ভারত-চীনের দ্বন্দ্ব এখন ভারতের ‘ভেতর বাড়ির উঠান’ বাংলাদেশেও পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে সরকারের সমালোচকদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর বিরুদ্ধে মাস কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চীন খোলাখুলিভাবে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় যে কেউ হস্তক্ষেপ করলে তাঁর ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হবে—যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুমকির প্রেক্ষাপটেও চীনের এই সমর্থন এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সাম্প্রতিক’ বক্তব্য এবং হাসিনা সরকারকে ফেলে দেওয়ার মার্কিন সক্ষমতা নিয়ে গত ১৪ জুন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসিয়াল সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমসের একজন সাংবাদিক চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিনের মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন।
এ সময় ওয়াং ওয়েনবিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) বহুদিন ধরেই বাংলাদেশ ও অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের ঘরোয়া বিষয়ে নাক গলিয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও এই ধরনের অন্যান্য দেশকে আধিপত্যবাদ ও পেশিশক্তির রাজনীতির চাপ মোকাবিলায় সহায়তা করতে চীন প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে তার সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে যাব।’
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের যুদ্ধে বাংলাদেশ নতুন লড়াই-ক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। অবশ্য চীনের সাম্প্রতিক এই বাড়াবাড়ি রকমের বাগাড়ম্বরের তাৎপর্য এখনো অস্পষ্ট। কোনো দেশই অপর দেশকে আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে আশ্বাস দিতে পারে না, যদি না সেই দেশের ভূখণ্ডে আশ্বাসদাতা দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাজ করার ব্যবস্থা না থাকে।
মনে রাখা দরকার, বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি নয়। আবার বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুবিধার্থে যুক্তরাষ্ট্র যে চেষ্টা করছে সেটিও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বা আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য কোনো হুমকি নয়। সুতরাং চীন যা বলছে, মোটা দাগে তার অর্থ হলো, ২০২৪ সালের নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন, চীন শেখ হাসিনার পাশে থাকবে।
আওয়ামী লীগ সরকার যতদিন ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে, ততদিন ভারত বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে তুলনামূলকভাবে নীরব ছিল। শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ ভারতকে নিরাপত্তা ইস্যুতে, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের লোকদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে দিল্লিকে সহায়তা করে এসেছে।
এ ছাড়া হাসিনা সরকার ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি রাজ্য—ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামে সড়ক, রেল, নদী ও সমুদ্রপথে ট্রানজিট রুটের অনুমতি দিয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা—এই দুটি সমুদ্রবন্দর এবং চারটি নদীবন্দর কলকাতা ও মুর্শিদাবাদকে আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত করবে। এর বাইরে আন্তসীমান্ত ট্রাক চলাচল এখন বিবিরবাজার হয়ে শ্রীমন্তপুর (ত্রিপুরা), আখাউড়া হয়ে আগরতলা (ত্রিপুরা), শেওলা হয়ে সুতারকান্দি (আসাম) এবং তামাবিল হয়ে ডাউকি (মেঘালয়) পর্যন্ত চালাচল করতে পারে।
বাংলাদেশ এসব জায়গায় ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে ট্রানজিট ফি বাবদ অর্থ আদায় করবে এবং রপ্তানি বাড়াতে ভারতীয় ঋণের আওতায় নির্মিত পরিবহন অবকাঠামো ব্যবহার করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে তাঁর সরকারের বিদ্যমান সম্পর্ককে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ‘সুবর্ণ অধ্যায়’ বলে যে অভিধা দিয়েছেন, তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যদিও বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের সাধারণ অবস্থান হলো, বাংলাদেশে নির্বাচিত যে সরকারই আসুক, সে সরকারের সঙ্গে ভারত সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেনতেনপ্রকারেণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও গত তিনটি নির্বাচনে মোদি সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সরকারের প্রতি দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কথিত ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রশ্ন হলো, এখন শেখ হাসিনাকে চীনের জোরালোভাবে সমর্থন দেওয়া দেখে ভারতের কি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু আছে? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমিন বলেছেন, আগামী আগস্টে ব্রিকস সম্মেলনে ঢাকা অতিথি হিসেবে যোগ দেবে। ওই সময় বাংলাদেশকে আরও আটটি দেশের সঙ্গে ব্রিকসে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে কথা রয়েছে। এই ব্রিকসের প্রধান মোক্ষ হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ডলারের আধিপত্যমুক্ত একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা বিনির্মাণ।
উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাকি ভারতের যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া চিকেন’স নেকখ্যাত শিলিগুড়ি করিডর সুরক্ষিত রাখতে পারছে। কিন্তু তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, আখাউড়া-সিলেট রেললাইন এবং সিলেট ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বিনিয়োগের সুবাদে এই অঞ্চলে চীনের যে অবাধ আনাগোনা নিশ্চিত করবে, তা ভারতের নিজ ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে দেশটির নিজস্ব যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ব্রিকসে বাংলাদেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা যে কেউ আন্দাজ করতে পারে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডরের একটি অংশ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভারতের বাংলাদেশে অনেক বেশি এবং প্রত্যক্ষ কৌশলগত অংশীদারি রয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত তার উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সেই রাজ্যগুলোতে সরকার চলাচল সুগম করেছে।
এছাড়া উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাকি ভারতের যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া চিকেন’স নেকখ্যাত শিলিগুড়ি করিডর সুরক্ষিত রাখতে পারছে। কিন্তু তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, আখাউড়া-সিলেট রেললাইন এবং সিলেট ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বিনিয়োগের সুবাদে এই অঞ্চলে চীনের যে অবাধ আনাগোনা নিশ্চিত করবে, তা ভারতের নিজ ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে দেশটির নিজস্ব যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
মণিপুর রাজ্যে যখন বিক্ষোভের আগুন ছড়াচ্ছে, মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত পারাপার থাকা চীনের ইউনান প্রদেশের রুইলি এলাকায় যখন নাগা বিদ্রোহীরা অভয়াশ্রম গড়ে তুলছে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপের নেতারা যখন মিয়ানমারের সাগাইং বিভাগে লুকিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছেন, তখন এই অঞ্চলে বিদেশি শক্তিগুলোর ও তাদের প্রতিনিধিদের সম্ভাব্য তৎপরতা ভারতের জন্য বিরাট ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজারের পেকুয়ায় বিএনএস শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটিতে (যেখানে চীনের তৈরি তিনটি সাবমেরিন নোঙর করা হবে) চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির নাবিকদের অনুমিত উপস্থিতিও ভারতকেও উদ্বিগ্ন করবে।
স্বল্পমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত দাবি করতে পারে, ঢাকাস্থ বন্ধুত্বপূর্ণ শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া তার কোনো বিকল্প নেই।
যা হোক, আগামী সাধারণ নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বয়স হবে ৭৬ বছর। বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের সঙ্গে কীভাবে কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক লেনদেন হবে—সে বিষয়ে ভারতকে এখনই একটি নীতি ঠিক করতে হবে। এছাড়াও ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের উত্তরোত্তর ভারতবিরোধী মেজাজকে বিবেচনায় নিতে হবে এবং ভারত যদি আবারও একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ফলাফলকে সমর্থন দেয় তাহলে সেই ভারতবিরোধী জন-মেজাজকে ভারতমুখী করে তোলার সম্ভাবনা থাকবে না।
শেখ হাসিনাকে দেওয়া বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতির কারণে ভারত হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দাঁড়াতে চায় না, কিন্তু একই সঙ্গে ভারত বাংলাদেশে চীনের আধিপত্য বিস্তার মেনে নিতে পারে না। সুতরাং, ভারতকে বাংলাদেশ প্রশ্নে আরও সৃজনশীল কূটনৈতিক নকশা প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু ভারতকে বেকায়দায় ফেলার জন্য চীন যখন তার দাবার ঘুঁটি নতুন করে সাজাচ্ছে, তখনো ভারতের কূটনীতিকে আলস্য ও ঝিমিয়ে পড়া ভাব গ্রাস করছে বলে মনে হচ্ছে।
ভারতের সংবাদপত্র বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ভারত ভূষণ ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক