একদা ইসরায়েলের নেতা ইহুদ বারাক বলেছিলেন, ‘আমরা যখন লেবাননে ঢুকব, সেখানে হিজবুল্লাহর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। দক্ষিণের শিয়ারা আমাদের সুগন্ধি ধান আর ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবে। সেখানে আমাদের যাওয়ার ক্ষেত্র হিজবুল্লাহ তৈরি করে দিল।’
ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহ দুইবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। প্রথমটা ১৯৮৫ থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরব্যাপী গেরিলাযুদ্ধ। এই সংঘাতে হিজবুল্লাহ বিজয়ী হয়, কিন্তু তাদের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতার চেয়ে বরং রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে বড় ধাক্কা লাগে।
দ্বিতীয় যুদ্ধটা ছিল আরও বিস্ময়কর। ২০০৬ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসের সেই সংঘাতে হিজবুল্লাহ পদাতিক যুদ্ধ, সাঁজোয়া যান ও ট্যাংকবিরোধী কৌশল এবং সাইবার ও তথ্যপ্রযুক্তি হামলায় হিজবুল্লাহ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছিল। রসদ ফুরিয়ে আসা সত্ত্বেও যুদ্ধের পুরোটা সময় তারা রকেট হামলা অব্যাহত রাখে।
২০০৬ সালের এই যুদ্ধের ফলাফল ড্র হয়। ১৯৪৮ সালের পর কোনো আরব বাহিনী ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে এতটা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
বর্তমানে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ তৃতীয় লড়াইয়ের মুখোমুখি। সেই যুদ্ধ যদি সত্যিই শুরু হয়, তাহলে সামরিক দিক থেকে তার ফলাফল কী হবে?
৭ অক্টোবর থেকে হিজবুল্লাহ ও দক্ষিণ লেবাননে তাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়মিতভাবেই ইসরায়েলের গোলা বিনিময় চলছে। ধাপে ধাপে পাল্টাপাল্টি হামলার তীব্রতাও বাড়ছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এসে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলের দিকে রকেট হামলার সংখ্যা গাজা থেকে চালানো রকেট হামলার সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। এখন গড়ে প্রতিদিন ১০০টি রকেট হামলা করছে হিজবুল্লাহ। ২০০৬ সালে তারা গড়ে প্রতিদিন ১২০টি রকেট হামলা করেছিল।
ইসরায়েল তাদের তথাকথিত ‘দাহিয়া মতাদর্শ’ শত্রুদের শায়েস্তা করার কাজে ব্যবহার করছে। এই মতবাদের মূল কৌশল হলো, শত্রুদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে, বেসামরিক লোকজন ও তাদের অবকাঠামোর ওপর নির্বিচারে হামলা চালানো। সম্প্রতি গাজায় এই কৌশলের প্রয়োগ করছে ইসরায়েল। দক্ষিণ লেবাননের ক্ষেত্রেও স্বল্পমাত্রায় এই প্রয়োগ তারা করছে।
কৌশলগত দিক থেকে দূরপাল্লার মিসাইল ইসরায়েলের জন্য সমস্যার কারণ। হিজবুল্লাহকে যদি ইসরায়েলি বাহিনী উত্তর দিকের লিতানি নদী পর্যন্ত হটিয়েও দিতে পারে, তারপরও ইসরায়েলে হামলার সংখ্যা কমবে না। হিজবুল্লাহর কাছে এখন ৬৫ হাজার মিসাইল রয়েছে, যেগুলোর পাল্লা ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে। আর ২০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লার মিসাইলের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। এর মানে হচ্ছে, হিজবুল্লাহ লিতানি নদীর উত্তরাঞ্চল থেকে তেল আবিবে মিসাইল হামলা করতে সক্ষম।
এই মতবাদের সারবত্তা হলো, প্রতিবেশী দেশগুলোর বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালাতে হবে এই কারণে যে তারা সশস্ত্র যোদ্ধাদের রকেট হামলা চালানোর অনুমতি দিচ্ছে। বিদ্রোহ নির্মূলে পশ্চিমা চিরায়ত কৌশল হলো বিদ্রোহীদের ‘মন ও প্রাণ’ জিতে নাও। কিন্তু ইসরায়েলের দাহিয়া মতাদর্শ হলো, বোমা হামলা করে বেসামরিক জনসাধারণের ‘মন ও প্রাণ’ গুঁড়িয়ে দাও, যাতে বিদ্রোহীরা কোনোভাবেই ইসরায়েলে হামলা করার মতো পরিবেশ না পায়।
এই কৌশল প্রয়োগ করে ইসরায়েল তার কিছু প্রতিপক্ষের শক্তি কমাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই কৌশল কিছু শক্তিশালী শত্রুর জন্ম দিয়েছে, যারা সর্বাত্মক যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য রাখে।
২০০৬ সালের হিজবুল্লাহ আর ২০২৪ সালের হিজবুল্লাহ শক্তিমত্তার দিক থেকে এক নয়। হিজবুল্লাহর এখনকার সামরিক সক্ষমতা যেকোনো বিশাল আকারের অ-রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও অনেক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তির মূল ভিত্তি মূলত স্থলবাহিনী। যোদ্ধা ও মজুত বাহিনীসহ হিজবুল্লাহর মোট সেনাসংখ্যা এক লাখের বেশি।
হিজবুল্লাহ বাহিনীর শক্তির মূল ভিত্তি রাদওয়ান ফোর্স। এই অভিজাত ইউনিটের জনবল দুই হাজার থেকে তিন হাজার। রাদওয়ান ফোর্সের সেনাদের স্নাইপিং অভিযান, বৈরী পরিবেশে যুদ্ধ এবং শত্রুশিবিরে ঢুকে অভিযান পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
হিজবুল্লাহর স্থলবাহিনীর ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানবিরোধী ইউনিটও রয়েছে। আমার হিসাবমতে, হিজবুল্লাহর কাছে এখন ১৯ ধরনের বেশি ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট সিস্টেম রয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার তৈরি লেজার-গাইডেড করনেটস এবং আমেরিকার তৈরি ওয়্যার-গাইডেড টিওডব্লিউএস–জাতীয় মিসাইলও রয়েছে।
সিরিয়া যুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহ ট্যাংক নিয়ে যুদ্ধ করতে শিখেছে। ইসরায়েলের বিমান হামলা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হিজবুল্লাহ তাদের সাঁজোয়া যানের বড় অংশটিই সিরিয়ায় রেখেছে। হিজবুল্লাহর কাছে মূলত পুরোনো সোভিয়েত আমলের টি-৫৪/ টি-৫৫ ও টি-৭২ ধরনের ট্যাংক রয়েছে।
হিজবুল্লাহর ট্যাংক যুদ্ধের চেয়ে ট্যাংকবিরোধী পদাতিক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলি বাহিনী ট্যাংক যুদ্ধে সুদক্ষ।
আমার গবেষণা সূত্রে বলতে পারি, হিজবুল্লাহর কাছে ১৩ ধরনের বেশি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। যদিও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাটি এখন পর্যন্ত হিজবুল্লাহর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। আকাশযুদ্ধ করার মতো ড্রোনের মজুত সীমিত। নৌযুদ্ধ করার সামর্থ্যও তাদের কম। তাদের কাছে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত নৌযান রয়েছে।
ইলেকট্রনিক ও সাইবার যুদ্ধের কিছুটা সক্ষমতা হিজবুল্লাহর আছে। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, তথ্য পরিচালনা ও পাল্টা গুপ্তচরবৃত্তি চালাতে সু-অভিজ্ঞ গোয়েন্দা ইউনিট তাদের রয়েছে। এ ছাড়া তারা একটি স্বাধীন যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পেরেছে।
হিজবুল্লাহর শক্তিশালী স্থলবাহিনী মূলত রকেট ও সাঁজোয়া যানের (হালকা, মাঝারি ও ভারী) ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ২০০৬ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে এসে সংখ্যা, পাল্লা, নির্ভুলতার দিক থেকে হিজবুল্লাহ রকেটব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
২০০৬ সালে ৩৪ দিনের যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ৪ হাজারটি রকেট ছুড়েছিল। এখন হিজবুল্লাহের অস্ত্রভান্ডারে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রকেট ও মিসাইল রয়েছে। এসব রকেট ও মিসাইল কাছের ও দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করার সক্ষমতা আছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে, ফালাক-১ রকেট ১০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে সক্ষম। ৫০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে পারে। অন্যদিকে জেলজাল মিসাইল ২০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম, ৬০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত বিস্ফোরক নিতে পারে।
কৌশলগত দিক থেকে দূরপাল্লার মিসাইল ইসরায়েলের জন্য সমস্যার কারণ। হিজবুল্লাহকে যদি ইসরায়েলি বাহিনী উত্তর দিকের লিতানি নদী পর্যন্ত হটিয়েও দিতে পারে, তারপরও ইসরায়েলে হামলার সংখ্যা কমবে না। হিজবুল্লাহর কাছে এখন ৬৫ হাজার মিসাইল রয়েছে, যেগুলোর পাল্লা ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে। আর ২০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লার মিসাইলের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। এর মানে হচ্ছে, হিজবুল্লাহ লিতানি নদীর উত্তরাঞ্চল থেকে তেল আবিবে মিসাইল হামলা করতে সক্ষম।
বর্তমানে হিজবুল্লাহর সম্ভাব্য স্থল আক্রমণের ঝুঁকির মুখে ইসরায়েল তাদের উত্তর দিকের সীমান্তে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু খুব দ্রুতই আক্রমণাত্মক অবস্থানে যেতে পারে। রক্ষণাত্মক থেকে আক্রমণাত্মক অবস্থানে যেতে হলে গাজা থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের ব্রিগেড সরিয়ে উত্তর দিকের সীমানায় নিয়ে যেতে হবে।
যাহোক, পরিস্থিতি এখন মীমাংসার অনেক বাইরে রয়ে গেছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অনেক বেশি বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি দরকার।
ওমর আশর দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের ক্রিটিক্যাল সিকিউরিটি স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে