ইসরায়েলের ছোট্ট এক শহর ওর ইহুদার এক শর্মার দোকানে ঘটনাটি ঘটল। নামে তুর্কি খাবারের রেস্তোরাঁ হলেও কোনো কিছুই তুরস্কের নয়। সাদামাটা ছোট দোকানে খাবারের দামও সস্তা নয়। তবু লোকজনের ভিড় লেগে থাকে প্রবেশমুখে, কাছে ও দূরে থেকে যাঁরা আসেন এখানকার খাবার চাখতে। আমার ছেলে সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার সুবাদে এর সন্ধান পায় একদিন। এর পর থেকে সুযোগ পেলেই এখানে খাওয়া তার একটি পছন্দের কাজ হয়ে যায়।
আর তাই শুক্রবার দুপুরে আমরা রেস্তোরাঁটিতে গিয়ে হাজির হই। তারপরই সেখানে গোলযোগটা বাধে। শুরু হয় উচ্চ স্বরে আমাদের শাপশাপান্ত করার মধ্য দিয়ে, শেষ হয় মারমুখী একদল আমাদের টেবিল ঘিরে ফেলার পর। ‘তোর গলায় যেন খাবার আটকে তুই মারা যাস,’ বলেই অভিশাপ দেওয়া হলো; ‘ওদের এখানে ঢুকে খেতে দিলি কেন?’ বলে দোকানের লোকজনকে ধমকানো হলো; ‘যদি (সিসিটিভি) ক্যামেরা না থাকত, তাহলে আমি তোর নাক-মুখ ফাটিয়ে দিতাম,’ বলে হুমকি দেওয়া হলো।
‘অ্যাই, আপনারা দেখে যান, এখানে কে খেতে এসেছে,’ বলে সেই হুমকিদাতা চিৎকার করে পথচারীদের ডেকে জড়ো করল। লোকজনও আমাদের ঘিরে ধরল এটা দেখতে যে এই শহরে কোনো শয়তান এসেছে। হুমকিদাতা যেভাবে মুঠো পাকিয়ে আমাদের টেবিলের খুব কাছে আস্ফালন করছিল, তাতে একটা বড় গোলযোগ নিশ্চিত। তাই আমরা নীরবে উঠে বেরিয়ে এলাম আর তাদের গালাগালি চলতেই থাকল। ‘যে এই নাৎসির সঙ্গে খাবে, তার মাকে...’ আমার ছেলের উদ্দেশেও অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি বর্ষিত হলো উচ্চ স্বরে।
না, এটা প্রথমবার নয়, শেষবার তো নয়ই, এটা নতুনও নয়। তবে এসব গালাগালি ও হুমকির মধ্যে নতুন যে কথাটা আমি শুনলাম, তা হলো, ‘গাজার বাচ্চাদের জন্য বড় দরদ তোর, তুই তো ব্যাটা নাৎসি একটা।’
ওর ইহুদায় নাৎসিবাদ তাহলে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হলো: নাৎসি হলো সে, যে গাজার শিশুদের প্রতি দরদ দেখায়! গাজা উপত্যকায় অনাহার, অবরোধ, কমতি, ধ্বংসযজ্ঞ, জাতিগত নিধন আর গণহত্যা যখন সারা দুনিয়ার কাছে নাৎসিবাদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে, তখন ইসরায়েলের এই ছোট্ট শহরে ঘটছে ঠিক উল্টোটা।
নাৎসি হলো সেই, যে ভুক্তভোগীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। আর যে গাজার শিশুদের কথা ভাববে, সে এই ওর ইহুদায় খেতে আসতে পারবে না, এমনকি এই শহরের কাছেও ঘেঁষবে না।
গাজায় হামাস-ইসরায়েল চলমান এই যুদ্ধের সময় আমি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম সহিংসতা ও হুমকির মধ্য দিয়ে গিয়েছি। সময়টাতে ‘নেতানিয়াহু, হ্যাঁ বা না’ এবং গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্ত করা নিয়েই আবর্তিত হচ্ছে। এমনকি টেলিভিশনের সবচেয়ে উদারপন্থী অনুষ্ঠানগুলোয়ও বিকল্প মতামত বা যুদ্ধ অপরাধের বিরোধিতাকারীদের কণ্ঠকে ঠাঁই দেওয়া হচ্ছে না। এতে করে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ-মর্মাহত গুটিকয় যে কয়জন আছেন, তাঁরা এখন জনরোষ থেকে নিরাপদে আছেন। কেননা তাঁদের কণ্ঠস্বর থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেকোনো বিতর্কে তাঁদের অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এভাবে কণ্ঠ রোধ করাটা বিপজ্জনক।
আমরা এমন কোনো যুদ্ধ দেখিনি, যার কোনো প্রতিবাদ হয়নি—অন্তত যুদ্ধের চরম ও অপরাধমূলক পর্যায়ে। যুদ্ধগুলো যদিও শুরু হয়েছিল পূর্ণ সমর্থন নিয়ে, এমনকি ইহুদি সম্প্রদায়ের ভেতরে উদ্দীপনা জাগিয়ে। এই সমর্থন ততক্ষণই বজায় ছিল, যতক্ষণ না ফাটল ধরেছে আর প্রশ্ন উঠেছে যুদ্ধের কার্যকারিতা নিয়ে।
১৯৮২ সালের প্রথম লেবানন যুদ্ধ হলো এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। গাজায় ২০০৮ সালে অপারেশন কাস্ট লিড ও ২০১৪ সালে অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজের কথাও বলতে হয়। এসব যুদ্ধাভিযানের একটা পর্যায়ে প্রতিবাদ উঠেছে, যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এখন আর তা নয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইতিহাসের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ সবচেয়ে বড় মতৈক্যের মধ্য দিয়েই চলছে, অন্তত জনপরিসরে এ নিয়ে যে বিতর্ক, সেখানে মতৈক্য প্রবল! প্রতিবাদকারীরা চাচ্ছে জিম্মি মুক্তির জন্য সমঝোতা, বিরোধিতাকারীরা চাচ্ছে যুদ্ধবিরতি, এমনকি যুদ্ধের পরিসমাপ্তি। কিন্তু সবই জিম্মিদের ভালোর জন্য, রণক্ষেত্রে ইসরায়েলি সেনাদের প্রাণহানি ঠেকানোর জন্য। কোনোখানেই গাজার ভুক্তভোগীদের নিয়ে কোনো কথা নেই। যদি কেউ তাদের কথা বলার চেষ্টা করে, তাহলে সে তো একজন নাৎসি!
মগজধোলাই ও অন্ধত্ব এখন এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা আমরা আগে কখনোই জানতাম না। ইসরায়েল এখন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (আইডিএফ) সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়ায় ঐক্যবদ্ধ, এমনকি ৭ অক্টোবরের পর গাজায় যা খুশি তা করার সীমাহীন অধিকার পাওয়া ও যুদ্ধ অপরাধগুলো স্তূপাকার ধারণ করার পরও। এটা তো বলা যেতেই পারে যে ২০২৫ সালের শুরুতে ইসরায়েল যতখানি ঐক্যবদ্ধ, তা অভূতপূর্ব। আর তাই, আমাদের কোনোভাবেই এই নতুন পরিস্থিতিকে হেয় বা খাটো করা চলবে না! বরং এ রকম চেষ্টা যে করবে, সে তো একজন নাৎসি।
অভিশাপ, গালাগালি আর হুমকি মাথায় নিয়ে আমি ও আমার ছেলে যখন গাড়ির কাছে পৌঁছালাম, তখন এক তরুণ বন্ধু আমার কাছে এসে আশীর্বাদ চাইল। তার ধারণা, যে ব্যক্তি অভিশাপ ও হুমকির মুখে পাল্টা জবাব না দিয়ে নীরব থাকে, সে ব্যক্তির কিছু ব্যতিক্রমী গুণ আছে। সে আমাকে বলল, আমি যেন তাকে এই আশীর্বাদ করি যে সে যেন একজন ভালো সহধর্মিণী পায়। আমি তাই করলাম। তাকে সাহায্য করতে পেরে আমি খুশি।
গিডিয়ন লেভি ইসরায়েলি সাংবাদিক ও লেখক। ইসরায়েলের দৈনিক পত্রিকা হারেৎজ থেকে নেওয়া। বাংলায় রূপান্তর করেছেন তানিম আসজাদ।