বৈষম্য ব্যাপারটা আসলে কী

ছাত্র-জনতা বৈষম্যবিরোধী একটা আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে পেরেছে। মুক্তি এত সহজে আসেনি। এর জন্য শত শত মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে। হাজারো মানুষ এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এসেছে মুক্তি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে বৈষম্যবিরোধী একটা আন্দোলন হলো, এর ফলে মুক্তিও এল, কিন্তু এই বৈষম্য ব্যাপারটা আসলে কী?

এই আন্দোলন যখন সফল হওয়ার পর এক রাতে গিয়েছি ঢাকার জাহাঙ্গীর গেটের একটা রেস্তোরাঁয়। এই এলাকাটা ঢাকার পশ এলাকাগুলোর মধ্যেই পড়ে। রাতের খাবার শেষ করে হেঁটেই বাসায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শাহীন কলেজের ঠিক সামনে একটা পদচারি সেতু আছে। সেতু পার হয়ে শাহীনবাগের গলি দিয়ে নাখালপাড়ায় নিজের বাসায় যেতে হবে।

রাত তখন প্রায় ১১টা বেজে গেছে। দেখি ওভারব্রিজের ওপর ৩০–৩৫ বছরের একটা মানুষ শুয়ে আছে। নড়াচড়া করছে দেখে বুঝতে পারলাম, লোকটি এখনো ঘুমাননি। আরেকটু সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি এখানেই ঘুমাবেন রাতে?’

তিনি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রতিদিন কি এখানেই ঘুমান?’ এবার তিনি বললেন, ‘না, যেই দিন যেখানে সুযোগ পাই।’ বুঝতে পারলাম, তাঁর থাকার কোনো জায়গায় নেই।

বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, আমি তো বাসায় ফিরছি। কিন্তু এই মানুষটার কিনা একটা থাকার জায়গাও নেই! এটি আমার কাছে একধরনের বৈষম্য।

দেশের সব মানুষের যেন একটা বাসস্থান থাকে। দিন শেষে তাঁরা যেন সেখানে ফিরতে পারেন। তাঁদের যেন খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতে না হয়। কোনো নরম বিছানার দরকার নেই। দরকার নেই কোনো বিলাসবহুল বাসস্থানের। স্রেফ একটা থাকার জায়গা যেন থাকে।

কারণ, এটি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর একটি। দেশের শেষ মানুষটাও যেন তাঁর মৌলিক চাহিদাটুকু পূরণ করতে পারেন।

এক দুপুরে গিয়েছি এলাকার একটা হোটেলে খেতে। বাসায় রান্না হয়নি। তাই সবাই মিলে গেলাম এলাকার খুব সাধারণ মানের একটা হোটেলে। সবাই মিলে খাচ্ছি। হোটেলের ঠিক বাইরে দুটি বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে বলছে, ‘সকাল থাইকা কিছু খাই না। কিছু দেবেন?’

১০–১২ বছর বয়সী বাচ্চাকে কেন খাবারের জন্য হাত পাততে হবে? হোটেলে সবাই আয়েশ করে খাচ্ছে। সেই হোটেলেরই বাইরে দুটি বাচ্চা ছেলেকে কিনা স্রেফ নিজেদের পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। আমার কাছে এটাও বৈষম্য।

কারণ, বেঁচে থাকার জন্য যে খাদ্যের প্রয়োজন; সেই খাদ্য হচ্ছে একটা মানুষের মৌলিক চাহিদা। দেশের শেষ মানুষটাও যেন তিনবেলা খেয়েপরে থাকতে পারে। ফাইভ স্টার হোটেলের খাবারের দরকার নেই। দরকার নেই পোলাও, মাংস কিংবা বিরিয়ানি। অন্তত দুই বেলা দুমুঠো ভাত যেন পায়।

ভাগনির বিয়ে ছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফিরতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় প্রায় রাত ১২টা। ফার্মগেট থেকে রিকশা নিয়ে নাখালপাড়ায় যাচ্ছি। রিকশাওয়ালা সামনে থেকে বললেন, ‘কয়েক দিন ধইরা শরিল খুব খারাপ। এই গরমের মাঝে দিনের বেলায় গাড়ি চালাই না। রাইতে বেলাতেই চালাই।’

আমি পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাক্তার দেখান নাই?’ তিনি বললেন, ‘গরিব মাইনসের আবার ডাক্তার! আল্লাহই ভরসা।’

আমার কাছে এটাও বৈষম্য। কেন তিনি ভাবছেন, গরিব বলে তাঁর চিকিৎসা হবে না? দেশে তো সরকারি মেডিকেল আছে। কেন সেই চিকিৎসা দেশের শেষ মানুষটার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না?

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের নানা ধরনের সিস্টেম চালু আছে। বাংলা, ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যমে, মাদ্রাসা—এমন নানা মাধ্যম আমাদের আছে। একেক মাধ্যমের মান একেক রকম! আবার শহর, গ্রাম কিংবা মফস্‌সলের শিক্ষার মানও ভিন্ন হয় অনেক ক্ষেত্রে। এটাও তো একধরনের বৈষম্য।

অন্তত স্কুলপর্যায়ে সবাই যেন এক রকম মানসম্মত শিক্ষা পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি শিশু যাতে স্কুল পাস করতে পারে, সে দিকেও নজর দিতে হবে।

চাকরিক্ষেত্রে কেউ যদি আলাদা সুবিধা পায়, সেটা যেমন বৈষম্য; ঠিক তেমনি কোনো একটা সরকারি অফিসে কাজের জন্য গেলে পরিচিতির সুবিধা কিংবা আমার বাবা অমুক, চাচা তমুক—এসবের কারণে যদি আলাদা সুবিধা পায়; সেটাও বৈষম্য।

আবার এই যে স্বৈরাচারমুক্ত দেশে দেশ গড়ার জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেই উদ্যোগ নিতে গিয়ে যদি এমন হয়—কেবল একটা গোষ্ঠীই নিজেদের মতো করে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অন্যদের মতামত সেখানে নেওয়া হচ্ছে না। কিংবা অন্যরা মনে করেছে, তাদের মতামত শোনা হচ্ছে না—এটাও একটা বৈষম্য।

মনে রাখতে হবে, পুরো দেশের শত শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে এই মুক্তি। তাই দেশের শেষ মানুষটাও যেন মনে করে—তাঁকে এই সমাজ, এই রাষ্ট্র মূল্যায়ন করছে। তাঁর কথা রাষ্ট্র ভুলে যায়নি। সে যেন ভাবতে শেখে—বিপদে রাষ্ট্রই তাঁর দেখভাল করবে।

আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: [email protected]