ভলোদিমির জেলেনস্কি যত দিন পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট থাকবেন, তত দিন পর্যন্ত রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করা মানে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
জেলেনস্কিকে তাঁর দেশে যাঁরা সমর্থন দেন, তাঁদের কারণেই তিনি অনড় অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং রাশিয়াকে কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নন। একেবারে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যেতে চান তাঁরা।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যদি কোনো ধরনের আপস-রফা অসম্ভব হয়, তাহলে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অবসানের আর কি কোনো পথ খোলা আছে?
বাস্তবতাগুলো খুব কঠিন। প্রথমত, এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে পারবে না ইউক্রেন। রাশিয়াকে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে বের করে দেওয়ার মতো সৈন্যবল ও অস্ত্রবল দুটির কোনোটাই নেই তাদের।
চার মাস ধরে ইউক্রেন যে পাল্টা আক্রমণ অভিযান চালাচ্ছে, তাতে প্রায় কোনো ইতিবাচক ফল আসেনি; বরং অস্ত্রশস্ত্র ও সাঁজোয়া যান খোয়া যাওয়ার পাশাপাশি প্রায় ২০ হাজার সৈন্য হতাহত হয়েছেন।
এখন আরেকটি খবর জানা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে আসা চাপে ইউক্রেন খুব শিগগিরই আরেকটি পাল্টা আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে। নিপার নদী পার হয়ে খেরসন অঞ্চলে এই অভিযান পরিচালিত হবে। ইউক্রেনীয়রা আশা করছেন, এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার মূল ভূমি থেকে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব হবে। এই পাল্টা আক্রমণ থেকে জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেও হামলা চালানো হতে পারে। তারা পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটাতে চায়। যাতে রাশিয়ানদের ঘাড়ে দায় চাপানো যায়।
কিন্তু খুব শিগগিরই নতুন এই আক্রমণ অভিযান শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কম। কেননা, মৌসুমি বৃষ্টি ও ঠান্ডা আবহাওয়া খুব শিগগিরই ইউক্রেনে জেঁকে বসবে। কিন্তু রাশিয়ান পদাতিক বাহিনীর গোলাবর্ষণ এড়িয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী পথ তৈরি করে নিতে পারবে, এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই কৌশল নেওয়া হতে পারে।
তবে ইউক্রেনের সরকার ও সেনা নেতৃত্বের মধ্যকার এই দূরত্ব মূল প্রশ্ন নয়। মূল প্রশ্নটি হলো, রাশিয়া ও ন্যাটো কি শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি চুক্তি করতে পারবে কি না। পুতিনসহ রাশিয়ান নেতারা বিশ্বাস করেন, ন্যাটো সম্প্রসারণ হলে সেটা রাশিয়াকে হুমকির মুখে ফেলবে।
যুদ্ধে রাশিয়ার বিমানবাহিনী আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে। যদিও পোল্যান্ডের কাছে যুক্তরাজ্য ইউরোফইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান হস্তান্তর করতে চলেছে। পোল্যান্ডের কাছ থেকে টাইফুন যুদ্ধবিমান ইউক্রেনের কাছে যেতে পারে। কেননা, প্রতিশ্রুত এফ-১৬এস যুদ্ধবিমান ইউক্রেনে পৌঁছাতে দেরি হবে। একটা বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনের পাইলটদের টাইফুন বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নেই। এ ধরনের বিমান যুক্তরাজ্যের পাইলটদের চালাতে হবে এবং ঘাঁটি স্থাপন করতে হবে ইউক্রেনের বাইরে।
টাইফুন যুদ্ধবিমানের এই গল্প যুক্তরাজ্যের নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রান্ট শাপস ইউক্রেনে ব্রিটিশ সেনা পাঠানোর যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর নৌশক্তি মোতায়েনের কথাও বলেন। কিন্তু ২ অক্টোবর শাপস সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বলেন, ইউক্রেনীয় শস্য রপ্তানিকারকদের সুরক্ষা দিতে কৃষ্ণসাগরে নৌযান পাঠাবে না যুক্তরাজ্য।
ইউক্রেনে যদি যুক্তরাজ্য তাদের সেনা পাঠায়, সেটা স্পষ্টত রাশিয়া প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখবে। এর মানে হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপে বিস্তার লাভ করবে।
এরই মধ্যে ওয়াশিংটনেও হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রতিরক্ষা পণ্য পাঠানোর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া ১ অক্টোবর পৃথক পাঁচটি হামলা চালায়। তারা ইউক্রেনের সামরিক মজুত, সামরিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের স্থান এবং অস্ত্র উৎপাদন কারখানা ধ্বংস করে।
ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের অসন্তোষ বাড়ছেই। ইউক্রেনের ব্যাপক দুর্নীতির খবরও অসন্তোষের বড় কারণ।
যা-ই হোক, আরও বড় একটি সমস্যা হলো ইউক্রেনের ভেতরকার রাজনৈতিক বিরোধ। ইউক্রেনের বর্তমান সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি ওয়াশিংটন ও জেলেনস্কির চাপিয়ে দেওয়া নিপার নদী পেরিয়ে আক্রমণ অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
এ ছাড়া আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেন তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে লোকবল নিতে পারেনি। সেনাবাহিনী থেকে নিয়োগ কর্মকর্তাদের ছাঁটাইয়ের কারণ শুধু দুর্নীতি নয়, নিয়োগের কোটা পূরণে ব্যর্থতাও রয়েছে।
ইউক্রেনের সেনাপ্রধানের ওপর নানা ধরনের হুমকি আছে। বিবিসি ইউক্রেনীয় সার্ভিস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলে পরিচালিত সাম্প্রতিক পাল্টা আক্রমণ অভিযানে ব্যর্থতার কারণে ইউক্রেনের স্টেট ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এসবিইউ) জালুঝনির বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্ত শুরু করেছে।
জেলেনস্কির অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের তদন্ত হওয়া সম্ভব নয়। এসবিইউতে জেলেনস্কি তাঁর নিজস্ব লোক নিয়োগ দিয়েছেন এবং বিরোধীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করতে এই সংস্থাকে ব্যবহার করেন।
শত্রুপক্ষ রাশিয়ানদের কাছেও জালুঝনি অসাধারণ একজন সেনানায়ক। নর্ড স্টিম পাইপলাইন কাণ্ডে জালুঝনিকে দোষারোপ করে আক্রমণ চলছেই। সম্ভবত এটি ছিল সিআইএর পরিকল্পনায় করা একটি হামলা। জালুঝনিকে সরাসরি তাতে দোষ দেওয়া যায় না।
যা-ই হোক, সরাসরি সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এ ধরনের তদন্ত ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য বিশাল এক ধাক্কা। এতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর লড়াইয়ের সামর্থ্যও কমে যাবে।
তবে ইউক্রেনের সরকার ও সেনা নেতৃত্বের মধ্যকার এই দূরত্ব মূল প্রশ্ন নয়। মূল প্রশ্নটি হলো, রাশিয়া ও ন্যাটো কি শুধু ইউক্রেন নয়, পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি চুক্তি করতে পারবে কি না। পুতিনসহ রাশিয়ান নেতারা বিশ্বাস করেন, ন্যাটো সম্প্রসারণ হলে সেটা রাশিয়াকে হুমকির মুখে ফেলবে।
ন্যাটোর সমর্থন ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিয়েভ এ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের যতজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান গেছেন, তাতে যে কারও কাছে মনে হতে পারে, ইউক্রেনে সহযোগিতা উপচে পড়তে থাকবেই। কিন্তু গত বছর এই সমর্থন কমে যাওয়ার পেছনে শুধু কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা একমাত্র কারণ নয়, তাদের হস্তক্ষেপের পরও ইউক্রেন বিজয় নিশ্চিত করতে পারেনি, সে বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
ইউরোপে শিল্প খাতের শক্তিঘর হিসেবে পরিচিত জার্মানি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছে। এর কারণ হলো, রাশিয়া থেকে তারা যে সস্তায় জ্বালানি গ্যাস পেত, তার সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে আরও বড় পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তার পরিণতি ইউরোপীয় নেতাদের ভুগতে হবে।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি ইনস্টিটিউট অ্যান্ড দ্য ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত