট্যানডার ব্যাংক, অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক, ফোর্বস ম্যাগাজিন, হার্ভার্ড ল স্কুল, হ্যারিস পোল ও গুগল ওয়ার্কস্পেস। এসব গবেষণার ফলাফল প্রতিবেদন আকারে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে হয়েছে বিস্তর তর্কবিতর্ক।

সেসব গবেষণার ফলাফলের দিকে যাওয়ার আগে বলা প্রয়োজন, জেন-জির সঙ্গে এর আগের প্রজন্ম মিলেনিয়ালের (১৯৮১-১৯৯৬) চিন্তাভাবনায় ফারাক অনেক বেশি। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্থক্যই এই ব্যবধান তৈরি করেছে। মিলেনিয়াল প্রজন্ম মনে করে, জেন-জিদের মধ্যে উদ্দীপনার অভাব আছে। এরা পরিশ্রম ছাড়াই সাফল্য পেতে চায়। যদিও অভিযোগটির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ আছে।

জেন-জি প্রজন্মের চিন্তা ও পেশাগত ভাবনাকে মোট পাঁচটি পয়েন্টে পাঠকদের জন্য হাজির করা যাক।

এক. জেন-জি প্রজন্মের বেশির ভাগ মানুষ ধরাবাঁধা ৯টা-৫টার চাকরি পছন্দ করে না। স্যুট-টাই পরে অফিসে গিয়ে আরামকেদারায় বসা এঁদের ধাতে নেই। তাঁরা দিনের যেকোনো সময়ে কাজ করতে আগ্রহী। দীর্ঘ সময় ধরে অফিসে থাকাও তাঁদের বিশেষ পছন্দের নয়। ক্যারিয়ারের উন্নতির চেয়ে ব্যক্তিগত জীবনে সুস্থতা ও মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিতে ইচ্ছুক এই প্রজন্মের অনেকেই।

দুই. চাকরির চেয়ে ব্যবসা করতেই জেন-জি বেশি আগ্রহী। তাঁরা মনে করেন, ব্যবসা করার যোগ্যতা তাঁদের আছে। তাঁদের মতে, এই ডিজিটাল যুগে ব্যবসাবিষয়ক তথ্যাদি ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়। অবশ্য তাঁরা যে চাকরির প্রতি পুরোপুরি অনাগ্রহী, তা-ও পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না।

তিন. জেন-জি প্রজন্মের একটি অংশ মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেই বেশ আয় করা যায়। একটি স্মার্টফোন থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব। পেশা বলতে আমরা এতকাল যা বুঝে এসেছি, সে ধারণা থেকে জেন-জি প্রজন্মের ধারণা বেশ আলাদা। এঁদের অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং করেন এবং বাকি জীবনে সেটাই করে যেতে চান।

চার. প্রথাগত অফিসগুলোতে যে ‘জি-স্যার, ইয়েস স্যার, স্যার স্যার’ ব্যাপার থাকে, জেন-জি প্রজন্ম এই ব্যাপারটিকে একদম পছন্দ করেন না। জ্যেষ্ঠ সহকর্মী হওয়ায় তাঁকে যে আলাদা খাতির করতে হবে, এটা তাঁরা মানে না। অফিসের নির্দিষ্ট আউটফিট অর্থাৎ পোশাক পরার ক্ষেত্রেও তাঁদের আপত্তি আছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর প্রতিবেদন বলছে, জেন-জি বসরা অফিস আর বাসার মধ্যে তেমন পার্থক্য রাখেন না। প্রায়ই ঘরে পরার বা জিমে যাওয়ার কাপড় ও জুতা পরে অফিসে চলে আসেন।

পাঁচ. অক্টোবরের শেষের দিকে ফোর্বস-এর এক জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে জেন-জি প্রজন্মের একটি বড় অংশকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, যেখানে পুরোনো নিয়মকানুন বহাল আছে, সেখানে চাকরিতে তাঁরা উৎসাহী হচ্ছে না। তা ছাড়া কর্মজীবনের শুরুতেই হোম অফিস করায় অনেকেই অফিসের নিয়মকানুন ততটা শিখতে পারেননি। জেন-জি প্রজন্ম বিশ্বাস করে, যেসব প্রতিষ্ঠান তাঁদের কাজকে উৎসাহ দেয় না, তাদের হয়ে কাজ করার চেয়ে জীবনে আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে।

৩.

এতক্ষণ আমরা জেন-জিদের বৈশ্বিক চিত্র দেখলাম।

বাংলাদেশের জেন-জিদের চিন্তা ও পেশাগত ভাবনা সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি, বুঝি। যদিও, জানামতে, বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এখন অবধি এ বিষয়ে কোনো গবেষণা করেনি। তবে বৈশ্বিক গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে আমাদেরও কিছুটা মিল থাকবে ধরে নেওয়া যায়। তারপরও গবেষণা হওয়া জরুরি ছিল। বাংলাদেশের কোনো গবেষণাপ্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যাংক, চাকরিসংক্রান্ত ওয়েবসাইট কিংবা কোনো গণমাধ্যমও এই গবেষণা করার কথা ভাবতে পারে।

আমাদের দেশে ছাত্র-জনতার যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তাতে সামনের সারিতে জেন-জি প্রজন্মই ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তারা নিজেরা সংগঠিত হয়েছে, অন্যদেরও সংগঠিত করেছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা মোটের ওপর পিছিয়ে নেই।

এই জেন-জি প্রজন্মই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে তারাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। ইদানীং কেউ কেউ এই প্রজন্মের সমালোচনা করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণ করে তাঁরা বলছেন, এরা ‘বখে যাওয়া প্রজন্ম’। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আক্রমণকারীদের মধ্যে অনেক শিক্ষিত মানুষও রয়েছেন। এঁরা হয়তো চিন্তার দিক থেকে শিক্ষিত হতে পারেননি। কিন্তু জুলাই-আগস্টে আমাদের এই জেন-জিরাই প্রমাণ দিয়েছেন, তাঁরা মোটেই বখে যাওয়া প্রজন্ম নন। তাঁরাই দেশের সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।

আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভালোবাসি এবং এদের নিয়ে গর্ব করি। কারণ, দুনিয়ার কোনো দেশে জেন-জিরা এত বড় বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়নি। তাই আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে এই তরুণেরা আরও বেশি করে চাকরি, ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন। উদ্যোক্তা হতে পারেন। নীতি তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপকদেরই দায়িত্ব, তরুণদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান উপবার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো

ই-মেইল: ‍[email protected]