গত ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দিন দুপুরে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সারা দেশে উত্তাল হতে শুরু করে। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনকে দমন করতে সরকার যখন নাকানিচুবানি খাচ্ছিল, ঠিক তখন সেখানে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)।
অনেকটাই অনধিকার চর্চার মতো ইউজিসি সেই দিন রাতে এক ‘বিজ্ঞপ্তি’র মাধ্যমে সারা দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ত্যাগ করার নির্দেশ জারি করে।
এ আদেশের ফলে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘কার্যত’ বন্ধ হয়ে যায়। হল ত্যাগ করে বাড়িতে ফিরতে পথে পথে শিক্ষার্থীরা হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু ইউজিসি কেন সেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আদেশ দিয়েছিল? আদেশটি আদৌ বৈধ ছিল, নাকি সরকার তাদের আদেশটি প্রদানে বাধ্য করেছিল? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণের এই ‘লিপ্সা’ ক্ষমতাধারীদের সুবিধা দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনব্যবস্থায় এ ধরনের হস্তক্ষেপ সুখের নয়। কেন নয়, তা নিয়ে আলোচনার আগে চলুন দেখে আসি, ইউজিসির সেই ‘ঐতিহাসিক’ আদেশটিতে কী লেখা ছিল?
১৬ জুলাই রাতে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে পাঠানো ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা’ আদেশটি পাঠিয়েছিলেন ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান। তিনি সেখানে বলেছিলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় দেশের সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং, অন্যান্য কলেজসহ সব কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে নিরাপদ আবাসস্থলে অবস্থানের নির্দেশনা প্রদান করা হলো।
অর্থাৎ আদেশটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ সংস্থা তাদের অধ্যাদেশের ঠিক কোথায় পেয়েছিল, তা উল্লেখ না করলেও ফেরদৌস জামান ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়’কে উদ্ধৃত করলেও মন্ত্রণালয় ঠিক কীভাবে ‘সিদ্ধান্ত’টি দিয়েছিল, তা আদেশটিতে উল্লেখ ছিল না। এমনকি আদেশটিতে ইউজিসির চেয়ারম্যানের সম্মতি ছিল কি না, তা–ও উল্লেখ নেই। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ‘ক্ষমতাধর’ সচিব মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে ইউজিসির অধীন আর তাঁরা আদেশ দিয়ে সব বন্ধ করে দিতে পারেন। এমন নজির বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ছিল কি না, জানি না, তবে সচিব মহাশয় অনেকটা ভুলে গেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা বা বন্ধ রাখার একমাত্র এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এবং আচার্যের। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল, কলেজ নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার রাখলেও তারা কখনো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার আদেশ দিতে পারে না।
এ নির্দেশনার মধ্য দিয়ে অনেকের মধ্যে একটি ভ্রান্তি ধারণা তৈরি হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিল, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করে ইউজিসি, তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও বুঝি তাদের রয়েছে। বিষয়টি কি আসলে তা–ই? চলুন ইউজিসি যে আইনে পরিচালিত হয়ে আসছে, সেখানে কী বলা হয়েছে, তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’ বিষয়ে যে প্রজ্ঞাপন বের হয়েছিল, সেই আইনের অধীনই সংস্থাটি পরিচালিত হয়ে আসছে। স্বায়ত্তশাসিত এ সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে এই অধ্যাদেশের ৫ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের মূল্যায়ন ও পরিকল্পনায় সহায়তা প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ তৈরি করা, সরকার থেকে সেই অর্থ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বণ্টন করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকা বিভাগ, ইনস্টিটিউটের জন্য প্রোগ্রামকে মূল্যায়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের উন্নয়নের যাচাই-বাছাই করা, বিশ্ববিদ্যালয়–সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পুরোনোদের বর্ধিতকরণের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া।
এসবের বাইরে ইউজিসির সর্বোচ্চ উদ্ভাবনী গবেষণা এবং উন্নয়নকে উৎসাহিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুশাসন–সংক্রান্ত বিষয়গুলোর উন্নয়ন ঘটানোর কথাও সেখানে বলা হয়েছে।
এর বাইরে ‘বিশ্ববিদ্যালয় খোলা-বন্ধ’ করার কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আমি অন্তত মঞ্জুরি কমিশনের আইনের কোথাও খুঁজে পাইনি। কিন্তু ইউজিসি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের ডাক দিয়েছিল; এটা স্পষ্টত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনের পরিপন্থী একটি সিদ্ধান্ত, যা ইউজিসির এখতিয়ারে নেই।
তবে সরকারের চাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিই যদি বন্ধের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে এমন একটি সিদ্ধান্ত কেবল আচার্য মহোদয়ই দিতে পারেন, যার অধিকার ১৯৭৩ অধ্যাদেশের ১০(২) ধারায় বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আচার্যের যেকোনো আদেশ সংবিধিবদ্ধ ক্ষমতাবলে কার্যকর হবে।
কিন্তু আমাদের ইউজিসি সেই দিকে কর্ণপাত করেনি। তারা যে চর্চা করেছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা আইনের সঙ্গে শুধু সাংঘর্ষিক নয়, ‘বলপ্রয়োগের’ শামিল। এমনিতে সাম্প্রতিক সময়ে ইউজিসির নানার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নানাভাবে ইউজিসি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদেরই নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। কিন্তু এই অনধিকার চর্চা যে হিতে বিপরীত হতে পারে, তা তারা জানে না। তারা খোঁজ নেয়নি, ১৬ জুলাই ওই আদেশ জারির পর শিক্ষক সমাজের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল।
আমি নিশ্চিত নই, ইউজিসির ওই আদেশ অতি উৎসাহী সরকারপ্রেমীদের কর্মকাণ্ড ছিল, নাকি সরকার চাপ দিয়ে ইউজিসির কাছ থেকে এমন আদেশ জারি করিয়েছে। এটা ইউজিসিকে খোলসা করতে হবে। সেটি করতে না পারলে ক্ষমতাসীনেরা নানাভাবে স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করবে। যেহেতু ইউজিসি একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, সেহেতু এই অজুহাত দেখিয়ে ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার এ রকম আদেশ জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেবে কি না, তা তো বলা যাবে না।
এরই মধ্যে ইউজিসির চেয়ারম্যান পদত্যাগ করে নতুন চেয়ারম্যান এসেছে। আশা করি, তিনি অন্তত ইউজিসির ওই অবৈধ আদেশের বিষয়ে কৈফিয়ত জারি করতে পারেন। কারা, কেন, কোন উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলার জন্য ‘তড়িঘড়ি’ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আদেশ দিয়েছিল, তা জাতির সামনে জানাতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতির কঠিন এক সময়ে শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় মিছিল-সংগ্রাম করছিলেন, তখন সেটাকে বাধাগ্রস্ত করতে ইউজিসির আদেশটি আমাদের শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশকে ব্যাহত করে তোলে। মূলত অনধিকার চর্চার এ আদেশের কারণে আজও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরতে পারেনি। এ দায় ইউজিসিকেও নিতে হবে।
আমরা চাই, যার বিধিবদ্ধের সীমানা যতটুকু, তাকে সেই জায়গায় কাজ করা উচিত। সেটি করতে ব্যর্থ হলে নিজেরাই ব্যর্থ হয়। কক্ষপথের বাইরে গিয়ে ইউজিসির এমন আদেশ সামনের দিনগুলোতে কেউ যেন জারি করতে না পারে, সেই ব্যবহারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গা, একে কলুষিত হতে দেওয়া যাবে না।
আশা করি, ইউজিসির সেই আদেশ পরীক্ষা–নিরীক্ষা করবে নতুন সরকার। তদন্ত করে কারও দোষ পেলে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি পেতে হবে।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]