স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে নেতৃত্ব দেয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। বাংলাদেশে বৈষম্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আয়বৈষম্য। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের যে প্রাথমিক ফলাফলে বাংলাদেশের জনগণের আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগের মান নির্ধারিত হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৯৯। এই হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে।
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়ার সফল সমাপ্তি হলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ পর্যায় থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ’-এ উত্তীর্ণ হয়েছিল।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০-২২ অর্থবছরে করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। তবু তা ৫ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৮। ২০২০ সালে আইএমএফ ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে বেশি হয়েছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি। জিডিপি, জিএনআই প্রবৃদ্ধিসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক দুই দশক ধরে জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে।
কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি একটি গড় সূচক। মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে আয়বৈষম্যও বাড়তে থাকা ইতিবাচক নয়। এর মানে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা শক্তিশালী হওয়া। ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে।
আয় ও সম্পদবৈষম্য বাড়তে বাড়তে বাংলাদেশ এখন একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮–তে একটি তথ্য পাওয়া যায়। ২০১২ থেকে ২০১৭—এই ৫ বছরে অতিধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে ১ নম্বর স্থান দখল করেছিল বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। প্রতিবেদনে তিন কোটি ডলারের (প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা) বেশি নিট সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিকে ‘আলট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ’ ব্যক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সরকার ক্রোনি ক্যাপিটালিজম প্রতিষ্ঠাকে এই রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে দাঁড় করায়। আশির দশকে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ‘কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচি’ ‘নিউ লিবারেল’ নীতিমালা সংস্কারের ধারাবাহিকতাকে জোরদার করার জন্যই পরিচালিত হয়েছিল।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনগুলোর মূল মনোযোগের কেন্দ্র ছিল আমদানি উদারীকরণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ, ব্যক্তি খাতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস ও অর্থনীতিতে সরকারি ভূমিকার সংকোচন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ। ১৯৯১ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে এ দেশে গত ৩৩ বছরের মধ্যে ৩১ বছর সরকারে আসীন ছিল। এই সময়ে দেশে আয়বৈষম্য নিরসনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে নামকাওয়াস্তে সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে নীরবতা পালনকেই নিরাপদ মনে করেছে।
আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। সাধারণ জনগণের কাছে তা এখন বোধগম্য। আর মানুষ যেসব বিষয় থেকে তা অনুভব করতে পারছে, সেগুলো হলো: ১. দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মা-বাবার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২. দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩. দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারীকরণ হয়ে গেছে; ৪. ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে ও ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫. দেশের জায়গাজমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৬. বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৭. ঢাকা মহানগরীতে জনসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী; ৮. দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯. বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশভ্রমণ বাড়ছে; ১১. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫. দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে। আবার অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের সন্তানদের জন্য মাদ্রাসা গড়ে তোলা হচ্ছে; ১৬. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে এবং ১৭. দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচের জনসংখ্যার হার ২৪ দশমিক ৫ পাওয়া গিয়েছিল, ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে তা ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচের জনসংখ্যার এই ক্রমহ্রাসমান হার প্রশংসনীয় হলেও আয়বৈষম্য বৃদ্ধিকে অশনিসংকেত বিবেচনা করতেই হবে। কিন্তু হাসিনার সরকার শুধু মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েই মাতামাতি করত। সুতরাং আয়বৈষম্যের ব্যাপারে হাসিনার সরকারের দুঃখজনক অমনোযোগ আমার কাছে বরাবরই অগ্রহণযোগ্য ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বলছি, বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি মডেল’। এই মডেলের মূলকথা হলো, আয়বৈষম্য নিরসনকারী অবস্থান গ্রহণ করলে কোনো দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে যে ধারণা সাইমন কুজনেৎস অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্বে চালু করেছিলেন, সেটা একটা ‘ভুল ধারণা’।
পুঁজিবাদের পক্ষে তাঁর অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে কুজনেৎস এই তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। এই তত্ত্বে তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভিন্ন দেশ ও সেগুলোর উন্নয়নপথের সময়কে সুপরিকল্পিতভাবে বাছাই করেছিলেন। তাঁর তত্ত্ব মানবজাতির বড় ধরনের ক্ষতি করেছে।
গত ছয় দশকের অনেকগুলো আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণা ওই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছে, যার মধ্যে বাঙালি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণাপ্রাপ্ত ফলাফলও অন্যতম। এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হচ্ছে, যেসব দেশ আয়বৈষম্য বাড়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বৈষম্য নিরসনে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে বৈষম্যবিরোধী অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন করছে, সেসব দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমার পরিবর্তে বেড়ে যাচ্ছে। চীন, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি মডেলের’ সফল কয়েকটি উদাহরণ। এই মডেল অনুসরণ করতে আমাদের বাধা কোথায়?
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক