রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস এবং দুর্নীতির আলাদা দুটি মামলার আলাদা রায়ে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ১৪ বছর ও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এরপর দেশটির শক্তিধর সামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইমরানের বিদ্যমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নতুন দিকে মোড় নিয়েছে।
গোপনীয় কূটনৈতিক সাইফার (সাংকেতিক কোড ব্যবহার করে লেখা বার্তা) জনসমক্ষে প্রকাশ করার মামলায় ইমরানের সঙ্গে তাঁর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশিকেও ১০ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে।
গত আগস্টে ইমরানকে আরেকটি দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল; তবে আপিল আদালত সেই রায় স্থগিত করেছিলেন। অনেকেই ইমরানের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ এবং বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
আশা করা হচ্ছে, ইমরান সব অভিযোগ থেকে একসময় খালাস পাবেন। তবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাঁকে বিভিন্ন মামলার জালে আটকে রাখা হবে।
পাকিস্তানের মাঠের রাজনীতির যে বাস্তবতা সেটি হলো, সেখানে ইমরান খান প্রবলভাবে জনপ্রিয় এবং রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার পর তাঁর জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়।
প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়েও নিজের নীতিতে অটল থাকা এবং পাকিস্তানের প্রথাগত রাজনীতিকদের মতো ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর সঙ্গে আপসরফা করে দেশত্যাগ না করা তাঁকে ভোটারদের কাছে মহীয়ান করে তুলেছে।
ইমরানকে সরিয়ে যাঁরা গদিতে বসেছেন, তাঁরা ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তানে ইমরানবিরোধী সুর তোলা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ইমরান-সমর্থকদের ওপর চলমান দমন-পীড়ন তাঁর প্রতি জনগণের সমবেদনা বাড়িয়েছে। এমনকি যে সংসদীয় এলাকায় ইমরানবিরোধীদের ঘাঁটি, সেখানেও তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে। ইমরানের জনসমর্থনের প্রভাব পাকিস্তানের ক্ষমতার প্রধান অংশীদার সামরিক বাহিনীর ওপরও পড়েছে।
দেশটির অন্য রাজনীতিকদের মতো ইমরান তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেননি। তার বদলে তিনি সরাসরি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের সেনাগোষ্ঠী তাঁকে উৎখাতের পেছনে কাজ করেছে।
ইমরানের সাম্প্রতিক সাজাই সম্ভবত শেষ সাজা নয়। তিনি নতুন অভিযোগের মুখে পড়তে পারেন। তাতে খানের জনপ্রিয়তা কমার চেয়ে বেড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইমরানের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, তা পাকিস্তানের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে সামরিক গোষ্ঠীকে ফেলে দিতে পারে।
ইমরানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অতিগোপনীয় তথ্য ফাঁসের মামলার মূল বিষয়বস্তু হলো একটি সাইফার। এই সাইফারে ইমরানের রাশিয়া সফর নিয়ে একজন মার্কিন কর্মকর্তাকে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে বলে বলা হচ্ছে। সাইফারে ইমরানকে সরিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত ছিল।
ইমরান খান সেই কূটনৈতিক নথি প্রকাশ্য জনসভায় সমর্থকদের সামনে তুলে ধরে বলেছিলেন, আমেরিকার কথামতো সেনাবাহিনী তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ছক কষেছে।
এই ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টিকে আরও একবার সামনে নিয়ে আসে এবং ইমরান সেনাবাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ান। গত বছর ইমরান খানের গ্রেপ্তার আরও স্পষ্ট করে তুলেছিল যে তাঁর রাজনীতি ও ভাষ্য সেনাবাহিনীর সুযোগ-সুবিধার জন্য একটি কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
সেনাবাহিনীর মিত্র হিসেবে ইমরান খানের রাজনৈতিক উত্থান থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর জন্য তাঁর হুমকি হয়ে ওঠার যাত্রায় এটি স্পষ্ট হয়েছে: ভবিষ্যতে তিনি সরকার গঠন করলে সেই বেসামরিক সরকার সেনাবাহিনীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমিয়ে ফেলবে।
ইমরান খান বেসামরিক সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানোর নীতির পথে হাঁটছেন। এটি কেবল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই নয়, বরং এটি অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত নীতিনির্ধারণের রূপরেখাও বদলে দেবে। এসব বিষয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খানকে সেনাবাহিনীর কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে। ফলে এটি স্পষ্ট, সামরিক বাহিনী আর কখনোই তাঁকে ক্ষমতায় ফিরতে দেবে না।
ইমরান কারাগারে থাকলেও, তাঁর নিছক অস্তিত্বই তাঁর অনুসারীদের চাঙা এবং তাঁর রাজনৈতিক দলকে প্রাসঙ্গিক রাখার জন্য যথেষ্ট। সেনাবাহিনী ও প্রতিপক্ষের রাজনীতিকদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে ইমরানের দল পিটিআই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। প্রবল চাপের মুখে পড়েও দলীয় সদস্যরা দলটি ছেড়ে চলে যাননি; বরং তাঁরা রাজনৈতিক দমন-পীড়ন মোকাবিলা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রয়েছেন।
আসন্ন নির্বাচনে পিটিআইয়ের প্রার্থীদের জয়ের পথে সরকারের দিক থেকে পাহাড়সমান বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তারপরও তাঁদের জয়ের সম্ভাবনা কমানোর ক্ষেত্রে সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। নির্বাচনে পিটিআইয়ের নির্বাচনী প্রতীক নিষিদ্ধ করা হয়েছে; তাদের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে; প্রার্থীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। অন্যদিকে তাদের প্রতিযোগীদের স্বাচ্ছন্দ্যে প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ইমরানের দল এবং দলটির নেতাদের খবর স্থানীয় সংবাদমাধ্যম প্রায় সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কড়া নজরদারি করা হচ্ছে। বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের নজরে প্রশাসনের ভয় দেখানোর অভিযোগ আনা হলেও তাতে আমল দেওয়া হচ্ছে না। এতে বিচার বিভাগের আপসকামিতা ধরা পড়ছে। শীর্ষস্থানীয় একাধিক বিচারপতির সাম্প্রতিক পদত্যাগে সেটি আরও স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে।
ইমরানের সাম্প্রতিক সাজাই সম্ভবত শেষ সাজা নয়। তিনি নতুন অভিযোগের মুখে পড়তে পারেন। তাতে খানের জনপ্রিয়তা কমার চেয়ে বেড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইমরানের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, তা পাকিস্তানের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে সামরিক গোষ্ঠীকে ফেলে দিতে পারে।
● উমর করিম বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন বিভাগের একজন গবেষক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ