একজনের নাম আলামিন। কসাই আলামিন। বাড়ি পাবনা।
আরেকজনের নাম মোফাজ্জেল। ‘মিস্ত্রি’ মোফাজ্জেল। বাড়ি হবিগঞ্জ।
দুজনেরই পরিবার আছে। আলামিন বিয়ে করেছেন এক বছর। এখনো সন্তান হয়নি। মোফাজ্জেলের পরিবারে স্ত্রী ও তিন সন্তান।
স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ফেলে তাঁরা দুজনই ঈদ করছেন ঢাকায়। মোফাজ্জেল হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছেন তিন দিন আগে। তাঁর কাজ হলো গেরস্তের বটি–ছুরি–চাপাতি ধার করা।
তিন দিন ধরে মোফাজ্জেল ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে প্যাডেলযুক্ত মেশিন দিয়ে দা-বঁটি ধার করেছেন। আমরা যারা পশু কোরবানি দিচ্ছি, তারা মোফাজ্জেলের কাছ থেকে বঁটি শাণিয়ে নিয়েছি মাংস কাটার জন্য।
পুলিশ, সাংবাদিক, এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী, রিকশাওয়ালা, বাস–ট্রাকের শ্রমিক, ডাক্তার, নার্স, এমন বহু জরুরি পেশার লোকেরা আজ স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করছেন। দায়িত্ব পালনের সময় একটা সূক্ষ্ম কষ্ট তাঁদের মনে গেঁথে থাকে।
সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মোফাজ্জেলের রোজগার হয় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। সকালবেলা রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে দুটো রুটি ডাল দিয়ে খেয়েছেন। দুপুরে পাউরুটি কলা। রাতে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে খাবার শেষ করেছেন। বাকি টাকা জমিয়েছেন ঈদের দিনে সকালবেলায় বাড়ি যাওয়ার জন্য।
অন্যদিকে, দেশের বাড়িতে যখন সবাই ঈদের সেমাই-পায়েস খাচ্ছেন, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাচ্ছেন, তখন আলামিন ঢাকার সবুজবাগের একটি বাড়িতে কোরবানির গরুর মাংস কাটছেন। গরুর দামের বিপরীতে প্রতি হাজারে ১০০ টাকা তিনি পারিশ্রমিক পাবেন। অর্থাৎ গরুর দাম যদি ১ লাখ টাকা হয় তাহলে তিনি পাবেন ১০ হাজার টাকা। যে দালাল তাঁকে কাজটি জুটিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে সেই দালালকে এই টাকা থেকে একটি অংশ দিতে হবে। আমিও আলামিনকে আমার পশু কোরবানির কাজে নিয়ে নিলাম।
আমরা যখন সবাই কোরবানির গোশত রান্না করে খেতে বসব, তখন হয়তো আলামিন বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হবেন। বাড়িতে যখন পৌঁছবেন, তখন রাত।
ঢাকায় এই রকম মোফাজ্জেল ও আলামিনের মতো কয়েক হাজার লোক এসেছেন, যাঁরা আমাদের কোরবানির আনন্দের আয়োজন করে যান। কিন্তু সেই আনন্দে তাঁরা যুক্ত হতে পারেন না।
বহু রাজমিস্ত্রি বা নির্মাণশ্রমিক মাসের পর মাস যে ভবন গড়ে তোলেন, নির্মাণ শেষ হওয়ার পর তাঁদের নিজেদেরই হাতে গড়া সেই ভবনের একটি পরিপাটি কক্ষে একটি রাতও আরাম করে ঘুমানোর অধিকার তাঁদের থাকে না।
মোফাজ্জেল-আলামিনদের মতো কোরবানি-শ্রমিকেরা আমাদের ঈদ উৎসবকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেন। কোরবানির পশু জবাই করে মাংস কেটে রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে দেন। কিন্তু হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া কারও পক্ষেই গেরস্তের বাড়িতে মানবিক মর্যাদায় যথার্থ আতিথেয়তাও এক বেলা খাবার সুযোগ হয় না। কেউ হয়তো গোস্ত দিয়ে দেন। সেই গোস্ত বিক্রিও হয় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। যারা কোরবানি দিতে পারেন না তাঁরা কিছুটা কম দামে সেই গোস্ত কিনে নেন। মোফাজ্জেল–আলামিনেরা এ গোস্ত রান্না করবেন কীভাবে। ফলে সেই গোস্ত বিক্রি করেও কিছু টাকা হয়তো আয় হয় তাঁদের।
মোফাজ্জেল জানান, তাঁরা প্রায় ৬০ জন মিস্ত্রি ঢাকায় এসেছেন। এ রকম অনেক দল তিন দিন আগে থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে কাজ করেছেন। চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতেও তাঁদের এলাকা থেকে দা-বঁটি ধার করার লোক গিয়েছেন।
পরিবার ছেড়ে ঈদের দিনে ঢাকায় এভাবে কাজ করতে খারাপ লাগছে কি না, তা জিজ্ঞেস করলে মোফাজ্জেল মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘খারাপ তো লাগেই। কী আর করার আছে। সংসার তো চালাতে হবে।’
আল আমিন বললেন, ‘আমাগো মতো গরিব মানুষের ঈদও যা, আর দশটা দিনও তা।’
ঈদের দিনে কাজ করতে হয়—এমন বহু পেশার মানুষ আমাদের চারপাশে আছেন।
পুলিশ, সাংবাদিক, এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী, রিকশাওয়ালা, বাস–ট্রাকের শ্রমিক, ডাক্তার, নার্স, এমন বহু জরুরি পেশার লোকেরা আজ স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করছেন। দায়িত্ব পালনের সময় একটা সূক্ষ্ম কষ্ট তাঁদের মনে গেঁথে থাকে। কিন্তু সরাসরি যাঁরা কোরবানির পশুর মাংস কাটা ও ভাগাভাগির সঙ্গে যুক্ত থেকেও কোরবানির আনন্দে শামিল হতে পারেন না, তাঁদের কষ্ট একেবারে অন্য রকম।
এই মানুষেরা নিজেরা এক চাপা বিষাদ বুকের মধ্যে রেখে আমাদের আনন্দ আয়োজন করে দিয়ে যান। ঈদ মানে ত্যাগ—তবে মোফাজ্জেল ও আলামিনদের ত্যাগ অন্যদের তুলনায় ভিন্নই বলা যায়।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]