রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তাঁর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশিকে পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালতের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিষয়টিকে অনেকেই পূর্বনির্ধারিত রায় বলে বর্ণনা করছেন। সাধারণ নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে আদালতের এই রায় দেওয়ার ঘটনা ইতিপূর্বে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের বিচার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের মাধ্যমে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়ার লজ্জাজনক যে ইতিহাস আছে, তারই অংশ হিসেবে ইমরানকে তাঁর পূর্বসূরিদের পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। আলোচিত এই সাইফার মামলায় কারারুদ্ধ শাহ মাহমুদ কুরেশির সঙ্গে তাঁর বিচার চলছিল। পাকিস্তানে এই প্রথম কোনো নেতাকে সরকারি গোপনীয়তা প্রকাশের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হলো।
এই মামলায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ হলো, তিনি তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কূটনৈতিক নথি ব্যবহার করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় গোপন যোগাযোগের বিষয়টির অপব্যবহার করেছেন।
পাকিস্তানের সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি রয়েছে এবং ওয়াশিংটন ও তৎকালীন সেনা নেতৃত্ব ইমরানকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত করতে যাচ্ছে, এমন কিছু নথি ইমরান প্রকাশ করেছিলেন। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যাতে বলা হয়েছিল, বাইরের চক্রান্তে ইমরান খানের সরকারকে উৎখাত করা হতে যাচ্ছে।
সন্দেহ নেই, ইমরান খান ভুলভাবে ওই তারবার্তা ব্যবহার করেছিলেন। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান সরকারকে অপসারণ করার কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি একটি রাজনৈতিক সমাবেশে ওই কথিত নথি হাতে নিয়ে দুলিয়ে দুলিয়ে সমর্থকদের দেখিয়েছিলেন। এটি জনসাধারণের অনুভূতিকে আন্দোলিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইমরানকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেছে, এই ভাষ্য সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেছিলেন এবং ইমরান সমর্থকদের জাগিয়ে তুলেছিলেন।
এটিও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, একসময় ইমরানের পিটিআই সরকারকে যে সামরিক কর্তৃপক্ষ নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছিল, ইমরানের আনা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তাঁকে সেই সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নিয়ে আসে। প্রকৃতপক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে, এই সাজার ঘটনা ভোটারদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতিনিধিত্বকারী তরুণদের ইমরানের প্রতি সহানুভূতিশীল করতে পারে এবং এসব তরুণ পিটিআই নেতাদের একচেটিয়াভাবে ভোট দিতে পারেন। এতে পর্দার আড়ালে থাকা ক্ষমতাধর গোষ্ঠী অন্য দলগুলোকে নিয়ে যে ক্ষমতাবদলের ছক কষেছে, তা ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।
তবে এটিও স্পষ্ট, এই আইনের ৫ ধারায় ইমরানকে অভিযুক্ত করার পেছনে প্রতিশোধস্পৃহা ছিল। কারাগারের অভ্যন্তরে যেভাবে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে, তা ‘অপবিচারের’ অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে। সর্বোপরি নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে যেভাবে রায় ঘোষণা করা হলো, তা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলেছে।
এর আগে গত আগস্টে তোশাখানা মামলায় (তোশাখানা দুর্নীতির আরেক মামলায় বুধবার ইমরান ও তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবির ১৪ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত) তাঁর তিন বছরের জেল হয়, যার কারণে নির্বাচনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তিনি অযোগ্য ঘোষিত হন। এর বাইরে ইমরানের রাজনৈতিক দল পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন দমন–পীড়ন চালিয়ে দলটিকে ভেঙেচুরে ফেলেছে।
এর উদ্দেশ্য ছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী দৌড়ের বাইরে রাখা। নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটকে পিটিআইয়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন নিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টের সেই সিদ্ধান্তকে বহাল রাখা পিটিআইয়ের নির্বাচনী সম্ভাবনাকে সবচেয়ে বড় আঘাত করেছে।
এত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পরও পিটিআই একটি দুর্দমনীয় শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে। প্রশাসনের ‘ম্যানেজ করা’ নির্বাচনেও দলটির প্রতিদ্বন্দ্বীরা অন্যদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। ভোটের আগমুহূর্তে দলটির দুই প্রধান নেতাকে জেল দেওয়ার পেছনে দলের কর্মী-সমর্থকদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা করা হয়ে থাকতে পারে। তবে এতে হিতে বিপরীত হতে পারে এবং ভোটাররা দলটির প্রতি সমব্যথী হয়ে তাঁদের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন।
এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ইমরান–সমর্থকদের বিক্ষোভ–বন্যা সামাল দেওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে মারাত্মক কঠিন হয়ে পড়তে পারে। পাকিস্তানের এ মুহূর্তের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে সাজা দেওয়ার ঘটনা যৌক্তিকভাবেই দেশের পুরো রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে দিতে পারে।
স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে, এই সাজার ঘটনা ভোটারদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতিনিধিত্বকারী তরুণদের ইমরানের প্রতি সহানুভূতিশীল করতে পারে এবং এসব তরুণ পিটিআই নেতাদের একচেটিয়াভাবে ভোট দিতে পারেন। এতে পর্দার আড়ালে থাকা ক্ষমতাধর গোষ্ঠী অন্য দলগুলোকে নিয়ে যে ক্ষমতাবদলের ছক কষেছে, তা ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।
জাহিদ হুসাইন পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত