কিছুদিনের জন্য কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে বেড়াতে এসেছি। সেদিন ১৬ তারিখ শনিবার ছিল ঈদ। যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি, তিনি খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। তাই তাঁর কোনো ঈদ নেই, কিন্তু আমার? বাংলাদেশের একজন নাগরিক কি ঈদের আনন্দ এড়াতে পারে? ঈদের দিন যদি কেউ নিমন্ত্রণ না করে, মন খারাপ হবেই। কৈশোর আর প্রথম যৌবনের সেই মেহেদি রঙের হাত আজও চোখে ভাসে। মন খারাপ নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম একা একা হেঁটে হেঁটে। গুগল ম্যাপ ঘেঁটে দেখলাম অদূরে একটি নদী আছে, নাম সেন্ট লরেন্স।
মনে মনে ভাবলাম, নদীর পাড়ে গিয়ে বসলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে। রাস্তার পর রাস্তা অতিক্রম করছি কিন্তু নদীর কোনো দেখা নেই। এমনি এক রাস্তার ধারে দেখতে পেলাম ঘন বন। ঘন বনের ধার ঘেঁষে রাস্তা। বাঁ দিকেই নদী কিন্তু বনের মধ্য দিয়ে ঢোকার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম। হাঁটছি তো হাঁটছি।
হঠাৎ রাস্তার ডান দিকে চোখ পড়তেই দেখি একটি বাড়ির দরজায় বড় করে বাংলায় লেখা ‘সোনার তরী’ যা ছিল আমার জন্য বিস্ময়েরও অতীত। থমকে দাঁড়ালাম। মনে হলো, সৌরমণ্ডলের সব গ্রহ-তারা ক্ষণিকের জন্য নিজ নিজ অক্ষে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ভুলে গেলাম নদী, ভুলে গেলাম ঈদ, ভুলে গেলাম দুঃখ। সংবিৎ ফিরে এলে হেঁটে গেলাম দরজার কাছে। দরজায় কড়া নাড়ব কি নাড়ব না—এই দ্বিধায় কেটে গেল অনেকক্ষণ। সুদূর কানাডায় মন্ট্রিয়লের এই শহরতলিতে এ কোন বাঙালি?
ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের নামে বাড়ির নাম রেখেছেন যিনি, তাঁকে না দেখে যাব না—এমন জেদ থেকেই অবশেষে কড়া নাড়লাম। অনেকক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন এক নারী—শাড়ি পরা, শান্ত–স্নিগ্ধ অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। মনে মনে তিনি নিশ্চয়ই বলেছেন, ‘পথিক, পথ হারাইয়াছ?’ কিন্তু মুখে বললেন অন্য কথা। বললেন, ‘হুম আর ইউ লুকিং ফর?’ আমি বাংলায় বললাম, ‘আপনারা কি বাঙালি?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই’। আমি বললাম, ‘আপনার সোনার তরীতে একটু উঠতে ইচ্ছা করল, তাই...।’ আমার কথা শুনে তিনি অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, ‘প্লিজ ভেতরে আসুন।’
ভেতরে যেতে আমার দ্বিধা দেখে তিনি বললেন, ‘একজন বাঙালি হয়ে আপনাকে কি খালি মুখে যেতে দিতে পারি। তা ছাড়া আজ ঈদ, আনন্দের দিন। প্লিজ, ভেতরে আসুন।’ আমাকে বসতে দিয়ে তিনি ভেতরে গেলেন কফি বানাতে। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। আসবাব, তৈজসপত্র—সবকিছুতে বাঙালিয়ানার ছাপ। দেখলাম বহু প্রাচীন একটি গ্রামোফোন রেকর্ডও। আগের দিনে মেয়েরা রুমালে রিপু করে বিভিন্ন ধরনের মজার মজার বা নীতিবাক্য লিখে বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখত, যেমন, ‘ভুলো না আমায়’, ‘মনে রেখো’, ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’, ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’ ইত্যাদি। তাঁর দেয়ালেও দেখলাম ‘সুখে থেকো’ লেখা ফ্রেম ঝুলছে।
সর্বত্র বাঙালি সংস্কৃতির এমন ছোঁয়া দেখে মন ভালো হয়ে গেল। এক ফ্রেমে দেখলাম, তাঁদের বিয়ের ছবি এবং সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত। বুঝলাম, তিনি বাংলাদেশের বাঙালি। এতে তাঁকে খুব আপন মনে হলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কফির সঙ্গে নিয়ে এলেন অনেক প্রকারের খাবার।
সর্বত্র বাঙালি সংস্কৃতির এমন ছোঁয়া দেখে মন ভালো হয়ে গেল। এক ফ্রেমে দেখলাম, তাঁদের বিয়ের ছবি এবং সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত। বুঝলাম, তিনি বাংলাদেশের বাঙালি। এতে তাঁকে খুব আপন মনে হলো।
আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘শুনুন, আমার বাড়িতে আজ ঈদ উপলক্ষে কিছু অতিথি নিমন্ত্রণ করেছি। নিমন্ত্রণ করেছি মূলত অন্য ধর্মের লোকদের আর কিছু ছাত্র যাদের পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার সুযোগ নেই। তাঁরা সবাই সন্ধ্যা ছয়টায় আসবেন। আপনিও যদি যোগ দেন আমি খুব খুশি হব। আমার ছোট ভাইয়ের চেহারার সঙ্গে আপনার চেহারার হুবহু মিল। ভাইটা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।’ কথাগুলো বলতে বলতে তাঁর গলা আর্দ্র হয়ে আসছিল। আমার আর ‘না’ বলার উপায় ছিল না।
একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন তিনি নিজেও, যা সংক্ষেপে এ রকম: দেখুন একসময় আমাদের গোলাভরা ধান ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল, মুখভরা হাসি ছিল। একই গ্রামে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ধোপা, জোলা, নাপিত, তাঁতি, কামার, কুমারের বাস ছিল। কী সৌহার্দ্য ছিল, একে অপরের প্রতি কী ভালোবাসা ছিল! ঘানি টানার শব্দ, নামতা পড়ার আওয়াজ, আজানের সুর, পূজার উলুধ্বনি, গির্জার ঘণ্টায় মুখরিত হতো আকাশ–বাতাস। সেসব দিন কোথায় হারিয়ে গেল বলতে পারেন? আজ যখন দেখি, সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার হয়, বসতবাটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, মন্দির ভাঙা হয় কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যায়। এই জন্যই কি এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল?
কথা বলতে বলতে অতিথিরা চলে এলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সঙ্গে। বললেন, ‘আমার স্বামী ড. কুদরত-এ-খোদা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে, এই হলো ড. শুভ বসু আমার স্বামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের অধ্যাপক। আজিজুল রাসেল, রুমানা শারমিন কলি, আতিয়া আমিন অনি, আমার বড় ছেলে ঋভু রাজর্ষীর এই দুই বন্ধু—এঁরা সবাই ম্যাকগিলে পিএইচডি করছে।’ একসময় ঘরে প্রবেশ করলেন মেজর (অব.) দিদার হুসেইন। গৃহকর্ত্রী জানালেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
ঈদের অনুষ্ঠান শুরু হলো গান দিয়ে। প্রথমেই গৃহকর্ত্রী গাইলেন অতুলপ্রসাদের গান, ‘কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে...।’ অনি গাইলেন পরপর তিনটি গান, ঋভু রাজর্ষীর বান্ধবীও গাইলেন একটা গান, ঋভু গিটার বাজালেন আর তাঁর বন্ধু তবলা। ড. শুভ বসু অনুরোধ করলেন কাউকে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গেয়ে শোনানোর জন্য। এটা কেউ গাইতে পারেন না দেখে তিনি একটু বিরক্ত হয়ে নিজেই গাইলেন প্রথম দুটি কলি। তারপর বললেন, ‘এই গান ছাড়া ঈদের অনুষ্ঠান হয়?’ গানের পর হরেক রকমের খাবার আর তারপর মিলনমেলা ভাঙার পালা।
একফাঁকে গৃহকর্ত্রী একটি কাগজে নিজের নাম, ড. রুমানা নাহিদ সোবহান, বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বললেন, ‘মাঝে মাঝে যেন তব দেখা পাই।’ আপনি দেখতে আমার ছোট ভাইয়ের মতো, এটা ভুলবেন না কিন্তু। সবাই চলে গেলেন যাঁর যাঁর ঘরে। কিন্তু আমার তো কোনো ঘর নেই। আমি কোথায় যাব? আমি চললাম ট্রেন স্টেশনের দিকে।
বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর নায়ক তাঁর জীবনের ভালোবাসার গল্প তরুণ-তরুণীদের মাঝে বলার জন্য ছুটে বেড়ান এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে। প্রতিবার গল্পের শেষে তিনি শোনান ডব্লিউ এইচ অডেনের কবিতা: ‘উই মাস্ট লাভ ওয়ান অ্যানাদার অর ডাই।’ আমিও আজকের ঈদের জলছবির কাব্য শোনানোর জন্য ছুটে বেড়াব এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে।
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]