বেশ কিছুদিন ধরেই ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ আর ‘সাংস্কৃতিক দৈন্য’ নিয়ে তর্ক চলছে। এরই মধ্যে আসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নির্দেশনা: বাংলা নববর্ষের দিনে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবশ্যিকভাবে শোভাযাত্রা বের করতে হবে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এভাবে নিজের গতিতে সংস্কৃতিকে আর চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। ‘সংস্কৃতি’ নামক দেহকাঠামোর পরতে পরতে ক্ষত তৈরি হয়েছে; সেখানে ‘শোভাযাত্রা’ নামক মলমের খানিক প্রলেপ না দিলেই নয়! তা ছাড়া আজকের শিশুরাই আগামী দিনের সংস্কৃতির ধারক। অতএব, রুচিকে ফেরাতে আর সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে তাদের কিছু কাজ করতে বাধ্য করা যেতেই পারে!
মজার ব্যাপার হলো, মাউশি তাদের নির্দেশনায় শুধু শোভাযাত্রা বের করা বা নববর্ষ উদ্যাপনের মধ্যে দিনটিকে সীমিত রাখেনি। এদিন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার নির্দেশনাও দেয়। বলে, নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ের মূল্যায়নের কাজটিও করতে হবে। সামনে প্রতিটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে। তার মানে, তখন সব শিক্ষার্থীর মূল্যায়নে দিনটির কার্যক্রমকে অনুপুঙ্খভাবে নজরদারি করতে হবে। ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকে শোভাযাত্রা বের করার কোনো কাজ না থাকলেও কোন বিবেচনায় দেশের সব বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে শোভাযাত্রা বের করার নির্দেশনা দেওয়া হলো, সেটি অনেকের বোধগম্য নয়।
নতুন শিক্ষাক্রমের একটি লক্ষ্য: শিক্ষার প্রয়োগকে বাস্তব জীবনমুখী করা। সেদিক থেকে মনে হতে পারে, মাউশির উদ্যোগটি দারুণ। মাউশি এ নির্দেশনা পেয়েছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে। নির্দেশনায় শোভাযাত্রা বের করার পেছনে একটি যুক্তিও দাঁড় করা হয়েছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেসকোর গুরুত্বপূর্ণ ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজে’র অংশ; একে গুরুত্বসহকারে প্রচার করতে হবে।
এখন প্রশ্ন, কোনো মন্ত্রণালয়ের আদেশে এভাবে উৎসব উদ্যাপনের বা প্রচার-প্রচারণার বাধ্যবাধকতা তৈরি করা যায় কি না? ইউনেসকো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এটি শিক্ষার্থীদের জানানো আর বাধ্যতামূলকভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা করানো এক বিষয় নয়।
আমাদের মনে রাখা দরকার, কোন সময়ে কোন প্রেক্ষাপটে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল। গত শতকের আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়। বাক্স্বাধীনতা যখন সীমিত থাকে, তখন প্রকাশ ও প্রতিবাদের ভিন্নতর উপায় খুঁজে নেন শিল্পীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা এমনই এক পরিপ্রেক্ষিতে।
স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষ এ নির্দেশনায় বিস্মিত। একজন ক্ষুব্ধ ব্যক্তি মাউশির পত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন। ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে প্রবল সমালোচনার ঝড় ওঠে। অগত্যা মাউশি পূর্বের নির্দেশনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
নতুন নির্দেশনায় বলা হয়: ‘রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করে ও ধর্মীয় অনুভূতি বজায় রেখে” সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে “নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়” “যথাযথ আড়ম্বরে” বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে হবে।’ এই নতুন নির্দেশের ফলে আরেকটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এটি দেখে মনে হচ্ছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা সরাসরি ধর্মীয় অনুভূতির পরিপন্থী। আগে রেখেঢেকে এমন কথা কেউ কেউ প্রচার করেছেন, এখন মাউশির বিবৃতি তা আরও ‘সত্য’ করে তুলল। তাই পরের বছরগুলোতে যখন নববর্ষের প্রথম দিনে রমজান থাকবে না, তখন শোভাযাত্রা করার ব্যাপারে এই যুক্তিতে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী বাধা দিতেই পারে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, কোন সময়ে কোন প্রেক্ষাপটে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল। গত শতকের আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়। বাক্স্বাধীনতা যখন সীমিত থাকে, তখন প্রকাশ ও প্রতিবাদের ভিন্নতর উপায় খুঁজে নেন শিল্পীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা এমনই এক পরিপ্রেক্ষিতে।
বাংলাদেশে ষাটের দশকে পাকিস্তান শাসনামলেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূত্রে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিহ্ন’ হিসেবে রবীন্দ্রসংগীতকে গ্রহণ করা হয়েছিল। পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শিল্পকলার আন্দোলন ঘটেছে প্রতিবাদের স্মারক হিসেবে।
এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা কিংবা ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’—এ ধরনের গান গাওয়ানোর বাধ্যবাধকতা দেখে মনে হয়, রাষ্ট্র স্বাভাবিক নেই। কিংবা সংস্কৃতি–সম্পর্কিত ধারণায় গলদ আছে। হর্তাকর্তা ব্যক্তিরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন না রাষ্ট্রের মেরামত দরকার। তাহলে কোন যুক্তিতে দুটি স্বৈরাচারবিরোধী প্রতীক আন্দোলনকে আবশ্যিকভাবে বিদ্যালয়ের নববর্ষ উদ্যাপনের সঙ্গে যোগ করা হলো? এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণকে বিবেচনায় নিতে হয়। তাঁদের হয়তো ধারণা হয়েছে, নতুন বছরের প্রথম দিনে এসব উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতির গুণগত মান বাড়বে, নিদেনপক্ষে আগামী প্রজন্মকে সংস্কৃতি-সচেতন করে তোলা যাবে।
এটি সহজেই বোধগম্য, সংস্কৃতি একদিনের আচরণীয় উৎসবের মধ্যে প্রতিফলিত হয় না। তা ছাড়া মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা বা রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনার সঙ্গে সম্পর্ক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। আর সংস্কৃতি নিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রভাববিস্তার করার কাজটিও জটিল। কারণ, সংস্কৃতির ধারণাটি যতটুকু না অবয়বগত বা বাইরের, তার চেয়ে বেশি বিমূর্ত বা ভেতরের। অঞ্চলবিশেষের মানুষের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় তাদের দীর্ঘদিনের জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে। পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, উৎসব-অনুষ্ঠান—এসবের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির বাইরের চেহারাটি ফুটে ওঠে। আর সংস্কৃতির ভেতরের রূপটি লুকিয়ে থাকে মানুষের চিন্তা-চেতনায়, আচর-আচরণে, অভিব্যক্তিতে। সংস্কৃতির অবয়বগত রূপ বা বহিরঙ্গের পরিবর্তন নিয়ে আমরা যতটুকু ব্যাকুল, এর অন্তরঙ্গের বা ভেতরকার ক্ষয় নিয়ে ততটাই উদাসীন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই সম্মিলিত জীবনধারায় সংস্কৃতির বদল ঘটে। এটি ঘটে অনায়াসে, সময়ের প্রাকৃতিক গতিপ্রবাহে। বদলে যাওয়া সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের আচরণের মধ্যে। একে প্রভাবিত করতে চাইলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সহনশীলতা দরকার এবং বহু মত ও পথকে স্বীকার করে নিতে হয়। সংস্কৃতি গড়ে ওঠে সমাজে। একটি ক্ষুদ্র সমাজেও বহু সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকতে পারে। রাষ্ট্র যদি তা অস্বীকার করে নিজের তত্ত্বাবধানে বা পৃষ্ঠপোষকতায় একক সংস্কৃতির প্রতিপালন করতে চায়, তবে তা হিতে বিপরীত ও সাংঘর্ষিক হতে পারে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ‘সাধারণীকরণ’ করে ফেলা হলে বহু সংস্কৃতির বিকাশেও তা বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
শেষে আরেকটি কথা। মাউশি তো এবারের মতো তাদের সিদ্ধান্তে নমনীয়তা দেখাল। পরের বছর নববর্ষ উদ্যাপনের সময় সিদ্ধান্তটি কেমন রূপে দেখা দেবে, সেটি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে এখন। যদি এরপরেও আবশ্যিকভাবে ‘যথাযথ আড়ম্বরে’ বিদ্যালয়গুলোতে নববর্ষ উদ্যাপন করতেই হয়, তবে সেই অর্থের জোগান কোথা থেকে হবে, তারও নির্দেশনা থাকা দরকার।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।