মতামত
বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার নিয়ে এই বৈষম্য কবে দূর হবে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশ কর্মকর্তাদের বঞ্চনা দূরীকরণে অনুরূপ ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারে বৈষম্য দূরীকরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্বিকার কেন, তা নিয়ে লিখেছেন তুহিন ওয়াদুদ
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার কিংবা পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করার কাজ করেছে অতীতের রাজনৈতিক সরকারগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা আশা করেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার সবার জন্য অভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করবে। কিন্তু আমরা দেখছি, Ñআগের ধারাবাহিকতা বজায় আছে।
গত কয়েক মাসে অবিশ্বাস্য গতিতে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চনার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকার কাজ করেছে। প্রশাসন ক্যাডারের যে কর্মকর্তা মারা গেছেন, সেই কর্মকর্তারও বঞ্চনা দূরীকরণে কাজ চলমান। বঞ্চনা দূরীকরণে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি অবসরে যাওয়া দেড় হাজার কর্মকর্তার বঞ্চনা দূরীকরণে সুপারিশ করেছে। অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন পদেও বসানো হচ্ছে।
সরকারের এসব উদ্যোগ তখন সাধুবাদ পেত, যখন সরকার সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করত। তারপরও এই উদ্যোগের অনুসরণ সব ক্যাডারেই হওয়া জরুরি। কেবল কি প্রশাসনসহ দু-একটা ক্যাডারে বৈষম্য হয়েছে? দেশে কি আর কোনো ক্যাডারে বৈষম্য হয়নি? যদি সব ক্যাডারের বৈষম্য দূর করা না হয়, তাহলে আন্তক্যাডার বৈষম্য চরমে পৌঁছাবে।
বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার হলেও এই ক্যাডারের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের মনোযোগ একেবারেই নেই। এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার যোগ্যতা নিয়েও জনমনে বিস্তর প্রশ্ন আছে। অনেকেই মনে করছেন, এই উপদেষ্টা স্বাস্থ্য ক্যাডারের শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেননি। চিকিৎসকদের দেশের বাইরে বিষয়ভিত্তিক সভা ও সেমিনারে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরোপিত বিধিনিষেধ দূর করা হয়নি। রোগীদের ভারতমুখী হওয়া বন্ধ করতেও চিকিৎসকদের ন্যায্যতাভিত্তিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশ কর্মকর্তাদের বঞ্চনা দূরীকরণে অনুরূপ ব্যবস্থা নিয়েছেন। যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের কয়েক দিনের ব্যবধানে তিনবার পর্যন্ত পদোন্নতি দিয়েছেন। শিক্ষা উপদেষ্টাও এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন যে শিক্ষা ক্যাডারে অনেককে পদোন্নতি দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতি বৈষম্য দূরীকরণে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ক্লিনিক্যাল, নন–ক্লিনিক্যাল, প্রশাসনিক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মরত স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা; যাঁরা প্রত্যেকে বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী সার্জন পদে যোগদান করেছেন। কখনো পদ–স্বল্পতার দোহাই দিয়ে, কখনো বৈষম্যমূলক নীতিমালার মাধ্যমে এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বন্ধ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেই কেবল পদের প্রশ্ন!
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পদোন্নতির জন্য প্রহসনমূলক (!) ফিটলিস্ট প্রস্তুত করে। এই ফিটলিস্ট চূড়ান্ত করতে ও মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বছরের পর বছর লেগে যায়। একই ফিটলিস্ট পাঁচ থেকে সাতবার প্রস্তুত করে। ফিটলিস্ট হওয়ার পর কয়েক বছর ধরে কেবল শোনানো হয় ‘পদোন্নতি হবে’। সেই পদোন্নতি আর হয় না। এরই মধ্যে অনেকে অবসরেও চলে যান। যদিওবা কয়েকজনের পদোন্নতি হয়, তা হয় পদোন্নতির তারিখ থেকে, যোগ্যতা অর্জনের তারিখ থেকে নয়।
শিক্ষা ক্যাডারে কয়েক দিন আগে পদোন্নতি পেয়েছেন ৯২২ জন। স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতি হচ্ছে নামমাত্র। শিক্ষা ক্যাডারের জন্য কোনো ডিগ্রি ছাড়াই অধ্যাপক হতে পারবেন। কোনো প্রকাশনাও লাগবে না। অন্যান্য ক্যাডারের জন্যও একই বিধান। চিকিৎসকদের জন্য পাঁচ বছরের অতিরিক্ত ডিগ্রি থাকলেও তাঁরা পদোন্নতি পান না। এর ওপর আছে অনেক প্রকাশনা।
আমার বাবা সরকারি চিকিৎসক ছিলেন। আমার অনেক পরিচিত, স্বজন ও আত্মীয় চিকিৎসক। যে বাসায় থাকি, সেই বাসায় আটজন চিকিৎসক থাকেন। তাঁদের পদোন্নতির বেহাল অবস্থা দেখে নিজেরই লজ্জা লাগে। ধরা যাক, স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তার সঙ্গে একই দিনে পেট্রোবাংলার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ও ব্যাংকের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী চাকরিতে যোগদান করলেন। দেখা যাবে, একসময় স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার চেয়ে অন্য সবাই উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত হবেন। অন্যদিকে বৈষম্যে তলানিতে পড়ে থাকবেন চিকিৎসক।
সাধারণ বিবেচনায় চিকিৎসকেরা তুলনামূলক বেশি মেধাবী। তাঁদের মেধার আলাদা মূল্যায়ন না করেও যদি তুলনামূলক অবস্থা বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে চিকিৎসকদের পদোন্নতি সবচেয়ে কম। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যদি ১১ থেকে ১২ বছর চাকরির মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং পদোন্নতির শর্তগুলো পূরণ করেন, তাহলে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
একই যোগ্যতা নিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা পদোন্নতি না পেয়ে প্রভাষক কিংবা সহকারী অধ্যাপক থাকার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। এমনকি ২৫ থেকে ৩০ বছর চাকরি করে অধ্যাপক কিংবা তৃতীয় গ্রেডে যেতে পারেন না প্রায় ৯৫ শতাংশ চিকিৎসক। একবার মাত্র পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যান অসংখ্য চিকিৎসক। কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত কেবল স্বাস্থ্য ক্যাডারেই পাওয়া সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী কেবল সাক্ষাৎকার দিয়ে চাকরিতে যোগদান করে ১২ বছরে বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তার চেয়ে উচ্চতর গ্রেডে চাকরি করেন। কয়েক দিন আগে তো পেট্রোবাংলার পিয়নদের পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক হওয়ার খবর পেলাম। এ রকম বিষয় বিবেচনায় নিলে চাকরির সমান বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তার চেয়ে উচ্চতর গ্রেডে চলে যান। বিশ্বাস করতে না চাইলেও মানতে হবে, এটাই বাংলাদেশ।
দেশে আমরা চিকিৎসকদের কাছে সবচেয়ে বেশি সেবা পেতে চাই, অথচ সবচেয়ে পিছিয়ে আছেন এই ক্যাডারের চিকিৎসকেরা। পিয়ন, কম্পিউটার অপারেটর, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা, অন্য যেকোনো নন–ক্যাডার কর্মকর্তা সবার চেয়ে কম পদোন্নতি পান স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
একই বিসিএসে যোগদান করে সবাই একই রকম পদোন্নতির স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু দেখা যায়, স্বাস্থ্য ক্যাডারের ট্রেন একই স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্য সব ট্রেন কয়েক স্টেশন পেরিয়ে গেছে। এমনকি তাঁদের ১৫ বছর পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ট্রেনও ছেড়ে গেছে। কেবল তা–ই নয়, যাঁরা এখনো ক্যাডার হয়ে আসেননি, তাঁদের ট্রেনও চলে যাবে। তখন একই স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপরের দ্রুতগামী ট্রেন দেখতে দেখতে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজ ক্যাডারের প্রতি একপ্রকার ঘৃণা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। চিকিৎসকদের এই মনস্তত্ত্ব বোঝার বদলে তাঁদের অসহায়ত্ব নিয়ে দেশের রাজনীতিকসহ দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সবাই বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেন। নয়তো তাঁদের ট্রেন স্টেশনে বছরের পর বছর কেন দাঁড়িয়ে থাকবে?
অন্তর্বর্তী সরকারের কি বোধোদয় হবে? তারা কি অবসরে যাওয়া বঞ্চিত চিকিৎসকদের কিংবা বঞ্চিত মৃত চিকিৎসকদের বঞ্চনা দূর করবে? সবার আগে যাঁরা এখনো পদে থেকে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হোক। এ কাজটি খুবই সহজ। এ জন্য চাই সদিচ্ছা ও সক্ষমতা। উপদেষ্টা নিজে যদি বোঝেন ও উপলব্ধি করেন, তাহলেই কেবল সম্ভব। যাঁরা স্বাস্থ্য ক্যাডারকে পিছিয়ে রেখেছেন, তাঁদের চোখ দিয়েই আবারও যদি স্বাস্থ্য ক্যাডার দেখতে চান, তবে বৈষম্য বৃদ্ধি ছাড়া কমবে না।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক