একজন প্রেসিডেন্ট কতটা ভিতু হতে পারেন, তার স্মারক হয়ে থাকবে আলিঙ্গনটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অক্টোবরের মাঝামাঝিতে তেল আবিবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। বোঝাতে চান, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে আছে, এ শুধু কথার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্র সত্যি সত্যিই ইসরায়েলের সঙ্গে আছে।
দৃশ্যটি আবার মনে করুন। বাইডেন এয়ারফোর্স ওয়ান থেকে নামছেন, নেতানিয়াহু উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন। কৃতজ্ঞতায় তাঁর মন ভরে উঠছে। মাথার ওপরে চক্কর দিতে থাকা ‘হোয়াইট হাউসের’ শব্দে নিচে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কথা প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না এ সময়। আমরা দেখলাম, নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগকে দেখে মাথা নাড়ছেন। ইসরায়েলি ও মার্কিন দেহরক্ষীরা পাশে দাঁড়ানো।
মিনিট কয়েক পর, বাইডেন তাঁর সেই ট্রেডমার্ক বৈমানিক রোদচশমা পরে উড়োজাহাজ থেকে নামতে শুরু করেন। বিমানের সিঁড়িতে বিরতি নেন কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর নেতানিয়াহুর দিকে তিনি এমনভাবে তাকান, ঠিক যেমনভাবে ভাবি নববধূ তাঁর স্বামীর দিকে তাকায়। তিনি কিছুটা বিবর্ণ ও ক্লান্ত। একসময় বিরতি ভেঙে বাইডেন উজ্জ্বল মুখ করে নেতানিয়াহুর দিকে এগিয়ে যান। তাঁর পিঠে হালকা চাপড় দেন বাইডেন। আনন্দে আত্মহারা প্রধানমন্ত্রী কিছু একটা বলেন এ সময়, উত্তরে বাইডেনও কিছু একটা বলেন।
রাজনীতিকেরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে থাকেন প্রায়ই। কিন্তু এই দুই নেতার দীর্ঘ আলিঙ্গন ছিল আন্তরিক। যার মর্মার্থ দাঁড়ায়, ইসরায়েলের অপরিহার্য পৃষ্ঠপোষক নিজে উড়ে এসেছেন এই বার্তা নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্র তার অপরিহার্য মিত্রের পাশে থাকবে।
কিন্তু বাইডেন ও তার সমর্থক শিবিরের অজান্তেই একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। এমনিতেই তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান কিছুটা নড়বড়ে। নেতানিয়াহুর সামনে ‘ব্রো’ চেহারা নিয়ে হাজির হয়ে তিনি যে একাত্মতা ঘোষণা করলেন, তাতে হয়তো এবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দরজাই বন্ধ হয়ে গেল।
অচিন্তনীয় হলেও সত্য যে বাইডেন তেল আবিবে গিয়ে এমন একটি সরকারের পক্ষে দাঁড়ালেন, যে সরকার বহু বছর ধরে কর্তৃত্বপরায়ণ। যে সরকারকে নিয়ে তিনি নিজেই বিভিন্ন সময় উদ্বিগ্ন থেকেছেন, এমনকি অবজ্ঞাও করেছেন।
ওই যে বলে না, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখানেও ব্যাপারটা দাঁড়াল এমন।
কয়েক সপ্তাহ পরই এই আলিঙ্গনকে বাইডেনের নির্লজ্জ কপটতা ও গোঁয়ার্তুমির প্রতীক হিসেবে ধরা হলো।
এই প্রেসিডেন্টই কিছুদিন আগে রাশিয়ার নির্দয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। অথচ তিনিই গাজা ও গাজার বাইরে ইসরায়েলের বর্বর হামলার পক্ষে দাঁড়ালেন। আরও চোখে লাগল, যখন এই প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনি শিশু, অসুস্থ ও বৃদ্ধদের ওপর তাঁর মিত্র ইসরায়েলের হামলার প্রশংসা করে সাফাই গাইলেন।
বাইডেনের এই কপটতা ও গোঁয়ার্তুমি শুধু মানুষকে আহত করেনি, নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজ্যের মানুষকে ক্ষুব্ধও করেছে, বিশেষ করে তরুণ ডেমোক্র্যাট ও আরব–মার্কিনদের। এই ক্ষোভ-দুঃখকে সঙ্গে করে কমান্ডার ইন চিফকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে, যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে আর এক বছরও সময় নেই।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটা ভোটের ফলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়। তা হলো বাইডেন ও তাঁর একচোখা পারিষদেরা ইসরায়েলের প্রতি শর্তহীন সমর্থনের প্রভাব কতটা গভীর হতে পারে, সে সম্পর্কে ধারণা করে উঠতে পারেননি। যেমন তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি, একজন প্রযুক্তিবান্ধব ও কৌশলী রাজনীতিককে আলিঙ্গনের ফল কেমন হতে পারে। কারণ, ওই রাজনীতিককে লাখ লাখ ইসরায়েলিই পছন্দ করেন না।
বাইডেন প্রশাসনের ধারণা ছিল, ৭ অক্টোবর হামাসের প্রাণঘাতী হামলার পর ইসরায়েলকে যে কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে, তাকে স্বাগত জানাবে সবাই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সনদের বাইরে গেলেও ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো হবে ইতিবাচক। আদতে বাইডেনের প্রতি আরব-মার্কিনদের সমর্থন এখন দ্রুত উবে যাওয়ার পথে।
এই আলিঙ্গনের প্রেক্ষাপটে নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের জনপ্রিয়তা এখন ৪০ শতাংশে নেমেছে। ক্ষমতায় আসার পর তাঁর জনপ্রিয়তার হার এখন সর্বনিম্ন।
ভোটাভুটির আয়োজকেরা বলেছেন, বাইডেনের এই আলিঙ্গন এবং হামাসকে ধ্বংসের নামে নেতানিয়াহুর যে ভয়ংকর যুদ্ধ ও হত্যা, তার প্রতি সমর্থনকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মেনে নিতে পারেননি। টেক্সাসের অস্টিনের ডেমোক্র্যাট সমর্থক মেগ ফুয়েরি (৪০) এনবিসি নিউজকে বলেন, ‘আমি ইসরায়েলের প্রতি তাঁর এই সমর্থনকে সমর্থন করি না।’
মেগ ফুয়েরি একা নন। ডেমোক্র্যাটদের বড় অংশ মনে করে, ইসরায়েল প্রতিরোধের নামে গাজাকে মুছে দিতে চায় এবং একটু একটু করে পশ্চিম তীরকে দখল করে নিতে চায়। ইসরায়েল বাড়াবাড়ি করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে ১৮-৪০ বছর বয়সী ডেমোক্র্যাট সমর্থকেরা ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ নিয়ে বাইডেনের যে অবস্থান, তাকে সমর্থন করেন না। ভোটের একজন আয়োজক বলেন, ‘এই ভোটের ফল চমকে দেওয়ার মতো। ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রভাব বাইডেনের ওপর যেভাবে পড়েছে, তা আসলে চমকে যাওয়ার মতোই।’
বাইডেন প্রশাসনের ধারণা ছিল, ৭ অক্টোবর হামাসের প্রাণঘাতী হামলার পর ইসরায়েলকে যে কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে, তাকে স্বাগত জানাবে সবাই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সনদের বাইরে গেলেও ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো হবে ইতিবাচক। আদতে বাইডেনের প্রতি আরব-মার্কিনদের সমর্থন এখন দ্রুত উবে যাওয়ার পথে। অক্টোবরের শেষভাগে এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, আরব–মার্কিনদের মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ প্রেসিডেন্টকে সমর্থন দিচ্ছে। তিন বছর আগের তুলনায় এটা ৪২ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন-রক্তাক্ত মরদেহ, ময়লা-আবর্জনায় মাখামাখি হওয়া ফিলিস্তিনি শিশুদের ধ্বংসাবশেষ থেকে টেনে তোলার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশনের পর্দায় যত দেখানো হবে, ততই কমবে সমর্থন।
বাইডেন ও তাঁর শিবিরে যাঁরা পরিস্থিতিকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিলেন, তাঁরা ইসরায়েলকে শর্তহীন সমর্থনের রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে এখন বুঝতে শুরু করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট ও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে একাধিক অভিযোগের মুখোমুখি হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো হুমকি। তিনি আসন্ন নির্বাচনে শক্ত একজন প্রার্থী এবং সম্প্রতি আরও শক্তি সঞ্চয় করেছেন। ট্রাম্পকে নিয়ে মানুষের মধ্যে উন্মাদনাও বাড়ছে।
ক্ষোভ ও অসন্তোষের মুখে বাইডেন সম্প্রতি নিজেকে একজন ন্যায়পরায়ণ আপসকারী হিসেবে প্রমাণের কসরত শুরু করেছেন। যুদ্ধের প্রভাব ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের ওপর সমানভাবে পড়েছে, এটা তিনি অনুধাবন করছেন—এমন একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে।
খবর বেরিয়েছে যে তিনি দুটি চিঠি লিখেছেন। এর একটি ইসরায়েলপন্থী মার্কিনদের জন্য। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে আছে, এ কথার পুনরুল্লেখ করেছেন তিনি। অন্য চিঠিটি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুতে শোক জানাই।’
এই বস্তা পচা, ছিচকাঁদুনে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাইডেনের এই নাটক একজন আরব–মার্কিনকেও প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয় না। গাজায় ইসরায়েল যা করেছে, সে ব্যাপারে তাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। বাইডেনের এই চিঠিতে তারা তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে না।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাইডেন যা করেছেন, হোয়াইট হাউসের প্যাডে লেখা চিঠি দিয়ে তার ক্ষতিপূরণ হয় না।
তাই খুশির সঙ্গে আমি বলতে চাই যে বাইডেনের দিন শেষ।
আরও খুশির খবর হলো বাইডেন তাঁর এই প্রেসিডেন্ট পদ এমন একজনের জন্য খোয়াতে পারেন, যার নিজেরই অবস্থান নড়বড়ে। তিনিও যেকোনো দিন ক্ষমতা হারাবেন, ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন অহংকারী এসব প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নাগরিকদের ভয়ংকর ক্ষোভের মুখে পড়বেন।
আমি অন্তত একজনের জন্য এমন একটা গণ-অভ্যুত্থানের অপেক্ষায় আছি। এই অভ্যুত্থান তাঁর প্রাপ্য।
অ্যান্ড্রু মিট্রোভিকা আল–জাজিরার কলাম লেখক।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত