বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে এখন গাজা যুদ্ধ। এরপরও অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ একটা অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রত্যাশা জাগানো গ্রীষ্মকালীন পাল্টা আক্রমণ অভিযান উল্লেখ করার মতো কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। অন্যদিকে রাশিয়াও কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারেনি।
সামরিক অভিধানে অচলাবস্থা সব সময় নেতিবাচক ধারণা না–ও হতে পারে। ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে—সেটা প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে। অচলাবস্থার এই সময়টায় অস্ত্র ও গোলাবারুদের শূন্য ভান্ডার আবার পূর্ণ করার (যেমন রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কমে এসেছে) অথবা যুদ্ধের পরের ধাপের জন্য নতুন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র (যেমন ইউক্রেন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পাওয়ার অপেক্ষায়) আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করলে এই ধরনের অচলাবস্থায় দুই পক্ষই মিত্র ও অংশী দেশগুলোর সঙ্গে সলাপরামর্শ করার সুযোগ পায়। এটাও সত্য যে যুদ্ধক্লান্তির কারণেও অচলাবস্থা তৈরি হয়। পশ্চিমে ইউক্রেনের মিত্রদের মধ্যে নানা মাত্রায় যুদ্ধক্লান্তি দেখা যাচ্ছে।
যাহোক, সমুদ্রযুদ্ধ বিবেচনায় নিলে চিত্রটা কিন্তু ভিন্ন। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় সমুদ্রে ইউক্রেন নাটকীয়ভাবে নিজেদের সাফল্য দেখাতে পেরেছে। এর ওপর ভর করে আসন্ন শীতে কৃষ্ণসাগরে বড় ধরনের কৌশলগত ও রাজনৈতিক সুবিধা পাবে ইউক্রেন।
কিয়েভ দাবি করেছে, যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার কৃষ্ণসাগর নৌবহরের ২৭টি যুদ্ধজাহাজ ও নৌযান ধ্বংস করেছে। এগুলোর মধ্যে রাশিয়ার নৌবহরের প্রধান যুদ্ধজাহাজ ১১ হাজার টনের মস্কোভাও রয়েছে। রাশিয়ার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রবাহী কিলো-ক্লাস একটি সাবমেরিনও ধ্বংস করেছে ইউক্রেন।
ইউক্রেনে যত বেশি জাহাজ আসবে, ততই পরিষ্কার হয়ে যাবে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার অবরোধ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা খেলো হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিয়েভের মিত্ররা এটা বুঝতে পারছে যে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেন বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে স্থলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পরও নৌযুদ্ধে সাফল্য প্রমাণ করে ইউক্রেনের প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি।
গত কয়েক মাসে ক্রিমিয়ার সেভাস্তপলে রাশিয়ার নৌঘাঁটিতে বেশ কয়েকবার সফল হামলা করেছে ইউক্রেন। এ হামলা থেকে এটা স্পষ্ট যে নৌঘাঁটিটি আর সুরক্ষিত নয়। এ হামলার কারণে কৃষ্ণসাগর বহরের অধিকাংশ যুদ্ধজাহাজ ও নৌযান রাশিয়ার মূলভূমির নভরস্কি বন্দরে নিয়ে নোঙর করে রাখতে হয়েছে।
কিলো-ক্লাস সাবমেরিনগুলোকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে রাখা রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এ ধরনের ব্যয়বহুল ও দুর্লভ নৌযান খোয়া যাওয়া রাশিয়ার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
আসন্ন শীতেও আগের বছরের মতো ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা করার চেষ্টা করবে রাশিয়া। এই হামলা করার জন্য কৃষ্ণসাগরের নৌবহর কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখন ইউক্রেন থেকে অনেক দূরে রাশিয়ার নৌবহর সরিয়ে রাখার কারণে কৌশলগত ও রসদের জোগান—দুই দিক থেকেই মস্কোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ, শিপইয়ার্ড, কমান্ড কেন্দ্র ও আকাশ প্রতিরক্ষা স্থাপনা—ইউক্রেনের সফল হামলার প্রভাব শুধু কৃষ্ণসাগরেই সীমাবদ্ধ নেই। এর প্রভাব আরও বিস্তৃত।
এর কারণ হলো ইউক্রেনে স্থলযুদ্ধ একটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষই একে অন্যকে পুরোপুরি পরাজিত করতে চায়। কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের সফল হামলা ক্রিমিয়া রক্ষায় রাশিয়ার নাজুকতার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে। এর তাৎপর্য অনেক।
অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে ইউক্রেন শিগগির ক্রিমিয়া উপদ্বীপটির পুনর্নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। কিন্তু ক্রিমিয়ার ওপর যে হুমকি তৈরি হয়েছে, তাতে করে রাশিয়া বাধ্য হচ্ছে তাদের সীমিত সম্পদ ক্রিমিয়ার সুরক্ষায় ব্যবহার করতে। এতে করে সামগ্রিকভাবে মস্কোর কৌশলনীতিতে প্রভাব পড়ছে।
ইউক্রেন থেকে দূরে রাশিয়ার নৌবহর রাখার কারণে আরও একটি সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম কৃষ্ণসাগরের পথটাই ইউক্রেনের সঙ্গে বাকি বিশ্বের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান পথ। সেই পথ থেকে দূরে নৌবহর রাখার কারণে ইউক্রেনের ওপরে রাশিয়ার অবরোধ তৈরি করার প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যেমনটা বলেছেন, বিশ্বের অন্য অংশে অস্থিতিশীলতা তৈরির কাজে রাশিয়া আর কৃষ্ণসাগরকে ব্যবহার করতে পারবে না।
যদিও সেভাস্তপল থেকে নৌবহর সরিয়ে রাখলেও বেসামরিক নৌযানে হামলা করা থেকে বিরত নেই রুশ নৌবহর। ৯ নভেম্বর কৃষ্ণসাগরের ওদেসা বন্দরে প্রবেশের সময় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই হামলায় একজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন চারজন।
সমুদ্রে অবরোধ কেবলমাত্র তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন জাহাজ চালনায় অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি থাকবে এবং ইনস্যুরেন্স ব্যয় অনেক বেশি হবে। রাশিয়ার অবরোধ এড়াতে হলে বৈশ্বিক জাহাজ–বাণিজ্যে কিয়েভকে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে। সে জন্য রুশ নৌবাহিনী যে হুমকি তৈরি করেছে, সেটা প্রশমন করা। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইউক্রেনের সামুদ্রিক বাণিজ্য স্বাভাবিক করা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, লাইবেরিয়ান জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরও ইউক্রেন সরকার যুক্তরাজ্যের ১৪টি ইনস্যুরেন্স সংস্থার সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। এ চুক্তি উপলক্ষে ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী ড্যানিশ শিমহ্যাল বলেন, এই চুক্তির ফলে সামরিক ঝুঁকির বিপরীতে ইউক্রেনের সব ধরনের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ইনস্যুরেন্স ব্যয় হ্রাসকৃত মূল্য পাওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে কৃষ্ণসাগরের এই পথে রপ্তানিকারকদের আরও বড় সুযোগ সৃষ্টি হলো।
ইউক্রেনে যত বেশি জাহাজ আসবে, ততই পরিষ্কার হয়ে যাবে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার অবরোধ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা খেলো হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিয়েভের মিত্ররা এটা বুঝতে পারছে যে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেন বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে স্থলে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পরও নৌযুদ্ধে সাফল্য প্রমাণ করে ইউক্রেনের প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি।
বেসিল গেরমন্ড যুক্তরাজ্যের ল্যানক্যাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত