সিরিয়ার পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে এসেছিল। কিন্তু এখন আবার দেশটি বড় ধরনের সহিংসতার মুখে পড়ে গেছে।
উত্তরের বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর নতুন আক্রমণ এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশটিতে বড় সংঘাত শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু সিরিয়ার মানুষের আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ সহ্য করার অবস্থায় নেই।
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার যুদ্ধে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ মরেছে। ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ ভিটাছাড়া হয়েছে।
২০২০ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির কারণে চার বছর ধরে সংঘাত কিছুটা থেমে ছিল। কিন্তু বিদ্রোহীদের আকস্মিক আক্রমণ এ সংঘর্ষকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।
গত ১৩ বছরের মতো এবারও সহিংসতার সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হবে সাধারণ মানুষ। ইতিমধ্যে হাজারো মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কারণে অনেক কুর্দি আলেপ্পো ছেড়ে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পালিয়ে গেছে।
সংঘাত বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ, সরকারি বাহিনী কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ত পরিবর্তনশীল ও অপ্রত্যাশিত। সবাই আশঙ্কা করছে, বাশার আল–আসাদ সরকার ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক নীতি গ্রহণ করতে পারে। অথবা পুরো সিরিয়ায় হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) শাসন কায়েম হতে পারে। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে। এর ফলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হতে পারে। আরও লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং শহর-বন্দর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় দ্রুত পরিবর্তনগুলো মূলত যুদ্ধের ময়দানে ঘটছে। তবে কূটনীতি ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সুযোগ আছে।
কাতারে দোহার ফোরামের সম্মেলনে একটি উচ্চপর্যায়ের সাইডলাইন বৈঠক হতে পারে। যেখানে তুরস্ক, ইরান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলো অংশ নিতে পারে। এ বৈঠক সিরিয়া নিয়ে একাধিক স্তরের কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করার সুযোগ করে দিতে পারে।
কাতার অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন লিবিয়ায় তারা এক পক্ষের সমর্থক হয়েও দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চালানোর চেষ্টা করেছে। সিরিয়ায়ও এমন উদ্যোগ প্রয়োজন। কারণ, সাধারণ মানুষের জন্য পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
সেখানে নেতারা যখন মিলিত হবেন, তখন মানবিক কূটনীতি ও মধ্যস্থতার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা উচিত।
যেকোনো আলোচনায় সাধারণ মানুষের সুরক্ষা সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। যদিও এইচটিএস বিতর্কিত ও চরমপন্থী সংগঠন, তবু তারা কিছু ক্ষেত্রে যুদ্ধের নিয়ম অনুসরণের চেষ্টা করেছে (যেমন হামলা শুরুর আগে সতর্কতা দেওয়া)। তবে এ ধরনের প্রচেষ্টা সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয় এবং এইচটিএস সাধারণত মানবিক কূটনীতি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করে না।
তবু ভালো, তারা এখন সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে এবং রক্তক্ষয় কমাতে অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করছে।
এটি এইচটিএস ও আসাদ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এমনকি খুব কম পরিমাণে হলেও যোগাযোগ দরকার, যাতে তারা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং যুদ্ধের নিয়ম মেনে চলে।
এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্ষতি কমানো, মানবিক সহায়তা আনা–নেওয়ার পথ বিপদ–মুক্ত রাখা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মৌলিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যোগাযোগ না হলে সহিংসতা আরও বেড়ে যেতে পারে।
যদিও পূর্ণাঙ্গ মধ্যস্থতার জন্য অনেক দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন; তবে প্রথমে সাধারণ মানুষের সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে মানবিক সংকট সমাধান করা সম্ভব হবে।
একই সময়ে বড় মৌলিক সমস্যা সমাধানের জন্য বহুপক্ষীয় মধ্যস্থতা প্রয়োজন। তবে তুরস্ক ও রাশিয়ার নেতৃত্বে ‘আসতানা প্রক্রিয়া’ (‘আসতানা প্রসেস’ হলো সিরিয়ার সংকট সমাধানের জন্য তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের শুরু করা একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ। ২০১৭ সালে কাজাখস্তানের রাজধানী আসতানায় প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এটি এই নামে পরিচিত) এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত মনে হচ্ছে না।
সমস্যা হলো এই দুই মধ্যস্থতাকারী দেশ সংঘাতে গভীরভাবে জড়িত। ফলে তাদের কার্যকরভাবে সহিংসতা কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এর পাশাপাশি আসতানা প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে (যদিও এটি কয়েক বছর ধরে শুধু কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল)।
এদিকে তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া আঞ্চলিক এবং ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি অনুযায়ী তাদের কৌশলগুলো পুনর্বিবেচনা করেছে। এই পরিবর্তিত পরিবেশ বহুপক্ষীয় মধ্যস্থতার জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ—দুটিই তৈরি করেছে।
এ অঞ্চলে কোনো একক পক্ষ পুরোপুরি নিরপেক্ষ হওয়ার দাবি করতে পারে না। তবু সিরিয়ার চলমান সংঘাত এমন এক বহুপক্ষীয় মধ্যস্থতার দাবি রাখে, যা বিভিন্ন তৃতীয় পক্ষের বিশেষ সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার প্রধান গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এবং তুরস্ক, ইরান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
কাতার অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন লিবিয়ায় তারা এক পক্ষের সমর্থক হয়েও দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চালানোর চেষ্টা করেছে। সিরিয়ায়ও এমন উদ্যোগ প্রয়োজন। কারণ, সাধারণ মানুষের জন্য পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
এই মধ্যস্থতাকে প্রথমে সাধারণ মানুষের সুরক্ষা এবং সহিংসতা কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে, যাতে আরও ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি না ঘটে।
একটি প্রাচীন কথা রয়েছে, ‘রোগ প্রতিরোধ করা চিকিৎসার চেয়ে ভালো।’ সিরিয়া ইস্যুতে এই নীতিতে হাঁটতে হবে। কারণ, সিরিয়ার মানুষ আর এক দশক সহিংসতা সহ্য করতে পারবে না।
● স্যানসম মিল্টন কাতারের দোহার কনফ্লিক্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ