ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা যায় হারমানপ্রীত শব্দের অর্থ ঈশ্বরের হৃদয় থেকে আসা ভালোবাসা। কী প্রশান্তিময় একটি নাম। তবে হারমানপ্রীতের নামের কৌর অংশটাই এক অর্থে বেশি আকর্ষণীয়। প্রথাগতভাবে, শিখ নারীদের পদবি হয় কৌর। কৌর পদবিটি এক হিসেবে অনন্য—শিখ নারীদের আত্মপরিচয় ও নারীসত্তার প্রতীক।
ভারতবর্ষের আরও বহু জাতির মতো শিখ নারীরা বিয়ের পরে নিজের নাম পরিবর্তন করেন না। হারমানপ্রীত কৌর সেই গর্বিত ধারার বাহক। যোগ্য বাহকও বলা চলে।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ক্রিকেটের যে জাতীয় দল, তার অধিনায়ক তিনি। যেই ভারতে ক্রিকেটারদের দেবতাজ্ঞানে পূজা করা হয়, হারমানপ্রীত সেই দেশের কোটি কোটি নারীর কাছে রোল মডেল।
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের বড়াই করলেও ভারতে নারীদের অবস্থা বেশ করুণ। প্রকট বৈষম্যের শিকার নারীরা নিগৃহীত হন ঘরে-বাইরে। রাজনীতি, সমাজ কিংবা ধর্মীয় সহিংসতায় নারীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এই তো, অল্প কিছুদিন আগেই মণিপুরে নারীদের সঙ্গে নির্মম, চূড়ান্ত রকম অসভ্য আচরণ করা হলো। যার প্রতিবাদে ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশের মানবতাবাদীরাই প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। প্রায় কোনো কিছুতেই সে দেশের নারীরা সমান অধিকার পান না, এখনো লড়ে যেতে হয় প্রায় প্রতিটি পদে পদে, কেবল প্রাপ্য অধিকার আদায়ে।
ফলে হারমানপ্রীতের ভূমিকা কেবল মাঠে নয়, অনেকটাই মাঠের বাইরে। বলা হতো, ভারতে ক্রিকেট-দেবতা হয়ে ওঠা শচীন টেন্ডুলকার শতকোটি লোকের প্রত্যাশার ভার নিয়ে মাঠে নামতেন। হারমানপ্রীত তো সম্ভবত এর চেয়েও বেশি দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামেন।
কেন তা বলছি। এক বিখ্যাত নারী বিজ্ঞানী এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন, একবার এক প্রান্তিক এলাকায় তিনি কাজ করতে গেলে এক স্কুলপড়ুয়া মেয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আপু আমি আপনার মতো হতে চাই।’ সেই বিজ্ঞানী ঘটনাটাকে বারবার উল্লেখ করেন তাঁর প্রেরণা হিসেবে।
হারমানপ্রীতরা যখন খেলতে নামেন, তখন কেবল ভারতের নমশূদ্র কোনো মেয়ে, অশান্ত কাশ্মীরের কোনো স্বপ্নালু কিশোরী কিংবা কলকাতা বা মুম্বাইয়ের কোনো আধুনিকাই অনুপ্রাণিত হন, তা নয়, এমনকি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া মেয়েরা পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ হয়। সেই হিসেবে হারমানপ্রীতদের দায় শচীন আর কোহলিদের চেয়েও অনেক বেশি।
কী করেছিলেন হারমানপ্রীত? যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য সংক্ষেপে বলা যাক।
ধারেভারে অনেক দুর্বল দল বাংলাদেশের সঙ্গে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজটা কোনোমতে ২-১ ম্যাচে জেতার পর ওয়ানডে সিরিজটার প্রথম ম্যাচ হারল ভারত। দ্বিতীয়টা জেতার পর তৃতীয় ম্যাচটা হলো সিরিজ নির্ধারণী। সে ম্যাচে ফারজানা হক প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করলেও ভারত লক্ষ্যের দিকে ভালোই এগোচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে তারা খেই হারায়।
হারমানপ্রীত আউট হলে ভারত একটু বিপদে পড়ে। আর সেই আউটটাই মানতে পারেন না তিনি। প্রবল রাগে ব্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে স্টাম্প ভাঙেন। আম্পায়ারকে কটুকথা বলেন। শেষতক ম্যাচটা টাই হয়, আর এরপরেই হারমানপ্রীত ঘটাতে থাকেন একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনা।
স্টাম্প ভাঙার মতো ব্যাপার ক্রিকেটে শাস্তিযোগ্য হলেও অনেকেই মানেন সবার রাগ সমান না। এই হারমানপ্রীতকেই আমরা দেখেছিলাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বোকার মতো রানআউট হয়ে নিজের বিরুদ্ধে প্রবল রাগে ব্যাট ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্যাভিলিয়নের দিকে যেতে। আরেকবার নিজের এক সহখেলোয়াড়ের সঙ্গে অতি ক্রুদ্ধ আচরণ করেন এক রানআউটের ঘটনায়। সত্যি বলতে কি, ‘হিট অব দ্য মোমেন্টের’ ব্যাপারটা অনেকেই ভাবেন কেবলই ‘জয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষার’ থেকে আসা প্যাশন। মাইকেল হোল্ডিং আর সাকিব আল হাসানের লাথি দিয়ে স্টাম্প ভেঙে ফেলাকে অনেকেই ‘রোমান্টিক হিসেবেই’ দেখেন।
ফলে স্টাম্প ভাঙার জন্য ম্যাচ ফির ৫০ শতাংশ জরিমানা হলেও হারমানপ্রীত যদি অতটুকুতে থামতেন, তবে তা তেমন ‘বড় ঘটনা’ হতো না। এমনকি পুরস্কার বিতরণীর সময় আম্পায়ারকে কটাক্ষ করাটাও হয়তো উপেক্ষা করা যেত। যদিও এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশই এখন পরোক্ষভাবে বলেন, আপনারা তো দেখেছেনই আমি আর কী বলব! ঠিক একদিন আগেই যেমনটা বলেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, এমার্জিং এশিয়া কাপের সেমিফাইনালে ভারতের কাছে হারার পর প্রশ্নবিদ্ধ আম্পায়ারিংয়ের জবাবে।
ভারতে ক্রিকেট এখন রাজনীতির অংশ, বিপুল করপোরেট পুঁজির লাভ নিশ্চিত করতে হওয়া ক্রিকেট কেবল ‘খেলা’ না। ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েলের ভাষায়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভারতের কাছে ‘ওয়ার মাইনাস শুটিং’ তথা গোলা-গুলিবিহীন যুদ্ধ। ফলে এখানকার সৈনিকেরা অসহায় দাবা বোর্ডের ঘুঁটির মতো। এই সৈনিকদের সব সময় যুদ্ধংদেহী করে রাখা হয়। বিকট জিঘাংসাকে উদ্যাপন করা হয়।
হারমানপ্রীত সীমা ছাড়ালেন যখন তিনি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ছবি তোলার সময় বললেন, তোমরা একা কেন? আম্পায়ারদেরও সঙ্গে নিয়ে এসো। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অনবরত এতটাই অপমান করলেন, অধিনায়ক নিগার সুলতানা বাধ্য হলেন সেখান থেকে চলে আসতে!
হায় প্রিয় হারমানপ্রীত! আপনি কাদের সঙ্গে এই আচরণ করলেন! নিগাররা তো আপনাকে রোল মডেল মানে। আপনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়। স্বপ্ন দেখে একদিন আপনার মতো নামডাক হবে, বিশ্বজুড়ে লিগগুলোয় খেলে যশ হবে।
সেই নিগার, যিনি এ রকম অবিশ্বাস্য সিরিজ খেলার পর বলেন যে আমাদের যে লোকে এখন একটু-আধটু চেনে এই আমাদের পাওয়া। ক্রিকেট-উন্মাদনার দেশে নিগারদের খেলায় দর্শক হয় না, টেলিভিশনে দেখায় না, এমনকি মাঠে পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড দেখা যায় না। নিশ্চিতভাবেই ‘হারমান দিদিদের’ সঙ্গে মিরপুরের মাঠে প্রথমবারের মতো খেলবেন বলে তাঁরা বহুদিন ধরে স্বপ্ন দেখছিলেন।
কিংবা ধরা যাক নীলফামারীর মেয়ে মারুফার কথা। অতি অল্পদিনেই দারুণ খ্যাতি পাওয়া এই দারুণ পেসার এখন প্রায়ই খবরের শিরোনাম হন। কিন্তু মারুফার মা চান না মেয়ে ক্রিকেট খেলুক। জাতীয় পুরুষ দলের কোনো খেলোয়াড়ের জন্য যা অবিশ্বাস্য। এ রকম নানা প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা নিগার, মারুফা, ফারজানাদের অশ্রদ্ধা করে আদতে আপনি নিজেকেই ধসিয়ে দিলেন প্রিয় ‘হারমান’।
এমনকি যুদ্ধেও নিয়ম হচ্ছে প্রতিপক্ষকে সম্মান দিতে হয়, চরমভাবে হারানোর পরও। সেই ন্যূনতম বোধটাও আপনি হারিয়েছিলেন। তবে আপনার এই বোধ হারানোর কারণটা বোঝা যায়।
একদিকে জনতুষ্টিবাদ, অন্যদিকে বিপুল সামাজিক আর আর্থিক বৈষম্য থাকলেও ভারতের শাসকেরা ‘শাইনিং ইন্ডিয়ার’ গল্প বলেন। সেই ঝলকানি আর ঝাঁ-চকচকে উন্নয়নের কথা বলে তাঁরা নিজেদের বৈধতা দেন, উত্তেজনা জিইয়ে রাখেন। আর ক্রিকেট সেখানে বড় এক উপাদান। আরও ২ হাজার বছর আগে রোমান শাসকদের ব্রেড অ্যান্ড সার্কাসের মতো।
ভারতে ক্রিকেট এখন রাজনীতির অংশ, বিপুল করপোরেট পুঁজির লাভ নিশ্চিত করতে হওয়া ক্রিকেট কেবল ‘খেলা’ না। ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েলের ভাষায়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভারতের কাছে ‘ওয়ার মাইনাস শুটিং’ তথা গোলা-গুলিবিহীন যুদ্ধ। ফলে এখানকার সৈনিকেরা অসহায় দাবা বোর্ডের ঘুঁটির মতো। এই সৈনিকদের সব সময় যুদ্ধংদেহী করে রাখা হয়। বিকট জিঘাংসাকে উদ্যাপন করা হয়।
এমন একটি পরিস্থিতিতে হারমানপ্রীতদের সাধারণ বোধবুদ্ধি লোপ পায়।দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি ভুলে যান, করপোরেট পুঁজি আর শাসকগোষ্ঠীর ঘুঁটির চেয়ে তিনি অনেক বড় কিছু পারেন। আন্তর্জাতিক খেলার একটা বড় উদ্দেশ্যই ছিল মৈত্রী। এমনকি এখন যে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা লাগিয়ে রাখা হয়েছে, দুই দেশে ক্রিকেট সফর বন্ধ, সেই দুই দেশের ক্রিকেট কিংবদন্তিরা পরস্পরের পরম বন্ধু। বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলতে হয়ে দিনের পর দিন হোটেলের একই কক্ষে থাকতেন গাভাস্কার আর জহির। এমনকি কয়েক বছর আগে ইমরান খান যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হন, সেখানে দাওয়াত পান ভারতে নভজোৎ সিং সিধু।
হারমানপ্রীত সেসব গর্বিত পূর্বসূরিকে অনুসরণ করতে ব্যর্থ হলেন। নিগারদের অবিশ্বাস্য লড়াই দেখে যার সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা, যিনি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করার কথা তিনিই কদর্য আচরণ করলেন।
হারমানপ্রীত সেই শাসকগোষ্ঠীর জ্বালানো আগুনেই আবার ঘি ঢাললেন। কোটি কোটি নারীর রোল মডেল হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেন। এ অঞ্চলের কিশোরীদের স্বপ্নযাত্রার সারথি না হয়ে তা আরও কঠিন করে তুললেন।
আপনি অনেক বড় ক্ষতি করে ফেললেন, প্রিয় হারমানপ্রীত।
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক