ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের কথা বেশ কিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছিল। মূলত ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ ও তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যই আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কমানোর একটি দাবি ছিল বিভিন্ন মহল থেকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের অন্যতম ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন। আইনটি পাসের জন্য জাতীয় সংসদে বিল আকারে ওঠে ৮ জুন। এরপর পরীক্ষার জন্য সাত দিন সময় দিয়ে বিলটি অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
সহকর্মী সানাউল্লাহ সাকিব ব্যাংক খাত নিয়ে রিপোর্ট করেন। ১১ জুন এক পৃষ্ঠার একটা লিখিত কাগজ এনে দিলেন। শিরোনাম হচ্ছে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩’। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) পক্ষ থেকে কিছু সংশোধনী পাঠানো হয়েছে সরকারের কাছে, এটি সেই প্রস্তাব।
কী ছিল সেই প্রস্তাবে
বিএবির দেওয়া প্রস্তাবটি ভাষা-বানানরীতিসহ হুবহু এখানে দেওয়া হলো। যেমন শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘ধারা ১৫ কক এর উপ-ধারা (১), (২) ও ব্যাখ্যাংশে এ উল্লিখিত “৯ (নয়)” সংখ্যা, বন্ধনি ও শব্দগুলি “১২ (বারো)” সংখ্যা, বন্ধনি ও শব্দগুলি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হউক, যথা:—“১৫ কক। পরিচালক পদের মেয়াদ, ইত্যাদি।- (১) আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন অথবা কোনো ব্যাংক-কোম্পানীর সংঘস্মারক ও সংঘবিধিতে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ব্যাংক-কোম্পানী (সংশোধন) আইন, ২০১৮ কার্যকর হইবার পর কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যাংক-কোম্পানীর পরিচালক পদে একাদিক্রমে ১২ (বারো) বৎসরের অধিক অধিষ্ঠিত থাকিতে পারিবেন না।
‘(২) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন একাদিক্রমে ১২ (বারো) বৎসর কোনো ব্যাংক-কোম্পানী পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকিলে উক্ত মেয়াদ শেষ হইবার পর ৩ (তিন) বৎসর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি উক্ত ব্যাংক-কোম্পানীর পরিচালক পদে পুনঃনিযুক্ত হইবার যোগ্য হইবেন না।
সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন যেভাবে পাস হলো, তা থেকে একটি উপসংহারে আসাই যায়। এই যে প্রভাবশালী ব্যাংকমালিকেরা আইনের ভাষায় কীভাবে প্রস্তাব লিখতে হয়, প্রজ্ঞাপন কীভাবে তৈরি করতে হয়, সব শিখে ফেলেছেন, এটাই-বা কম কিসে। তাতে বাকি সবার কাজ সহজ হয়ে গেছে।
‘ব্যাখ্যা।-এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোনো ব্যক্তি পরিচালক পদে ৩ (তিন) বৎসরের চাইতে কম সময় অধিষ্ঠিত না থাকিলে একাদিক্রমে ১২ (বারো) বৎসর গণনার ক্ষেত্রে উক্ত সময়ও অন্তর্ভুক্ত হইবে।’ সহজ ভাষায় বলা যায়, প্রস্তাব হচ্ছে, ৯ বছর নয়, পরিচালকেরা ১২ বছর টানা পদে থাকতে পারবেন। তিন বছর বাদ দিয়ে তাঁরা আবার পরিচালক পদে ফিরতে পারবেন। আর যাঁরা তিন বছরের কম সময় ধরে এখন পরিচালক আছেন, তাঁরাও ১২ বছর পদে থাকতে পারবেন।
দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল ২৭ কক-এর তিন উপধারায় নতুন একটি শর্ত যুক্ত করা। প্রস্তাবটি হুবহু এ রকম, ‘তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৫ এর দফা (গগ) এর বিধান অনুসারে পরস্পর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গ্রুপভুক্ত কোনো খেলাপী ব্যক্তি বা, ক্ষেত্রমত, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা না হয় অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট যদি ইহা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী কর্তৃক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইবার ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ রহিয়াছে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী খেলাপী হইবার কারণে ঐ গ্রুপভুক্ত অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী খেলাপী বলিয়া গণ্য হইবে না, এবং এইরূপ প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে তৎকর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা প্রদান করা যাইবে।’
যা পাস হলো
অর্থমন্ত্রী যে বিল সংসদে উত্থাপন করেছিলেন, তাতে পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানো-কমানোর কোনো প্রস্তাব ছিল না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও এ নিয়ে কোনো সংশোধনী আনেনি। তবে ২৪ জুন বিলটি পাসের আগে সংশোধনী প্রস্তাবটি আনেন সরকারি দলের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মকবুল হোসেনের পুত্র সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম।
এবার দেখা যাক আহসানুল ইসলামের আনা প্রস্তাবের ভাষা কী ছিল। সংশোধনীর ভাষাটা ছিল হুবহু এ রকম, ‘পরিচালক পদের মেয়াদ, ইত্যাদি। (১) আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন অথবা কোন ব্যাংক-কোম্পানীর সংঘস্মারক ও সংঘবিধিতে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ব্যাংক-কোম্পানী (সংশোধন) আইন, ২০১৮ কার্যকর হইবার পর কোন ব্যক্তি কোন ব্যাংক কোম্পানীর পরিচালক পদে একাদিক্রমে ১২ (বারো) বৎসরের অধিক অধিষ্ঠিত থাকিতে পরিবেন না। (২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন একাদিক্রমে ১২ (বারো) বৎসর কোন ব্যাংক কোম্পানীর পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকিলে উক্ত মেয়াদ শেষ হইবার পর ৩ (তিন) বৎসর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি উক্ত ব্যাংক-কোম্পানীর পরিচালক পদে পুনঃনিযুক্ত হইবার যোগ্য হইবেন না।
‘ব্যাখা। এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোন ব্যক্তি পরিচালক পদে ৩ (তিন) বৎসরের চাইতে কম সময় অধিষ্ঠিত না থাকিলে একাদিক্রমে ১২ (বারো) বৎসর গণনার ক্ষেত্রে উক্ত সময়ও অন্তর্ভুক্ত হইবে।’
আহসানুল ইসলাম ২৭ কক ধারারও সংশোধনের প্রস্তাব এনেছিলেন। যেমন ‘কোন খেলাপী গ্রহীতার অনুকূলে কোন ব্যাংক-কোম্পানী বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনরূপ ঋণ সুবিধা প্রদান করিবে না: তবে শর্ত থাকে যে, ধারা এর দফা (গগ) এর বিধান অনুসারে পরস্পর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গ্রুপভুক্ত কোন খেলাপী ব্যক্তি বা ক্ষেত্রমত, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা না হয় অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট যদি ইহা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী কর্তৃক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইবার ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ রহিয়াছে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী খেলাপী হইবার কারণে ঐ গ্রুপভুক্ত অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানী খেলাপী বলিয়া গণ্য হইবে না, এবং এইরূপ প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানীকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে তৎকর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা প্রদান করা যাইবে।’
একই জিনিস দুবার পড়লেন, তাই তো?
সরকারের দেওয়া উপহার
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৫ সালে ১১টি শিল্পগোষ্ঠীকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নেতা নিজে প্রস্তাবটি তৈরি করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ ছিল কেবল তা জারি করা।
আবার ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক পদে থাকার বিধান রেখে ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন করা হয়েছিল। একই বছরের ১ এপ্রিল এক হোটেলে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর টাকার অভাব দূর করতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই বছরের ২০ জুন সুদহার নয়-ছয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বিএবির কার্যালয়ে বসে। প্রতিটির ক্ষেত্রেই এসব প্রস্তাব তৈরি করে দিয়েছিলেন ব্যাংক উদ্যোক্তারাই।
২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাংকমালিকদের পরিবারতন্ত্র উপহার দিয়েছিল সরকার। আরেক নির্বাচনের আগে আবার উপহার পেলেন তাঁরা। এমনকি ২০১৫ সালের উপহারটিও ছিল নির্বাচনের ঠিক পরেই। এসব দেখেই আইএমএফ ২০১৯ সালে লিখেছিল, ‘প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারাই বাংলাদেশে আর্থিক খাতের সিদ্ধান্ত নেন।’
ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি
সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন যেভাবে পাস হলো, তা থেকে একটি উপসংহারে আসাই যায়। এই যে প্রভাবশালী ব্যাংকমালিকেরা আইনের ভাষায় কীভাবে প্রস্তাব লিখতে হয়, প্রজ্ঞাপন কীভাবে তৈরি করতে হয়, সব শিখে ফেলেছেন, এটাই-বা কম কিসে। তাতে বাকি সবার কাজ সহজ হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নতুন করে আইনের ভাষায় কিছু লিখতে হচ্ছে না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময়ও নষ্ট হচ্ছে না, ফাইলের পর ফাইল তৈরি হচ্ছে না। সবকিছু প্রস্তুত হয়েই যাচ্ছে। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজও অনেক সহজ হয়ে গেছে। সুতরাং সব যে মন্দ, তা কিন্তু নয়। এই দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রভাবশালী এসব উদ্যোক্তাকে ধন্যবাদ দেওয়াই যেতে পারে।
শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন