এ দুই ‘পাপ’ কি অন্তবর্তী সরকারও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে

৩১ ডিসেম্বর যে বছরটি শেষ হলো, সেটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই বছরে বাংলাদেশে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। আবার এই বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতার ছাপ দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে। অনেকগুলো শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্প অনেকটা আতশবাজির মতো। বাইরে চাকচিক্য আছে, ভেতরে কোনো বস্তু নেই।

আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়ন দেখাতে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছিল। তার মধ্যে আবশ্যকীয় পদ্মা সেতু যেমন ছিল, তেমনি অনাবশ্যকীয় অনেক প্রকল্পও ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সাবেক আমলের অনেকগুলো প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করেছে। আমরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই; কিন্তু তারা যে অর্থনীতির স্থবিরতা কাটাতে পারছে না, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তার জবাব কী?

বিনিয়োগ না হলে শিল্পকারখানা হবে না। শিল্পকারখানা না হলে বেকারত্ব আরও বেড়ে যাবে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে ৪ মাসে ১০০টির মতো তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিটি কারখানায় দুই হাজার শ্রমিক থাকলেও দুই লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন। আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী–নেতা ও উপদেষ্টাদের মালিকানাধীন বেশ কিছু শিল্পকারখানা আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কারখানায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও বেকার হয়ে গেছেন। মালিকেরা টাকা নিয়ে পালিয়েছেন আর শ্রমিকেরা পথে বসেছেন।

বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা কত? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বলছে, বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। এটা অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য হিসাব। এ ব্যাপারে তারা আইএলওকে সাক্ষ্য মানছে। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেউ পুরো সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলে তিনি সকার। যে দেশে দিনরাত পরিশ্রম করেও একজন  মানুষ সংসার চালাতে পারেন না, সে দেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টার কাজের নিরিখে বেকারত্ব মাপা মশকরাই বটে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। এর মধ্যে শিশু ও প্রবীণদের বাদ দিলে ১০ কোটির মতো মানুষ কর্মক্ষম। সেই ১০ কোটির মধ্যে মাত্র ২৬ লাখ বেকার! এ রকম উদ্ভট পরিসংখ্যান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই আসা সম্ভব। বিগত সরকারের আমলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে গেলে মনে হতো উন্নয়নের জাদুঘরে এসেছি। সেখানে দেয়ালের ভেতরে–বাইরে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের বিশাল বিশাল ছবি। তাঁরা ভাবতেন, মন্ত্রণালয়ের দেয়ালে রঙিন ছবি খোদাই করলেই দেশ এগিয়ে যাবে।  

গত ১৯ আগস্ট প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাঁচ বছরে উচ্চশিক্ষিত বেকার দ্বিগুণ, কর্মসংস্থান নিয়ে তরুণদের উদ্বেগ বাড়ছে। ২০১৭ সালে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার ছিলেন চার লাখ। ২০২২ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় আট লাখ। দেশে এখন প্রতি তিনজন বেকারের মধ্য একজন উচ্চশিক্ষিত। তাঁরা বিএ কিংবা এমএ ডিগ্রি নিয়েও শোভন চাকরি পাচ্ছেন না। ফলে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর মধ্যে হতাশা প্রকট হয়েছে।

প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ গোষ্ঠী নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই দেশে চাকরি পাচ্ছেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে টিউশনি, পাঠাও-উবারে ডেলিভারিম্যান, বিক্রয়কর্মীসহ নানা ধরনের কাজ করে জীবনধারণ করছেন।

এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি চাকরির জন্যও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা আবেদন করছেন। বছরখানেক আগে রেলওয়ের লাইনম্যান পদে দুই দফায় যে ১২০ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের সবাই ছিলেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। কয়েক দিন আগে এক বাইকচালকের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে মোটামুটি ভালো পদে চাকরি করতেন, কিন্তু ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ায় আরও অনেকের মতো তাঁকে ছাঁটাই করা হয়। এখন বাইক চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, বেকারদের ৮৩ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। গড় বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৭ হলেও তরুণ শ্রমশক্তির মধ্যে বেকারের হার ৮ শতাংশ। বিবিএসের আরেকটি সমীক্ষা বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২ অনুসারে বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। মানে হলো তাঁরা পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই, এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি—৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ। গত দুই বছরে এ ধরনের নিষ্ক্রিয় বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এল অন্তর্বর্তী সরকার। গত সাড়ে চার মাসে তারাও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই। যে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের পুরোভাগে ছিল তরুণ সমাজ। এই তরুণদের একাংশ ছিল ছাত্র, অপরাংশ ছাত্রত্ব শেষ করে চাকরির সন্ধানে ছিল।

গত পাঁচটি বিসিএস (সাধারণ) পরীক্ষার তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যতগুলো পদের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়েছে, তার চেয়ে ২০০ গুণ বেশি আবেদন জমা পড়েছিল। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় পদের সংখ্যা ১ হাজার ১৪০। প্রাথমিকভাবে আবেদন জমা পড়ে ৩ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। ৪৫তম বিসিএসে ২ হাজার ৩০৯টি পদের বিপরীতে আবেদনসংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার। ৪৪তম বিসিএসের আবেদন জমা পড়ে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৭৬০টি। পদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭১০।

বাংলাদেশে বৃহত্তম দল কোনটি? কেউ বলেন বিএনপি, কারও মতে আওয়ামী লীগ; কিন্তু আমাদের বিচারে বৃহত্তম দল হলো ‘বেকার’। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। প্রথমে করা হয়েছিল ছয়টি। পরে আরও পাঁচটি। উদ্দেশ্য—গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। নারী, পুরুষ, ধর্ম, জাতিনির্বিশেষে সবার মানবাধিকার সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু বেকার থাকার চেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা আর কী হতে পারে? অনেক দেশে সরকার মানুষকে কাজ না দিতে পারলে বেকার ভাতা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মাথায় সেটা নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার নামে তরুণদের জন্য যে ১০০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, তা-ও ব্যর্থ হয় দুর্নীতি ও দলীয়করণের কারণে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এল অন্তর্বর্তী সরকার। গত সাড়ে চার মাসে তারাও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই।
যে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের পুরোভাগে ছিল তরুণ সমাজ। এই তরুণদের একাংশ ছিল ছাত্র, অপরাংশ ছাত্রত্ব শেষ করে চাকরির সন্ধানে ছিল।

অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পাল প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাইরের রূপ কোটাবিরোধিতা হলেও এর ভেতরের কারণ অর্থনীতি থেকেই উৎসারিত। এগুলোকে শাস্ত্রের ভাষায় বলা হয় অর্থনীতির দুই পাপ—বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি।’

এ দুই পাপকে আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার পারবে কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কর্তব্য দুটি। এক. জনজীবনের সমস্যার সমাধান। দুই. রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। জনজীবনের সমস্যার সমাধান বলতে যদি আমরা আইনশৃঙ্খলার উন্নতি বুঝি, সরকার সফল হয়নি। জনজীবনের সমস্যার সমাধান বলতে যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ বোঝায়, সেখানেও সরকার ব্যর্থ। যে স্বপ্ন নিয়ে তরুণেরা আন্দোলন করে স্বৈরাচারের পতন ঘটালেন, তা বাস্তবায়নেরও লক্ষণ দেখছি না।

২০২৪ সালটি বাংলাদেশের বেকারদের জন্য খুবই হতাশার বছর। ২০২৫ সাল তাঁদের জন্য কোনো সুখবর নিয়ে আসবে কি?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি