প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘কাজের মাধ্যমে আশার সঞ্চার করা’।
যখন মানুষ জীবনে কোনো আশার আলো দেখতে না পেয়ে নিরাশ, হতাশ, হতোদ্যম হয়ে পড়ে; আর কোনো উপায় নেই বলে নিজেকে অসহায়, নিরুপায় মনে করে, তখন তার মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা জাগে। স্বভাবতই তাই এসব মানুষের মনে যদি আশার সঞ্চার করা যায়, ভরসা–উপায়ের কোনো পথ বের করে দেওয়া যায়, তাদের আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরানো সম্ভব। তবে এ রকম ‘আশাবাদ’ শুধু কথার কথা হলে চলবে না, কেতাবি, তাত্ত্বিক জ্ঞান, উপদেশ হলে হবে না, প্রকৃত কাজের মাধ্যমে তাদের সামনে বাস্তব ও দৃশ্যমান উদাহরণ তৈরি করতে হবে। তাদের দেখাতে হবে, আমরা তোমাদের কেয়ার করি, তোমাদের সহায়তা করতে চাই।
আত্মহত্যার রয়েছে সামাজিক, আবেগীয় ও আর্থিক প্রভাব। পৃথিবীতে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৮ থেকে ৩৫ জন আত্মহত্যা করে। এ সংখ্যা ইদানীং আরও বাড়ছে। তদুপরি যত মানুষ আত্মহত্যা করে, তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি মানুষ ‘আত্মহত্যার চেষ্টা’ করে। তার মানে, বছরে বিশ্বে ১ কোটি ৬০ লাখ লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যা হচ্ছে সর্বোচ্চ মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ (মেয়েদের ক্ষেত্রে) ও তৃতীয় কারণ (ছেলেদের ক্ষেত্রে)। এ ছাড়া বিশ্ব আত্মহত্যার ৭৭ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়।
শুধু আত্মহত্যার হার নয়, মানসিক রোগের প্রকোপ বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে অনেক বেশি। অথচ ‘লোকলজ্জার’ ভয়ে (স্টিগমা), ‘পাগল’ বলে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে, মানসিক সমস্যার প্রকৃত হার ও বিস্তার বিষয়ে এমনকি ডাক্তারদের মধ্যেও সঠিক ধারণা না থাকার কারণে মানসিক রোগ চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসা গ্রহণ তেমন একটি হয় না। ফলে আত্মহত্যার হার দিন দিন বাড়ছে।
আশার কথা হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। মানসিক রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগে থেকেই এগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে। কে জেমিসন নিজের আত্মহত্যার বেদনার কথা লিখেছেন তাঁর বই ‘অ্যান আনকোয়েট মাইন্ড’তে। তেমনি স্টাইরন লিখেন তাঁর বই ‘ডার্কনেস ভিজিবল’। এই বইগুলোয় তাঁরা ওই মানসিক যন্ত্রণাকে এমন অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন, যেন কালোচশমা দিয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা—যার ফলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সবকিছু অন্ধকার, বিবর্ণ মনে হয়।
আত্মহত্যার অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে—মেজর ডিপ্রেশন, মদ ও মাদকাসক্তি, সিজোফ্রেনিয়া ও পূর্বে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ব্যক্তিরা। অথচ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা টিটকারি করি, অবহেলা বা অবজ্ঞা করি। বলি তারা ‘ঢং’ করছে, মনোযোগ পেতে চাচ্ছে, সুবিধা আদায় করতে চাচ্ছে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে তারা আবেগীয় ও মানসিকভাবে অতি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী। একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, পরবর্তী সময় আত্মহত্যা করার হার তাদের ছয় গুণ বেশি। তারা সামান্য কারণে ভেঙে পড়ে, হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয় ও গ্লানিতে ভুগে। পরিবার ও স্কুলে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছেলেমেয়েদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের আচরণ যত বিরক্তিকর, অসহ্য মনে হোক না কেন— ঘৃণা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করা ঠিক হবে না। বরং তাদের দরকার যত্ন, স্নেহ, সহায়তা ও প্রয়োজনে প্রফেশনাল কাউন্সেলিং।
আশার কথা হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। মানসিক রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগে থেকেই এগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে। কে জেমিসন নিজের আত্মহত্যার বেদনার কথা লিখেছেন তাঁর বই ‘অ্যান আনকোয়েট মাইন্ড’তে। তেমনি স্টাইরন লিখেন তাঁর বই ‘ডার্কনেস ভিজিবল’। এই বইগুলোয় তাঁরা ওই মানসিক যন্ত্রণাকে এমন অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন, যেন কালোচশমা দিয়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা—যার ফলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সবকিছু অন্ধকার, বিবর্ণ মনে হয়।
সবশেষে উল্লেখ করতে হয় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা নিয়ে। কেননা, কিশোর–কিশোরীদের মধ্যে ‘অনুকরণ’ করে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। যখন কোনো কিশোর–কিশোরীর আত্মহত্যার খবর প্রচারিত হয় দেখা যায়, তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবেগীয়ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ আরও অনেক কিশোর–কিশোরী একই পদ্ধতি ব্যবহার করে আত্মহত্যা করে বা চেষ্টা করে। তাই পত্রপত্রিকা ও টিভিতে দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল রিপোর্টিংয়ের জন্য ১০টি নীতিমালা ঠিক করা হয়েছে। সেগুলো হলো—
১। আত্মহত্যার পদ্ধতি নিয়ে রিপোর্ট না করা। ২। রিপোর্টে আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয় ও কোথায় সহায়তা পাওয়া যাবে, সেসব তথ্য যুক্ত করা। ৩। আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করে সেনসেশন তৈরি করে তেমন বিষয়ে বিরত থাকা। ৪। আবেগীয় ও নাটকীয় ছবি এবং ভিডিও না দেওয়া। ৫। অতিরিক্ত কাভার না করা। ৬। সোশ্যাল মিডিয়াকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা—মন্তব্য করা ও লিংক শেয়ারের সুযোগ না রাখা। ৭। আত্মহত্যার জন্য বিখ্যাত স্থানের উল্লেখ না করা। ৮। সুইসাইড নোটের বিবরণী প্রকাশ না করা। ৯। অনুমাননির্ভর কারণ বা উসকে দেওয়া কাহিনি প্রচার না করা। ১০। কিশোর–কিশোরীদের আত্মহত্যা যেহেতু সংক্রামক, তাই তাদের আত্মহত্যার খবর বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে প্রকাশ করা।
অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ