গত এক বছরে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দেশে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল। তিনটির চরিত্রই অভিন্ন। এসব দেশের সরকার হয় খোলামেলাভাবে কর্তৃত্ববাদী অথবা তারা কর্তৃত্ববাদের পথে হাঁটছে। তথ্যব্যবস্থা সরকারের হাতের মুঠোয়; বিচারব্যবস্থা সরকারের নির্দেশে ওঠে–বসে; নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়; বিরোধীদের যখন খুশি, যেমন খুশি হেনস্তা করা যায়। এ অবস্থায় নির্বাচন, তা জাতীয় পর্যায়ে হোক অথবা স্থানীয়, তাতে বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন।
প্রথম নির্বাচন তুরস্কে। এটি গত বছর মে মাসের কথা। একটানা ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এই প্রথমবার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। অর্থনীতির মন্দাবস্থা তো ছিলই, তার ওপর অব্যাহত দুর্নীতি ও ক্ষমতার দলীয়করণের অভিযোগ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বিরোধীদলীয় জোট। এই জোটের প্রার্থী ছিলেন ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় মেয়র একরেম ইমামেগলু। বিপদ টের পেয়ে এরদোয়ান তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও কর ফাঁকি দেওয়ার মামলা ঠুকে দিলেন।
এসব মামলার কোনো ভিত্তি না থাকলেও এরদোয়ানের অনুগত আদালত ইমামেগলুকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেন। তাঁর জায়গায় বিরোধী জোটের বিকল্প প্রার্থী কিলিচদারোগলু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত তথ্যব্যবস্থার নতুন টার্গেট হয়ে ওঠেন।
এক হিসাবে দেখেছি, নির্বাচনের আগের মাসে জাতীয় তথ্যমাধ্যমে এরদোয়ানের জন্য যেখানে ৩২ ঘণ্টা বরাদ্দ করা হয়, সেখানে কিলিচদারোগলুর জন্য ছিল ৩২ মিনিট। সংবাদকর্মীদের ওপরেও নেমে আসে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কারণে-অকারণে জেল। বিরোধী জোটের জন্য চাঁদা দিলেও তা অপরাধ বিবেচিত হতো।
অন্যদিকে এরদোয়ান সরকারি রাজস্ব খাতকে নিজের নির্বাচনী প্রয়োজনে যেমন খুশি ব্যবহার করেছেন। নির্বাচনের চার সপ্তাহ আগে তিনি সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা করেন। শহুরে মানুষদের জন্য বিনা মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এত করেও এরদোয়ান ৫০ শতাংশ ভোট পেতে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় দফা ভোটের ব্যবস্থা করা হয়, তাতে সামান্য ব্যবধানে তিনি বিজয় নিশ্চিত করেন।
দ্বিতীয় উদাহরণ রাশিয়া। দুই দশক ক্ষমতায় থাকার পর এ বছর মার্চে সেখানে আরও ছয় বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি খোলামেলাভাবেই কর্তৃত্ববাদী। বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে তিনি শুধু মামলা ঠোকেন বা জেলে পাঠান তা নয়; তাঁদের হয় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা অথবা ২৪ তলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া তাঁর প্রিয় কৌশল। সিভিল সোসাইটি হয় নিষিদ্ধ, নয়তো তারা বিদেশি এজেন্ট। কারও টুঁ শব্দটি করার উপায় নেই।
এটি শুধু ভারত, রাশিয়া বা তুরস্কে নয়; গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত আরও অনেক দেশের পরিচিত অভিজ্ঞতা। এমন এক সময় ছিল যখন রাস্তায় ট্যাংক নামিয়ে বা ফৌজি লেলিয়ে ক্ষমতা দখল করা হতো। এখন তা না করে গণতন্ত্রের লেবাসে ক্ষমতা দখলে রাখা হয়। কেউ কেউ বলবেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে যে পরিহাস, তা–ও এই প্রবণতার আরেক উদাহরণ।
আলেক্সি নাভালনি নামের একমাত্র বিরোধী রাজনীতিক তাঁর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বিষ খাইয়ে মারতে ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ায়। সেখানে জেলে তাঁর মৃত্যু হলো। বলা বাহুল্য, কেন ও কীভাবে সরকারের হেফাজতে থাকা বন্দী মারা যান, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
রাশিয়ায় ভোট বাধ্যতামূলক। সরকারি কর্মচারীদের বলা হলো, কোথায় ও কীভাবে ভোট দিয়েছ, অবিলম্বে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাও। একটি বিশেষ ইন্টারনেট অ্যাপ তৈরি করা হলো, যার মাধ্যমে জানাতে হবে কোথায় শুধু তাঁরা নন, তাঁদের নিকট স্বজনেরাও ভোট দিয়েছেন। এমন কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে খোলা মাঠে একাই খেলে ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে আবার নির্বাচিত হলেন পুতিন।
আমাদের তৃতীয় উদাহরণ প্রতিবেশী ভারত। সম্প্রতি এই নির্বাচনের ফলাফল আমরা পেয়েছি। বড় ধরনের ধাক্কা খেলেও নিজ কোয়ালিশনের সদস্যদের মদদে নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকেই ৪০ দিন ধরে প্রায় ৬৪ কোটি ভোটারের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ বলে ‘তিন-উল্লাস’ জানিয়েছে, কিন্তু সত্যিই কি এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল?
কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করুন। তুরস্ক ও রাশিয়ার মতো ভারতেও বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর জেল-জরিমানা নিয়মিত ব্যাপার। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা জানিয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে সরকারি নির্দেশে যেসব রাজনীতিকের বিরুদ্ধে তদন্ত গঠিত হয়েছে, তার ৯৫ শতাংশই মোদি সরকারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে, এই অভিযোগে প্রধান বিরোধী রাজনীতিক রাহুল গান্ধীকে জেল খাটতে হয়েছে। নির্বাচনের এক মাস আগে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালকে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকেও জেলে পাঠানো হয়।
বিরোধীদের ঠেকাতে মোদি সরকারের আরেক প্রিয় পদ্ধতি তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা; যেমন নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অনিয়মের অভিযোগে জব্দ করা হলো। রাহুল গান্ধী অভিযোগ করে বলেছেন, অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ফলে তাঁর দল নির্বাচনী খরচ বহন করতে পারছে না, কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না।
মোদি সরকার একদিকে বিরোধীদের অর্থ জব্দ করেছে, অন্যদিকে দেশের অতিধনী ও অতি দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দেদার চাঁদা নিয়েছে। ২০১৭ সালে মোদি সরকার তথাকথিত ‘ইলেকটোরাল বন্ড’ চালু করে, যার মাধ্যমে ভারতীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেনামিতে তাদের প্রিয় রাজনৈতিক দলে অর্থ জোগান দিত। জানা গেছে, এই বন্ডের মাধ্যমে কম করে হলেও দুই বিলিয়ন ডলার সংগৃহীত হয়েছে, যার অধিকাংশই গেছে বিজেপির পকেটে।
নির্বাচনের আগে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা জানায়, এই বন্ডের মাধ্যমে দুর্নীতি মামলায় ঝুলে আছে, এমন চিহ্নিত অপরাধীদের কাছ থেকে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি কোটি কোটি রুপি চাঁদা পেয়েছে। তাঁদের একজন হচ্ছেন মহেন্দ্র কুমার জালান। তাঁর নামে হাজারটা অনিয়মের অভিযোগ ও মামলা রয়েছে, তা জানা সত্ত্বেও এই রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোদির দল ৪২ মিলিয়ন ডলার চাঁদা অথবা উৎকোচ যা–ই বলুন, গ্রহণ করে। (দেখুন: https://wapo.st/4ejWCdz)। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে অবশ্য এই বন্ড ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই। তামিলনাড়ুর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী পালানিভেল থিয়াগা নিভেল ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় এক দীর্ঘ নিবন্ধে দাবি করেছেন, ভারতের নির্বাচন কমিশন হয় দুর্নীতিপরায়ণ অথবা অযোগ্য। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত নানা অনিয়ম তুলে ধরে তিনি মন্তব্য করেছেন, এই কমিশন ভারত ও তার জনগণের জন্য এক নিদারুণ অভিশাপ।
সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমানদের ব্যাপারে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে বলেছেন, মথুরা ও গুজরাটের মুসলিম ভোটারদের নাম তালিকা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে; যেমন গুজরাটে ৭০০ মুসলিম জেলে, গত বছর যাঁদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়, তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় তোলা হয়নি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার নির্বাচনী আচরণবিধির পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও মোদি যেভাবে মুসলিমদের ‘বহিরাগত’ বলে আক্রমণ করেছেন, সে ব্যাপারে তারা টুঁ শব্দটি করেনি। (দেখুন: http://bit.ly/4bW67ht)। কর্ণাটকে একাধিক বেসরকারি সংস্থা মোদির ‘ঘৃণা ভাষণ’ বন্ধের দাবি জানিয়ে মামলা পর্যন্ত করেছিল, অনুগত ইলেকশন কমিশন তাতে কর্ণপাতের কোনো প্রয়োজন দেখেনি।
অন্যকথায় রাশিয়া বা ভারত যেখানেই হোক, ভোটের ব্যবস্থা ঠিকই আছে, কিন্তু সে ভোটের ফলাফল যাতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায়, তার জন্য প্রতিটি নুড়িকণা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টার কোনো কমতি নেই। এই ব্যবস্থাকে আমরা বড়জোর ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ বলতে পারি।
প্রায় ২০ বছর আগে ভারতীয় মার্কিন লেখক ফরিদ জাকারিয়া মন্তব্য করেছিলেন, পৃথিবী ক্রমান্বয়ে অনুদার গণতন্ত্রের পথে চলছে। ১৯৯৭ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে তিনি লিখেছিলেন, আপাতভাবে নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত হলেও এমন অনেক সরকার রয়েছে, যারা শাসনতান্ত্রিক বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে বা তার অপব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। এর ফল একটাই, দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন।
এটি শুধু ভারত, রাশিয়া বা তুরস্কে নয়; গণতান্ত্রিক হিসেবে পরিচিত আরও অনেক দেশের পরিচিত অভিজ্ঞতা। এমন এক সময় ছিল যখন রাস্তায় ট্যাংক নামিয়ে বা ফৌজি লেলিয়ে ক্ষমতা দখল করা হতো। এখন তা না করে গণতন্ত্রের লেবাসে ক্ষমতা দখলে রাখা হয়। কেউ কেউ বলবেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে যে পরিহাস, তা–ও এই প্রবণতার আরেক উদাহরণ।
তা সত্ত্বেও ভারতের নির্বাচনকে আমি ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ বলব। গত ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে মোদি নিজেকে সব ধরাছোঁয়ার বাইরে ভাবতে শুরু করেছিলেন। এমনকি তিনি নিজেকে স্বাভাবিক মাটির মানুষ না ভেবে ঈশ্বরের পাঠানো কোনো অবতার ভাবা শুরু করেছিলেন। সব বাধা সত্ত্বেও ভারতীয় ভোটাররা এই নির্বাচনে তাঁকে নিজের কল্পিত স্বর্গ থেকে টেনে মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। এ তো গণতন্ত্রেরই জয়।
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক