অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক শক্তি

আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার
কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাতে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। ফলে শুক্রবার (১৯ জুলাই ২০২৪) প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত এ লেখা এখন অনলাইনে প্রকাশ করা হলো।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে একটি হতাশা, ব্যর্থতা বুকের গভীরে কাজ করত। আমাদের মূলধারার ছাত্রছাত্রীরা ক্রমাগত অরাজনৈতিক হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে ঢুকে পড়া, বিসিএস দিয়ে সরকারি কর্মচারী হওয়া অথবা যেকোনো মূল্যে বিদেশে চলে যাওয়া তাদের লক্ষ্য। তাদের কেউ কেউ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত বটে, তবে তার ধরনগুলো মূলত অরাজনৈতিক। যে অংশ রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে, তাদের সংযুক্তির ক্ষেত্র খুব সীমিত।

 কিন্তু ২০১৮–তে এসে দেখলাম ছাত্রছাত্রীরা তাদের জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে সোচ্চার হয়েছে। কোনো ছাত্রসংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় না গিয়ে তাদের দাবি তারা নিজেরাই আর্টিকুলেট করছে এবং তা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কাছে সম্মানজনকভাবে তুলে ধরছে।

এই প্রক্রিয়ার ভেতরে আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী চোখ অবলোকন করল কত দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজনৈতিক ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজস্ব দাবিতে সংগঠিত করছে নিজেদের। কোটা সংস্কার নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল ভাবেনি, এ দাবি তাদের নিজস্ব। ২০১৮–তেই সে আন্দোলন থিতু হয়, যখন সরকারপ্রধান কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত দেন।

পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব অনুযায়ী চার ধরনের ইন্টারেস্ট গ্রুপের মধ্যে হঠাৎ করে কোনো একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্বার্থগোষ্ঠী, যাকে তাঁরা নাম দিয়েছেন এনোমিক ইন্টারেস্ট গ্রুপ, সাময়িকভাবে খুব শক্তিশালী হলেও পরে তা আর কাজ করে না। কারণ, তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নেই। কিছুদিন ধরে পুনরায় শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন গ্রুপের বেলায় কিন্তু এই তত্ত্ব অসার প্রমাণিত হয়ে গেল।

কোটা পুনর্বহালের হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত তৎপরবর্তী সরকারের আপিলকে কেন্দ্র করে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গ্রুপ দক্ষতার সঙ্গে জনসমক্ষে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। সরকারি– বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের পাশে নিয়ে আসতে পেরেছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও থেমে থাকেনি।  

ছাত্রলীগের অমানবিক, অরাজনৈতিক আচরণ, হাসপাতালের অভ্যন্তরে চড়াও হয়ে নিগ্রহ, ছয়-ছয়টি নিষ্কলঙ্ক নিষ্পাপ প্রাণের বলিদান, পুলিশের হাতে নিরস্ত্র আবু সাঈদকে হত্যা এই আন্দোলনকারীদের তাদের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে কোনো ভুল পদক্ষেপের দিকে ধাবিত করেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের পরও তারা বলতে পেরেছে এই ক্যাম্পাস আমার, ভাই, আপনারা দয়া করে চলে যান। এতটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং ধৈর্য তারা কোথায় পেল? এই অদম্য সাহস শুধু ছাত্ররাই দেখাতে পারে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে এমন একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ব্যাখ্যা খোঁজা আমার দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনা ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এর একটি হলো অতীতের বিভিন্ন আন্দোলন অথবা বিভিন্ন দেশের সমসাময়িক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করে এর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা।

১৯৯০–এর গণ-অভ্যুত্থান ছিল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। সামরিক শাসক এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আন্দোলন। ছাত্রদের এই কোটাবিরোধী আন্দোলন কোনো সরকার হটানোর আন্দোলন নয়। ৬৯–এর ছাত্র আন্দোলনও ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন। দুটি ক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীরা নয়, অংশগ্রহণকারী সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও স্পষ্টভাবে নিজেদের রাজনৈতিক দল থেকে পৃথক রেখেছে। দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছে, এই আন্দোলন তাদের, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। 

১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আমি এই আন্দোলনের বেশ কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করছি। ভাষা আন্দোলন কোনো সরকার হটানোর আন্দোলন ছিল না। সেটি ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং এর শুরু ও অগ্রযাত্রা ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমেই।

ভাষা আন্দোলন পেয়েছিল আপামর জনসাধারণের সমর্থন। প্রচারস্বত্ব আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় সংক্ষুব্ধ কৃষক, লবণ বিদ্রোহীরা, রেজিস্ট্রেশন নবায়ন না করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত নেতারা, সাধারণ রিকশাচালক, কারখানার শ্রমিক, সবাই সমর্থন দিয়েছিল সেই আন্দোলনকে। এই রাজনৈতিক আন্দোলনের ছিল এক অর্থনৈতিক ভিত্তি। ভাষা আন্দোলন তাই শুধু বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানে সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষে মূল মাইলফলক।

কোটা সংস্কার আন্দোলন দুই দিন আগেও ছিল একটি একমুখী আন্দোলন—যুক্তিসংগত কোটা বহাল রেখে মেধাকে গুরুত্ব দেওয়া। দুই দিন আগে ছাত্রলীগের সহিংস কার্যক্রমের পরিণতিতে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে নিরাপদ হল নিশ্চিত করার আন্দোলন। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তার ছাত্রসংগঠনের যে সমান্তরাল প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সেটি বন্ধ করার দাবিটিও এখন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রভোস্ট ছাত্রদের এই দাবিকে সমর্থন করেছেন এই মর্মে সার্কুলার ইস্যু করে যে হলগুলোতে কোনো দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে না, গণরুম থাকবে না ইত্যাদি। বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে আমি দেখেছি হলের একটি সিটের জন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে নেতাদের অন্যায় হুকুম পালন করতে হয় এবং তাদের কাছে রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে শিখতে হয় বড় ভাইদের (নেতাদের) সম্মান প্রদর্শনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড।

তা ছাড়া কোটা আন্দোলনে এখন যুক্ত হয়েছে আবু সাঈদের দিনমজুর বাবা, তার গ্রামের হাজার হাজার লোক, বিভিন্ন শহরের রিকশাচালক, স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরাসহ আরও অনেকে। 

সুস্থ রাজনৈতিক চর্চায় গড়ে ওঠা এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকার খুব সহজে সবার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য পরিণতিতে নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সরকার সে পথে না হেঁটে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজাকার বিতর্কে নিয়ে এসে তাঁদের উল্টো অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জনগণের সমর্থন নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন এগিয়ে গেছে। গতকাল আইনমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে আলোচনায় বসতে চেয়েছেন।

আমার শঙ্কা, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকার অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে কি না? 

  • ড. তাসনিম সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়