রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে তিন ঘণ্টার বেশি সময় হলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁর ডেবিট কার্ড থেকে টাকাও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এরপর তাঁকে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, তাঁদের বিপক্ষে কোনো কথা বললে কিংবা কোনো পদক্ষেপ নিলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। প্রাণের ভয়ে এই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। ডাক্তারি পরীক্ষার পর জানা গেছে, নির্যাতনের ফলে তাঁর কানের পর্দা ফেটে গেছে। এত সব অত্যাচারের পরও প্রাণভয়ে তিনি সরাসরি কোনো অভিযোগ করতে পারেননি। চিঠি লিখে কুরিয়ারের মাধ্যমে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পাঠাতে হয়েছে।
এরপর আমরা কী দেখলাম? বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র এবং শিক্ষক বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিচার চাইতে হবে কেন?
এই ঘটনা ঘটেছে ১৭ আগস্টে। এই লেখা আমি যখন লিখছি, তখন ঘটনার দশ দিন পার হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক এবং কর্তাব্যক্তিদের কেউ কি এই ঘটনা জানতেন না? তাহলে তাঁরা কেন কোনো ব্যবস্থা নিলেন না? যাঁরা ওই ছাত্রকে অত্যাচার করেছেন, তাঁরা তো দিব্যি হলে থাকছেন। ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। উল্টো যে ছাত্র অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তাঁকেই কিনা প্রাণভয়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে! পরীক্ষা না দিয়েই তাঁকে পালাতে হয়েছে। নইলে তাঁকেও হয়তো বুয়েটের আবরারের মতো ভাগ্য বরণ করতে হতো।
একজন ছাত্রকে হলের ভেতর আঘাত করে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। কারা দিয়েছেন, সেই নামও পত্রিকায় পরিষ্কার করে এসেছে। এরপরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? সবার প্রথমেই তো উচিত ছিল, তাঁদের ছাত্রত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করে এক কিংবা দুই দিনের ভেতর তদন্ত করে প্রমাণ সাপেক্ষে তাঁদের সারা জীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা।
এর কোনো কিছু কি হয়েছে? হয়নি। উল্টো যাঁর ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তিনিই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্তাব্যক্তিদের এই দায় নিতেই হবে। তাঁদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এর জবাবদিহি করতে হবে। ওনারা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় ওনাদের নিজেদের সম্পত্তি। ওনারা ভুলতে বসেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় ওনাদের নয়। বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের সম্পত্তি। কারণ, তাঁদের ট্যাক্সের টাকায়ই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তাই তাঁদের সব কাজের সমালোচনা করার অধিকার যেমন দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আছে, ঠিক তেমনি একজন রিকশাওয়ালা কিংবা শ্রমিকেরও আছে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে। ঢাকা মেডিকেলের এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে স্রেফ বসে থাকার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘আপনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র? আইডি কার্ড দেখান।’ উত্তরে তিনি ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসক দাবি করে জানিয়েছেন, কার্ড সঙ্গে করে আনা হয়নি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁর গায়ে হাত তুলেছেন। ওই ইন্টার্ন চিকিৎসক অবশ্য কোনোভাবে বেঁচে ফিরে পরে থানায় জিডি করেছেন।
অন্যদিকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হলের নেতারা নাকি পোস্টার টাঙিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন, হলের বড় ভাইদের হ্যান্ডশেক করার সময় ঝাঁকি দেওয়া যাবে না, বুকে হাত দেওয়া যাবে না ইত্যাদি। আরেক হলের ছাত্রনেতারা অবশ্য আরও এক ধাপ এগিয়ে হলের ছাদে গিয়ে বিয়ার খেয়ে চিৎকার করে গান গাওয়ার সময় বাগ্বিতণ্ডার জেরে বিরোধে জড়িয়েছেন।
দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা পড়ে আমার মনে হয়েছে, এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কি শিক্ষক-কর্মকর্তা নেই? তাঁদের কাজটা কী? তাঁরা যদি থেকেই থাকেন, তাহলে দুই দিন পরপর এসব ঘটনা কী করে ঘটে? নাকি তাঁরা এসব বিষয়কে প্রশ্রয় দেন কিংবা ওনাদের আসলে কিছুই করার নেই?
এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলেও আবার সমস্যা। কারণ তাঁরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাঁদের নিজেদের। তাই এসব নিয়ে কেবল তাঁরাই ভাববেন। গোল্লায় গেলেও তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় যাচ্ছে। অন্যরা কেন তাঁদের নিয়ে কথা বলবে! এই মানসিকতা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের মধ্যেই আছে। শিক্ষকদের এমন মানসিকতা হয়তো ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে চলছে, আর কিছুদিন পর হয়তো মানুষজন ওই পথে আর যেতে চাইবেন না। মা–বাবারা সন্তানদের প্রাইভেটে কিংবা বিদেশে পড়তে পাঠাবেন। কিন্তু যে মা–বাবার টাকা নেই কিংবা যে মা–বাবার সাধ্য নেই সন্তানকে ভালো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিদেশে পড়তে পাঠানোর; তাঁরা তাঁদের সন্তানদের কোথায় পড়তে পাঠাবেন? তাঁদের সন্তানদের তো এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে হবে। কিন্তু পড়তে এসে তাঁদের ভাগ্য যদি বুয়েটের আবরার কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রের মতো হয়; তাহলে মা–বাবারা তাঁদের সন্তানদের কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাবেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্তাব্যক্তিদের এই দায় নিতেই হবে। তাঁদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এর জবাবদিহি করতে হবে। ওনারা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় ওনাদের নিজেদের সম্পত্তি। ওনারা ভুলতে বসেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় ওনাদের নয়। বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের সম্পত্তি। কারণ, তাঁদের ট্যাক্সের টাকায়ই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তাই তাঁদের সব কাজের সমালোচনা করার অধিকার যেমন দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আছে, ঠিক তেমনি একজন রিকশাওয়ালা কিংবা শ্রমিকেরও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কিন্তু এদের কাছেও দায়বদ্ধ। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস করার যে সুপরিকল্পিত নীলনকশা শুরু হয়েছে; এর দায় আর কাউকে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদেরই নিতে হবে।
ড. আমিনুল ইসলাম সিনিয়র লেকচারার, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ এস্তনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি।
ই-মেইলঃ [email protected]