অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চাইলে আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

আমাদের সমাজে শারীরিক, লিঙ্গ, নৃতাত্ত্বিক, বৈবাহিক অবস্থানসহ নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন অনেকে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র—সবখানেই এসব বৈষম্য বিরাজ করছে। বৈষম্যমূলক আচরণ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের বড় বাধা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বৈষম্যমূলকের আচরণ আমরা দেখে থাকি। বৈষম্য দূরীকরণে রাষ্ট্র ও সরকার অনেক কিছুই করে থাকে। এরপরও তা যথেষ্ট নয়। সমাজের নানা ক্ষেত্রে কীভাবে বৈষম্য দূর করা যাবে, তা নিয়ে লিখেছেন লায়লা খন্দকার

এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য একটি কোর্সে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে সেশন নিয়েছিলাম। বিষয় কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যহীন আচরণ। শুরুতেই অংশগ্রহণকারীদের অনেকে নিজ জীবনের গল্প বললেন। শৈশব-কৈশোরে গায়ের রং,

উচ্চতা, ওজন ইত্যাদি নিয়ে কটু মন্তব্য শোনা থেকে শুরু নানা ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন।

এই অভিজ্ঞতা কীভাবে তাঁদের মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে, কখনোবা আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে, সেই বিষয়টিও আলোচিত হলো। পরিণত বয়সেও পারিবারিক, সামাজিক এবং কর্মজীবনে এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তা অনেকেই বললেন। এটাই আমাদের সমাজের অনেক মানুষের জীবনের বাস্তবতা। কেউ কেউ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী বা মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে অসংবেদনশীল মন্তব্য হরহামেশাই করেন।

এই হাসিঠাট্টা যে অন্যদের ক্ষতির কারণ হচ্ছে, সে বিষয়ে কি আমরা সচেতন? কারও

সঙ্গে দেখা হলেই বৈবাহিক অবস্থা, সন্তান ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করা এবং নিজের মতামত জানানো

যেন আমাদের সামাজিক আলোচনার অংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গ্রুপগুলোতে নারীবিদ্বেষী কৌতুকের ছড়াছড়ি, যা বাস্তব সমাজেরই প্রতিফলন।

বৈষম্য দূরীকরণে নানা ধরনের আইন ও নীতিমালার প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও আচরণবিধির মাধ্যমে কর্মীদের নির্দেশনা দেয়, কী গ্রহণযোগ্য আর কী করা যাবে না, তা সুনির্দিষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। এসব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য তা যথেষ্ট নয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে নানা ধরনের বৈষম্য চলতেই থাকবে। রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে সাধারণত বর্ণ, লিঙ্গ, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু মানববৈচিত্র্যের আরও অনেক দিক আছে।

ধরা যাক, আপনি চাকরিপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। একজন প্রার্থী কোনো জেলার আঞ্চলিক উচ্চারণে প্রশ্নের উত্তর দিলেন। আপনি কি

তাঁকে প্রমিত উচ্চারণে কথা বলা প্রার্থীর সমান যোগ্য মনে করবেন নাকি কোনো পক্ষপাত থাকবে? সামাজিক অনুষ্ঠানে কারও সঙ্গে পরিচয় হলো। আপনি জানলেন তিনি নিঃসন্তান। আপনি কি তাঁর জীবনটাকে ‘অসম্পূর্ণ’ বলে মনে করে দুঃখ প্রকাশ করবেন?

এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে অন্যদের জীবন নিয়ে পক্ষপাতমূলক ধারণা বৈষম্যের জন্ম দেয়। কৌশিক গাঙ্গুলি পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ছোটদের ছবি’। যাদের উচ্চতা কম (‘বামন’ নামে পরিচিত), তেমন একদল মানুষ নিয়ে কাহিনি। তাদের বেশ কয়েকজন সার্কাসের দলে কাজ করেন। সমাজের অন্য সবার মতোই তাদের প্রাত্যহিক জীবনে সুখ-দুঃখ আছে; তারা নিজেদের মতো করে ভালোই আছেন। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। যখনই তারা কোথাও যাচ্ছেন, রাস্তা থেকে শুরু করে ট্রেন স্টেশন—সবাই তাদের দিকে কেমন একটা করুণার দৃষ্টিতে তাকায়, যা তাদের অস্বস্তিতে ফেলে।

সমাজে ‘স্বাভাবিক’ উচ্চতা নিয়ে একটা মানদণ্ড আছে—যারা তার বাইরে, তারাই বেশির ভাগ মানুষের চোখে ‘অস্বাভাবিক’। কিন্তু এই মানসিকতাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন জুডিথ স্নো—অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ায় যিনি আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘গুণ একটি সাধারণ মানবিক বৈশিষ্ট্য, যা সমাজের সদস্য হওয়ার জন্য আমাদের মৌলিক সামর্থ্যের অংশ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো বিকেলে আপনি একটি দলগত খেলা খেলবেন বলে ঠিক করলেন।

সাতজন খেলোয়াড় প্রয়োজন। ছয়জন আছে। তেমন পরিস্থিতিতে আপনার হয়তো দলের সদস্য এবং পথচারীদের (যারা দর্শক) জন্য সুন্দর কিছু সময় তৈরি করার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সাতজন ছাড়া খেলা সম্ভব নয়। সুতরাং যখন সপ্তম ব্যক্তিটি এল, তখন তার উপস্থিতিই সবার জন্য একটি উপহার। সে যদি ভালো খেলোয়াড় না হয়, তবুও। আমাদের উপস্থিতিই মানবসমাজের জন্য আমাদের মৌলিক অবদান। কারণ, তা অন্য সব সুযোগ ও সম্পর্ক এবং যা কিছু অর্থপূর্ণ, তার ভিত্তি। অস্তিত্বের মতো প্রত্যেকের ভিন্নতা ও মৌলিক বিষয়।’

বৈচিত্র্যই মানবসমাজকে সুন্দর ও শক্তিশালী করে। সবাই এক রকম হলে সবকিছু একঘেয়ে হয়ে যেত। কিন্তু আমরা যে বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তা অন্য কারও না থাকলেই তার ‘সমস্যা’ আছে বলে বিবেচনা করছি। নিজেরা যেমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত, কেউ তেমন না হলেই তাকে সামাজিকভাবে গ্রহণ করতে আমাদের অনীহা, ভাবটা এমন যে সে ‘ভুল’ করছে। কিন্তু একেকজনের চাওয়া-পাওয়া একেক রকম।

‘সুখ’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেন পল ডোলান। তাঁর বই ‘হ্যাপি এভার আফটার’–এ লিখেছেন যে পড়াশোনা, পেশাগত সাফল্য, স্বাস্থ্য, বিয়ে, সন্তান ইত্যাদি নিয়ে সুখী হওয়ার ফর্মুলাবিষয়ক একটা সামাজিক ন্যারেটিভ আছে। সমাজের সংজ্ঞা অনুযায়ী সুখী হওয়া কারও কারও জন্য প্রযোজ্য হলেও সবার ক্ষেত্রে তা কাজ করে না। নানা রকমের সুখী এবং অর্থপূর্ণ জীবন আছে। অন্যদের চোখে সুখী হতে গিয়ে অনেকে ভীষণ অসুখী জীবন কাটায়; এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পেয়ে কীভাবে নিজস্ব প্রত্যাশা অনুযায়ী সুখের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে, তা বইটির উপজীব্য।

কারও জীবন আপনার মতো নয় বলেই যে সে ‘অসুখী’ বা ‘অপূর্ণ’, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। নেতিবাচক আচরণ না করে প্রত্যেকের সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে শিখলে সমাজটা সবার জন্য আরও বাসযোগ্য হবে। আমরা যা করতে পারি, তা হলো অন্যদের সঙ্গে আচরণে সংবেদনশীল হওয়া, নিজেরা অবচেতনে কোনো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছি কি না, সে বিষয়ে সচেতন থাকা এবং প্রত্যেককে নিজের মতো করে ভালো থাকতে দেওয়া।

আমাদের সামনে অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও শারীরিক ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বা জীবনের কোনো দিক নিয়ে কেউ বৈষম্যমূলক আচরণ বা পোস্ট করলে তার প্রতিবাদ করা। নিশ্চুপ থাকলে আমরাও বৈষম্য বাড়াতে সহায়তা করব। আমরা অনেকে যদি এই ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, তাহলেই এর গ্রহণযোগ্যতা কমবে। সমাজে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবে। নিজে রুখে দাঁড়াতে না পারলে, যারা সাহসী হয়ে প্রতিবাদ করছেন, আমরা অন্তত তাদের সমর্থন দিতে পারি।

  • লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী