যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিয়েন্সের লুইজিয়ানা শহরে নববর্ষের সকালে মানুষের ভিড়ের মধ্যে এক ব্যক্তি ট্রাক তুলে দিলে ভয়ংকর এক ট্র্যাজেডির জন্ম হয়। কমপক্ষে ১৫ জন নিহত হন, আহত হন আরও কয়েক ডজন।
হামলাকারীকে শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে শনাক্ত করা হয়। হামলাকারী হলেন শামসুদ–দীন জব্বার নামের ৪২ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক। অরলিয়েন্সের প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য টেক্সাসের বাসিন্দা তিনি।
মিডিয়ায় ঘটনাটি আসে এফবিআইয়ের প্রাথমিক বিবৃতির ওপর ভিত্তি করে। এখানে দুটি বিষয় ছিল মূল। এক. জব্বারের ট্রাকে আইএসআইএলের (আইএসআইএসের একটি শাখা) পতাকা পাওয়া গেছে। দুই. তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টে এমন কিছু পোস্ট পাওয়া গেছে, যাতে মনে হয় যে তিনি আইএসআইএল দ্বারা ‘অনুপ্রাণিত’। অনেক গণমাধ্যমের কাছে প্রাথমিক এ বিবৃতিই জব্বার (পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে যিনি নিহত হয়েছেন) আইএসআইএলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী, সেটা বলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এফবিআই এখন এ হামলার সঙ্গে ‘সন্ত্রাসবাদের’ কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নিয়ে অনুসন্ধান করছে। একই সঙ্গে সংস্থাটি বলছে, আইএসআইএল জব্বারকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে হামলা চালানোর জন্য আদেশ দিয়েছে—এমন তথ্যপ্রমাণ তারা পায়নি। এফবিআই তাদের আইনি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কোন ধরনের তথ্যপ্রমাণ ব্যবহার করেছে, সেটা সুনির্দিষ্ট করে জানায়নি অথবা তাদের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত তথ্যও প্রকাশ করেনি।
জব্বার সম্পর্কে আমরা যেটা জানতে পেরেছি, তা হলো তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক সেনাসদস্য। তিনি ১৩ বছর মার্কিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন। কিছুদিন তিনি আফগানিস্তানেও ছিলেন। ইদানীং স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছিল এবং তিনি তাঁর পুরো পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এসব তথ্য পুরো আখ্যানকেই জটিল করে তোলে। এতগুলো মানুষ হত্যার পেছনে জব্বারকে কোন ঘটনা প্ররোচিত করেছে, সে সম্পর্কে অনুমানগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
এফবিআইয়ের কর্মকর্তাদের এবং এমনকি বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দাবি ছিল, হামলাকারী আইএসআইএল দ্বারা ‘অনুপ্রাণিত’ ছিলেন। এটি সাংবাদিকতার দায়িত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। প্রশ্নটা হলো, আমরা কি সাংবাদিক হিসেবে সরকারি বিবৃতি তুলে ধরব, নাকি আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপট থেকে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন তৈরি করব?
নয়–এগারোর হামলার (২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলা) পর অস্পষ্ট ও অপ্রমাণিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দাবি করা হলো, সাদ্দাম হোসের সঙ্গে আল–কায়েদার সম্পর্ক রয়েছে। এ বয়ান ইরাক আগ্রাসনের ন্যায্যতা তৈরি করেছিল। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সেই যোগে আইএসআইএসের জন্ম হয়েছিল।
প্রেক্ষাপটাই এখানে প্রধান বিষয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বিবৃতির পর আমাদের উচিত হামলাকারীর প্রেক্ষাপট, বিবৃতি ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যেসব তথ্য জানি, সেগুলো অনুসরণ করা। লুইজিয়ানায় ট্রাক হামলার মতো ঘটনার ক্ষেত্রে এ পথ অনুসরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ঘটনার উত্তাপে সরকারি কর্তৃপক্ষ পরস্পরবিরোধী তথ্য প্রকাশ করেছে।
অন্যকে প্রভাবিত করতে পারেন এমন কোনো তরুণ ছিলেন না জব্বার। মধ্যবয়সী এই সেনাসদস্যের উল্লেখ করার মতো জীবন–অভিজ্ঞতা ছিল। এর মধ্যে তিক্ত অভিজ্ঞতাও অনেক। আমরা সবাই এটা জানছি, মার্কিন সেনাবাহিনীতে থাকার সময় যে অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে, তাতে তিনি ‘মৌলবাদী’ হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের ট্রমা ও তাঁর পরিবারের প্রতি যে ক্ষোভ তিনি প্রকাশ করেছেন, সে সম্পর্কে আমরা কি কিছু জানি?
বিষয়টা হচ্ছে, আমরা এখন পর্যন্ত এ সম্পর্কে যথেষ্ট কিছু জানি না। আমাদের এ নিয়ে আরও বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা উচিত।
এখন পর্যন্ত পশ্চিমা মিডিয়াগুলো একটি সুপরীক্ষিত সহজ পথ বেছে নিয়েছে। এ ধরনের ট্র্যাজিক ঘটনা তুলে আনতে গিয়ে তারা সেই একই সূত্র ব্যবহার করছে। সেটা হলো, ‘একজন মন্দ ধরনের বাদামি (গায়ের রং) মুসলমান আইএসআইএলের নামে সন্ত্রাবাদী কাজ করেছে।’
বয়ানটি খুব সুবিধামতো জব্বারের পরিস্থিতিগুলোর জটিলতাগুলোকে উপেক্ষা করে যায়। তাঁর মানসিক অবস্থা এবং আফগানিস্তানে তাঁর সৈনিক জীবন ও যেসব ব্যক্তিগত সংকট তিনি মোকাবিলা করেছেন, সেগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।
শ্বেতাঙ্গ হামলাকারীরা যখন বন্দুক নিয়ে হামলা চালায়, সেসব ঘটনার বিপরীত বয়ানটা এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়। সেসব হামলার পর আমরা দেখি, হামলাকারীর মানসিক স্বাস্থ্য, বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিজীবন, ব্যক্তিগত সংগ্রামে—এসব বিষয়কে সামনে আনে মিডিয়া।
এই দ্বিচারিতা জনগণকে কেবল এসব ঘটনার সত্য জানতে বাধা দেয় না, তাদের ভেতরের ক্ষতিকর বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে আরও পোক্ত করে। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মিডিয়ার এসব দায়িতত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কারণে নিউ অরলিয়েন্স ও হাউসটনের (জব্বারের শহর) মুসলিম সম্প্রদায়, যাঁরা জব্বারকে চেনেনও না, তাঁরা সম্মিলিতভাবে দোষারোপের মুখে পড়তে পারেন।
সাংবাদিক হিসেবে আমরা জানি, ডেভেলপিং স্টোরির (যে ঘটনা তখনো ঘটে চলেছে) প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়া একটা ভ্রমণের মতো ব্যাপার। মূল সমস্যা হলো মিডিয়া যখন অপর্যাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের বয়ান তৈরি করে, তার প্রভাব বাস্তব জীবনে গিয়ে পড়ে। মিডিয়া যখন এমন ঘটনাকে আইএসআইএলের সঙ্গে যোগসূত্র আছে বলে বয়ান তৈরি করে, তাতে মুসলিমবিরোধী মনোভাব চাঙা হয় এবং মুসলিমবিরোধী নীতি তৈরি হয়।
২০১৫ সালে সান বার্নাডিনোতে গোলাগুলির সময় ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল যে হামলাকারীরা আইএসআইএলের বড় একটি নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত। এ ঘটনায় তখনকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জনসমক্ষে ‘মুসলিমদের ওপর নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়ার দাবি তোলেন।
নয়–এগারোর হামলার (২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলা) পর অস্পষ্ট ও অপ্রমাণিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দাবি করা হলো, সাদ্দাম হোসের সঙ্গে আল–কায়েদার সম্পর্ক রয়েছে। এ বয়ান ইরাক আগ্রাসনের ন্যায্যতা তৈরি করেছিল। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সেই যোগে আইএসআইএসের জন্ম হয়েছিল।
সোরায়া সালাম আল–জাজিরার ইংরেজি অনলাইনের ব্যবস্থাপক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত