পৃথিবীজুড়েই সাম্প্রতিক সময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান ঘটেছে। সরাসরি স্বৈরাচারী নীতির অনুসরণ করে এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেমনটা উত্তর কোরিয়ায় আমরা দেখতে পাই, তা এখন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। কিন্তু তার জায়গা দখল করেছে নতুন ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা।
এসব নতুন কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে অনেক সময়ই চিহ্নিত করা কঠিন। কারণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী মত দমন, বাক্স্বাধীনতা ও মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করার মতো স্বৈরাচারী বৈশিষ্ট্য এসব সরকারে থাকলেও তারা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের চর্চা করছে বেশ সফলভাবেই।
গণতন্ত্রের খোলস পরা এসব কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থায় নিয়ম মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় জনমতের প্রতিফলন থাকে না, বরং নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা পূর্বনির্ধারিত থাকে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার টিকে থাকে কীভাবে এবং টিকে থাকার পেছনে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কোনো ভূমিকা আছে কি না।
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের দেখতে হবে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর সঙ্গে গুজব, ভুয়া তথ্য ও অপতথ্যের কোনো যোগাযোগ আছে কি না।
জার্মানির বার্লিন সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রের দুই গবেষক নিকোলিনা ক্ল্যাট ও ভেনেসা বোজে-শ্লোসারের গবেষণা অনুযায়ী, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো গুজব ও ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে তাদের ক্ষমতাকে সুসংহত করছে।
যদিও ভুয়া তথ্যের প্রচার শুধু কর্তৃত্ববাদী সরকারই করে, তা নয়, বরং নানা সংগঠন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান গুজব ও ভুয়া তথ্য প্রচারে ও প্রসারে জেনে বা নিজের অজান্তেই ভূমিকা রাখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—ফেসবুক, এক্স (টুইটার) ইত্যাদি—এখন সাধারণ পাঠকদের জন্য সংবাদের অন্যতম উৎস।
এসব মাধ্যমে যেহেতু যে কেউ কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই সংবাদ প্রকাশ করতে পারে বা ব্যবহারকারীরা নিজেরাই সংবাদের উৎস হয়ে উঠতে পারে, তাই ভুয়া তথ্য ও গুজব রটনাও সহজ হয়।
এই পোস্ট-ট্রুথ বা সত্য–উত্তর এ যুগে, গুজব ও ভুয়া তথ্যকে কর্তৃত্ববাদী সরকার নিজেদের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে এবং জনগণের সামনে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে জনমতকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করে।
কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে তথ্যপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারের হাতে, তাই সাধারণ জনগণকে তথ্যের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভরশীল থাকতে হয় সরকারের সরবরাহ করা তথ্যের ওপর।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীন সরকারের ‘গ্রেট ফায়ারওয়াল’-এর কথা, যার মাধ্যমে চীন বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক্সেস নিয়ন্ত্রণ করে।
ফলে শুধু চীন সরকারের সরবরাহ করা তথ্য ছাড়া অন্য কোনো তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ম্যানিপুলেট (কারসাজি) করে ভুয়া তথ্য ছড়ায় কর্তৃত্ববাদীরা। এসব ভুয়া ও অপতথ্য সব সময় ভুল বা ঠিক হিসেবে চিহ্নিত করাও সম্ভব হয় না।
বিরোধী মতের কোনো ব্যক্তির চরিত্রহরণ বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে দিয়ে খুব সুসংগঠিতভাবে তথ্যকে বিকৃত করা হয়।
যখন সরকারি সংস্থা, ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা সরকারের মদদপুষ্ট ব্যক্তি নিজেরাই এ ধরনের তথ্য প্রচার করে, তখন সাধারণ জনগণের জন্য সেই তথ্য যাচাই করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
বিরোধী মতের ব্যক্তি, সমালোচক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ গঠন করে তাঁদের নিপীড়ন করাও কর্তৃত্ববাদীদের অপতথ্য কৌশলের একটি উপায়।
সন্ত্রাসবাদ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুপ্তচারিতার অভিযোগ এনে তুরস্কের সরকার সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিক ও বিরোধী দলের কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং কারাদণ্ড দিয়েছে। মিয়ানমার ও চীনেও এমন উদাহরণ রয়েছে বেশ কিছু।
এমনকি কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর গবেষণা সংস্থা থেকেও ভুয়া বা কারসাজি করা তথ্য-উপাত্ত প্রচার করার উদাহরণ দেখা যায় সাম্প্রতিক বিশ্বে।
বিশেষ করে অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে মিথ্যা ও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো উপাত্ত ও পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয় সরকারের সাফল্য দেখানোর জন্য।
উদাহরণস্বরূপ, উত্তর কোরিয়ার জনগণ যেখানে দরিদ্র এবং প্রতিনিয়ত নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় উপাত্ত ও পরিসংখ্যানে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি দেখানো হয়।
নিকোলিনা ক্ল্যাট ও ভেনেসা বোজে-শ্লোসারের গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ক্রিমিয়া আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়া সরকারও ভুয়া তথ্য প্রচার করা বাড়িয়ে দেয়। ইউক্রেনে হামলার পরও ভুয়া তথ্য প্রচারের এ ধারা বজায় রাখে রাশিয়া সরকার।
ভুয়া তথ্য ও গুজব প্রচার এখন শুধু জনমত নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী মত দমন ও ভাবমূর্তি উদ্ধারই করে তা নয়, বরং এটি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অনেক দেশেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরোধীদের ‘ট্রল’ করার জন্য, ক্ষমতাসীন কর্তৃত্ববাদীদের পক্ষে মন্তব্য করার জন্য ভাড়াটে বাহিনী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেখানেই সরকারপ্রধান, মন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সমালোচনা হয়, সেখানেই এসব বাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার অনলাইন কর্মীদের জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা, ভারতের হোয়াটসঅ্যাপ বাহিনীর মাধ্যমে উগ্র-হিন্দু মতবাদের প্রসার ইত্যাদি উদাহরণ এ সমস্যার বৈশ্বিক আঙ্গিক বুঝতে সহায়তা করে।
প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানিগুলো টাকার বিনিময়ে মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়াতে সাহায্য করে। যেমন রাশিয়ার ভাগনার গ্রুপ যুদ্ধ পরিস্থিতি রয়েছে, এমন দেশগুলোতে ভুয়া তথ্য ছড়াতে কাজ করে। এটি এখন মাল্টি মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা বলে জানা যায়।
শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়, কর্তৃত্ববাদী সরকারের উদ্যোগে মূলধারার গণমাধ্যমেও ভাবমূর্তি উন্নয়নের জন্য নানা চেষ্টা চলে। ভারত ও চীনে কিছু গোষ্ঠী রয়েছে, যারা অর্থের বিনিময়ে ভুয়া পরিচয় তৈরি করে কলামিস্ট ও লেখকের প্রোফাইল তৈরি করে এবং সংবাদমাধ্যমে অভিমত ও কলাম ছাপিয়ে দেয়।
বলাই বাহুল্য, এসব কলাম ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সফলতার বয়ান তুলে ধরে। এ ধরনের প্রতারণামূলক প্রচার যেমন স্বল্প পরিচিত মিডিয়ায় হয়, তেমনি নামীদামি সংবাদমাধ্যমগুলোও মাঝেমধ্যে এর ফাঁদে পড়ে।
গুজব, ভুয়া ও অপতথ্য রুখতে জনগণের কাছে সঠিক সংবাদ ও তথ্য পৌঁছে দিতে হয়, তাই সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, গবেষকদের কাজের পরিধি যেন সংকুচিত না হয়, তা দেখতে হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণের মধ্যেও ভুয়া তথ্য শনাক্ত করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে
ভুয়া তথ্য রোধের জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। আর কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে যেহেতু নিজেদের প্রয়োজনেই তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তাই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে জনমতের প্রতিফলন হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, তা নিশ্চিত না করলে মিডিয়ার স্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে না।
গুজব, ভুয়া ও অপতথ্য রুখতে জনগণের কাছে সঠিক সংবাদ ও তথ্য পৌঁছে দিতে হয়, তাই সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, গবেষকদের কাজের পরিধি যেন সংকুচিত না হয়, তা দেখতে হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণের মধ্যেও ভুয়া তথ্য শনাক্ত করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সাইমুম পারভেজ বেলজিয়ামের ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের মেরি কুরি পোস্টডক্টরাল ফেলো