আজ থেকে চার হাজার বছর আগে লিখিত মেসোপটেমিয়ার ‘এপিক অব গিলগামেশ’ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। গিলগামেশ ছিলেন উরুক (এটা বর্তমানে ইরাকের অংশ)–এর রাজা। ভয়ংকর শারীরিক শক্তির অধিকারী রাজা গিলগামেশ প্রজাবৎসল রাজা তো ছিলেনই না; বরং ছিলেন অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী এমনকি ‘ক্রমিক ধর্ষক’।
স্বাভাবিকভাবেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে রাজ্যের প্রজারা, ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। সেই প্রার্থনা শোনেন ইশ্বর এবং সৃষ্টির দেবী আরুরু সৃষ্টি করেন ‘এনকিদু’কে। তাকে গিলগামেশের সমপর্যায়ের শক্তি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। দেবতারা ভাবেন, গিলগামেশ এনকিদুকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, সংঘাতে জড়াবে, শক্তি ক্ষয় করবে এবং এতে প্রজারা ভালো থাকবে।
গিলগামেশ আর এনকিদুর দেখা হওয়ার পর প্রচণ্ড মারামারি হয় দুজনের মধ্যে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না এবং স্বাভাবিকভাবেই দুই মহাশক্তিধর প্রতিপক্ষ তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে দুজন হয়ে ওঠেন দারুণ বাস্তববাদী। তাঁরা বুঝতে পারেন নিজেদের মধ্যে এভাবে যুদ্ধ করে তাঁরা শুধু একজন অপরজনের ক্ষতিই করতে পারবেন। তার চাইতে যদি দুজনে বন্ধু হয়ে যায়, তাহলে সেটা দুজনেরই স্বার্থ রক্ষা করবে। যে পরিকল্পনা নিয়ে দেবতারা এনকিদুকে সৃষ্টি করেছিলেন, সেটি মাঠে মারা যায়। এই গল্পে আমরা ফিরে আসব আবার, তবে তার আগে শ্রীলংকার চলমান সংকট নিয়ে আমাদের দেশে তুলনামূলক কম আলোচিত একটি বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।
তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের পর রনিল বিক্রমাসিংহে যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি সংবিধান রক্ষা করতে এসেছি।’ কিংবা শ্রীলঙ্কার সাবেক সেনাপ্রধান (বর্তমানে রাজনীতিবিদ) শরৎ ফনসেকা শ্রীলঙ্কার চলমান আন্দোলনকে বলেছিলেন, সেটি সংবিধান অনুসরণ করে হচ্ছে না এবং গণ-আন্দোলনের দাবিও সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে নয়। সংবিধান নিয়ে এমন আরও অনেক বক্তব্য আছে শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতাসীন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে।
কথাগুলো আমাদের কাছে পরিচিত লাগছে নিশ্চয়ই। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতা দখলকারী ও অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায় শাসকেরা ঠিক এভাবেই সংবিধানকে একটি দৈববাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। নিতান্ত জাগতিক প্রয়োজনে তৈরি, প্রয়োজনে পরিবর্তন-পরিবর্ধন, এমনকি পুরোপুরি বদলে ফেলার যোগ্য ‘সংবিধান’ শব্দটির আগে সে কারণে ‘মহান’, ‘পবিত্র’ এসব শব্দ যোগ করার প্রবণতা দেখা যায়।
২০তম সংশোধনীতে গোতাবায়া রাজাপক্ষে সাংবিধানিক কাউন্সিল বিলুপ্ত করে দেন, যেটি প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট ও আপিল আদালতের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল, নির্বাচন কমিশন, অডিট কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জাতীয় প্রকিউরমেন্ট কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনও নিয়োগ করত।
সেসব দেশে যেখানে সাংবিধানিকভাবে এবং চর্চায় অন্তত ক্ষমতার পৃথক্করণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) মোটামুটি ভালোভাবে কাজ করছে। গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, গণতন্ত্র ধ্বংস বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন আর কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক দল কিংবা কোনো এক সেনাপ্রধানের সামরিক ক্যু–এর মাধ্যমে হয় না। এটা বরং হয় কোনো ফ্যাসিবাদী/চরম ডানপন্থী দল/ব্যক্তির হাত ধরে।
প্রেসিডেন্টের সব কর্মকাণ্ডকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি অভিযোগ আনা যাবে না। ২০তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের হাতে মন্ত্রণালয় থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়। গোতাবায়া রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রেখেছেন নিজ হাতে। নিজের ইচ্ছেমতো ব্যক্তিদের সমন্বয়ে যত ইচ্ছা, ততজন মন্ত্রী নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্টকে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ২০তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে অকল্পনীয় পরিমাণ একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এটা সত্য, কিন্তু শ্রীলংকার সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেকটাই হারিয়ে যায়, যখন ১৯৭৮ সালে বর্তমান সংবিধানটি প্রণীত হয়। শ্রীলঙ্কার নাগরিকেরা সঠিকভাবেই সংবিধানকেন্দ্রিক সংকট শনাক্ত করতে পেরেছেন, তাঁরা তাঁদের যাবতীয় দাবিদাওয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছেন একটি নতুন সংবিধানের কথা। অনেকেই চাইছেন, শ্রীলঙ্কার আগামী সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে, যেটি নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে।
বিখ্যাত বই হোয়াই ন্যাশনস ফেইল–এর লেখকদ্বয় ড্যারন এসেমাগলু এবং ইয়ান রবিনসন তাদের সাম্প্রতিকতম বই দ্য ন্যারো করিডর; স্টেইটস, সোসাইটিস অ্যান্ড দ্য ফেইট অব লিবার্টি গ্রন্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এক নতুন প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যাচ্ছে, অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে সেপারেশন অব পাওয়ার নিশ্চিত করার পরও সেখানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পারস্পরিক বৈপরীত্যকে কমিয়ে এনে একে অপরকে ছাড় দিতে শুরু করে। এটাকেই তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘গিলগামেশ প্রবলেম’। ‘এপিক অব গিলগামেশ’-এ গিলগামেশ এবং এনকিদু যেমন পরস্পরের মধ্যে সংঘাত করে বুঝতে পারে, এতে তাদের পরস্পরের কোনো লাভ হবে না; বরং ক্ষতি হবে, তেমনি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ বুঝতে শুরু করে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত যত কম হয়, ততই তাদের লাভ হবে।
গিলগামেশ আর এনকিদু পরস্পরের বন্ধু হওয়ার ফলে তাদের নিজেদের লাভ হলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছিল উরুক রাজ্যের জনগণের। ঠিক একইভাবে এখন রাষ্ট্রের অঙ্গগুলো তাদের পারস্পরিক স্বার্থে যদি পরস্পরকে ছাড় দিতে থাকে, ক্ষতি হয় জনগণের। এই ক্ষতি কীভাবে সামাল দিতে হবে, কীভাবে সমাজ দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রকে এই পথ থেকে দূরে রেখে নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করবে, সেই লক্ষ্যে কীভাবে নাগরিকেরা সামাজিক শক্তির উন্নয়ন ঘটাবেন, উক্ত বইয়ে সেই আলোচনাগুলো করা হয়েছে। পৃথিবীর গণতন্ত্রের হালের আলোচনা এগুলোই।
এই আলোচনা হচ্ছে, সেসব দেশে যেখানে সাংবিধানিকভাবে এবং চর্চায় অন্তত ক্ষমতার পৃথক্করণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) মোটামুটি ভালোভাবে কাজ করছে। গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, গণতন্ত্র ধ্বংস বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখন আর কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক দল কিংবা কোনো এক সেনাপ্রধানের সামরিক ক্যু–এর মাধ্যমে হয় না। এটা বরং হয় কোনো ফ্যাসিবাদী/চরম ডানপন্থী দল/ব্যক্তির হাত ধরে। তেমন কেউ ক্ষমতায় থাকলে তাঁরা তাঁদের নির্বাহী ক্ষমতার চৌহদ্দি পেরিয়ে রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গের চৌহদ্দির মধ্যে থাকা বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন। এই চর্চা ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে ক্ষয় করতে শুরু করে। এই ক্ষয় বোঝানোর জন্য অনেকেই ব্যবহার করছেন এই চীনা প্রবাদটি—ডেথ বাই হান্ড্রেড কাটস।
কীভাবে সংবিধানে এমন সব বিষয় যুক্ত করা যায়, যেগুলো গণতন্ত্রের পাহারাদার হয়ে উঠবে, এটা সংবিধান হালের মূল আলোচনা। এই আলোচনায় উদাহরণ হিসেবে আসে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের কথা। বিশ্বের তুলনামূলক সংবিধানের বিশেষজ্ঞদের মতে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কয়েকটি সংবিধানের একটি। সেই সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী, আইন (সংসদ) এবং বিচার বিভাগকে পৃথক্করণে যথেষ্ট শক্ত পদক্ষেপ আছে। একই সঙ্গে আছে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য তৈরি করা কতকগুলো প্রতিষ্ঠানের শক্ত সংবিধানিক ভিত্তি।
গণতন্ত্রকে সুরক্ষার দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের নবম বিভাগে কতকগুলো প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা বলা আছে। এগুলো হলো—১. জনগণের রক্ষাকারী (পাবলিক প্রটেক্টর), ২. দক্ষিণ আফ্রিকার মানবাধিকার কমিশন, ৩. ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জনগণের অধিকার সংরক্ষণ এবং প্রচারের জন্য কমিশন, ৪. লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণ কমিশন, ৫. অডিটর জেনারেল, ৬. স্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানে আছে—সাংবিধানিক আদালত, দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীন যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ, পুলিশের অপরাধ তদন্তের জন্য স্বাধীন সংস্থা, মধ্যস্থতা-মিটমাট-সালিশ কমিশন, জাতীয় প্রসিকিউট কর্তৃপক্ষ, বিচার সেবা কমিশন, আর্থিক এবং রাজস্ব কমিশন, রাষ্ট্রীয় কর্ম কমিশন, সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা বোর্ড, জাতীয় যুব উন্নয়ন এজেন্সি, বিশেষ তদন্ত ইউনিট।
বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো নানা অভিযোগ আছে। এই অভিযোগগুলোর ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আদালতে যাওয়ার সাহস রাখেন না, আর কেউ গেলেও প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললে চলে। কারণ, এসব অভিযোগের তদন্তও পুলিশ করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আমাদের মতো দেশেও আছে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, এগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান যেভাবে তাত্ত্বিকভাবে অন্তত রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোর মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করে, সেটি খুব বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে, যা এই কলামের পরিসরে সম্ভব নয়। তবে আমি অন্তত একটি উদাহরণ দিতে চাই।
বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো নানা অভিযোগ আছে। এই অভিযোগগুলোর ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আদালতে যাওয়ার সাহস রাখেন না, আর কেউ গেলেও প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললে চলে। কারণ, এসব অভিযোগের তদন্তও পুলিশ করে। ‘নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন ২০১৩’ তৈরির পর মাত্র একটি মামলায়, ২০১৪ সালে মিরপুরের জনিকে হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যায় প্রাথমিক সাজা হয়েছে। এর কারণ, শুধু এই একটি ক্ষেত্রে বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ঘটনাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ পুলিশের এসব ভয়ংকর ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের জন্য সাংবিধানিকভাবেই একটি স্বাধীন সংস্থা তৈরি করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
বাংলাদেশের সংবিধানকে মাথায় রাখলে এসব আলোচনাকে অনেকটাই অহেতুক বলে মনে হবে। আমরা এখনো একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর ন্যূনতম প্রয়োজন অর্থাৎ রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণই নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা কল্পনাও করতে পারি না, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা এমন কোনো নিপীড়নমূলক আইন সরকারি দল সংসদে এনেও পাস করাতে পারছে না। কারণ, তাদের দলেরই অনেক সদস্য এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দেশের আইন বিভাগ কার্যত সরকারি দলের। আরও স্পষ্টভাবে বললে, সরকারপ্রধানের ইচ্ছার রাবার স্ট্যাম্প হয়ে আছে। তাঁর চাওয়াই আইন হয়ে যাবে।
সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগে (নিম্ন/বিচারিক আদালত) নির্বাহী বিভাগের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব আছে। আবার আছে গোঁজামিলও—অনুচ্ছেদ ১১৬ সংবিধানেরই অনুচ্ছেদ ২২ (যা ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’-এর অংশ) এবং অনুচ্ছেদ ১০৯–এর পরিপন্থী। অর্থাৎ বাংলাদেশে নির্বাহী বিভাগ আর দুই বিভাগকে সাংবিধানিকভাবে একেবারেই কবজা করে রেখেছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের সংবিধান দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা দিয়ে একজন সর্বশক্তিমান প্রধানমন্ত্রী বানাবেই। সংবিধান অনুসারেই নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা সামষ্টিকভাবে মন্ত্রিসভার কাছে নয়, প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের সংবিধান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরির একেবারে প্রাথমিক মানদণ্ড, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণই (সেপারেশন অব পাওয়ার) নিশ্চিত করতে পারেনি। সেখানে অন্যান্য আলাপকে আসলেই মনে হবে, অনেক পরের আলোচনা। কিন্তু না, সব আলোচনা এখনই করতে হবে, একসঙ্গে।
সংবিধান আদতে প্রযুক্তির মতো। প্রযুক্তির মতোই নতুন সময়ের নতুন বাস্তবতায় নতুন সংকট-চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে সংবিধানকে পাল্টাতে হয়। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার যে সংবিধানের কথা এতক্ষণ বললাম, সেটি ১৯৯৪ সালে প্রথম গৃহীত হওয়ার পর থেকেই অসাধারণ বলে স্বীকৃত হয়েছিল। কিন্তু সেই সংবিধানই আজ পর্যন্ত ১৬ বার সংশোধিত হয়েছে।
লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট, সংবিধানের আলোচনা অতি জরুরি সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আলোচনায় যেন আমরা এই বিভ্রমে না পড়ে যাই যে খেটেখুটে একটি অসাধারণ সংবিধান তৈরি করে ফেলতে পারলে, সেটি আপনা-আপনিই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে সক্ষম হবে। সেটিই যদি হতো, তাহলে তো ‘শ্রেষ্ঠতম’ গণতান্ত্রিক সংবিধানের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকারই হওয়ার কথা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো উদার গণতান্ত্রিক দেশ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে আরও কিছু বিষয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সে আলাপ আরেক দিন।
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অধ্যাপক