অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র—ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের এই চার নেতৃস্থানীয় গণতন্ত্র ২০১৭ সালে যখন দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকা কোয়াডকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল, তখন এর উদ্দেশ্য মোটামুটি সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল চীনের সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা এবং একটি স্থিতিশীল আঞ্চলিক ভারসাম্যকে আরও বেশি শক্তিশালী করা।
কিন্তু এই জোট এখন মনে হচ্ছে তাদের অবস্থান থেকে অনেকটাই পিছিয়ে গেছে এবং সেই পিছিয়ে যাওয়ার কারণে একধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এই ঝুঁকিকে খাটো করে দেখা আমাদের মোটেও উচিত হবে না।
কোয়াডের পুনরুত্থান মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে একটি দৃষ্টান্তযোগ্য বাঁকবদলকে প্রতিফলিত করেছিল।
আমরা যদি পেছনে তাকাই তাহলে দেখব, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কয়েক দশক ধরে অংশীদার হিসেবে হেঁটেছে। চীনকে অর্থনৈতিকভাবে উঠে আসতেও ওয়াশিংটন সহায়তা করেছে।
অবশেষে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় শিবিরের নেতারা প্রায় অভিন্নভাবে উপলব্ধি করেছেন, আমেরিকার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন ধীরে ধীরে তার সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। তাঁরা মনে করছেন, চীন এখন বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারি শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ সালের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ঘোষণার সময় বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়ার বিষয় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ও একমাত্র প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে।
জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে একটি ‘স্বাধীন ও উন্মুক্ত ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার যে ধারণা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের জন্য পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও কোয়াডকে একটি অপরিহার্য উদ্যোগ হিসেবে দেখেছিলেন।
২০১৯ সাল থেকে কোয়াডের সম্মেলন সদস্যদেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে এই জোটের আলোচনাকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান পর্যায়ে তুলে আনেন এবং ২০২১-২০২৩ সালে শীর্ষ নেতাদের সম্মেলন হয়।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যদি তার বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে না আসে, তাহলে দেশটি চীনকে তাইওয়ানে আক্রমণ করা কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত গাঁটছড়া বাঁধতে বিরত রাখতে ব্যর্থ হতে পারে, ঠিক যেমনটি রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণ থেকে বিরত রাখতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল।
কোয়াড নেতাদের শেষ সম্মেলনের পর এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করায় এই জোটের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ২০২৫ সালের আগে কোয়াডের পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনাও কম বলে মনে হচ্ছে।
কোয়াডের গা ছাড়া ভাবের কারণ খুবই সোজা। তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক অগ্রাধিকারে পরিবর্তন এসেছে।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন যুদ্ধকে পশ্চিমারা তাদের বিরুদ্ধে হাইব্রিড যুদ্ধ হিসেবে দেখছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতের কথা না বললেও চলে।
এসব দিকে মনোযোগ দেওয়ার কারণে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের কৌশল বাস্তবায়নে মার্কিন প্রচেষ্টা মার খাচ্ছে।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বশেষ বৈদেশিক সহায়তা প্যাকেজের আওতায় ইউক্রেনকে ৬ হাজার ৮০ কোটি ডলার দিলেও চীনের নজরে পড়া তাইওয়ানসহ সমগ্র ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য তারা মাত্র ৮১০ কোটি ডলার দিয়েছে।
ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরের নিরাপত্তা ইস্যুতে এই ধরনের সীমিত ব্যয় করে বাইডেন আশা করছেন, তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত কূটনীতির জোরেই চীনের তাইওয়ানবিরোধী যুদ্ধ ঠেকিয়ে দিতে পারবেন।
গত মাসে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বাইডেনের টেলিফোনে কথা হয়েছে। সে কথোপকথনে তিনি তাইওয়ান প্রণালিজুড়ে শান্তি বজায় রাখার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাইডেন বিশ্বাস করেন, চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র অধিকতর সমঝোতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখে এগোলে সেটি বড় পরিসরের চীন-রাশিয়ান জোটের উত্থানকে ঠেকিয়ে দিতে পারবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক বেইজিং সফর চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার ‘সীমাহীন অংশীদারির’ সম্পর্ককে আরও চাঙা করেছে। এটি ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট।
পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার পর মস্কো কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়লেও চীন ইতিমধ্যে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙা করে তুলেছে। বিনিময়ে রাশিয়া চীনকে সস্তায় জ্বালানি দিচ্ছে। পাশাপাশি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও সামরিক হামলার বিষয়ে আগেভাগে সতর্ক করে দেওয়ার ব্যবস্থাসহ কিছু উন্নত সামরিক প্রযুক্তি রাশিয়া চীনকে দিয়েছে।
ফলে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, ক্রেমলিনের যুদ্ধযন্ত্রকে চীনের সরাসরি সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া এবং রাশিয়ার সঙ্গে চীনের পূর্ণ সামরিক জোট গঠন আমেরিকার জন্য সবচেয়ে খারাপ ভূরাজনৈতিক দুঃস্বপ্ন বয়ে আনবে।
এখন বাইডেনের জন্য বড় সমস্যা হলো, একই সঙ্গে চীনকে সন্তুষ্ট করতে যাওয়া এবং কোয়াডকে (যাকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ‘ন্যাটোর ইন্দো-প্যাসিফিক সংস্করণ’ বলে নিন্দা করেছেন) শক্তিশালী করা; কারণ এই দুটি বিষয় মৌলিকভাবে বেমানান ও পরস্পরবিরোধী।
এটি কাকতালীয় ঘটনা না–ও হতে পারে যে গত নভেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ায় সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বাইডেনের বৈঠক এবং তারপর বাইডেন প্রশাসনের একাধিক মন্ত্রীকে বেইজিং সফরে পাঠানোর পর এখন পর্যন্ত কোয়াড নেতারা নিজেদের মধ্যে কোনো আলোচনায় বসেননি।
অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ফিলিপাইনের সঙ্গে আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। হয়তো সে কারণেই বাইডেন কোয়াডের মতো কম উসকানিমূলক উদ্যোগ থেকে তাঁর নজর সরিয়ে নিয়েছেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, ভারতকে বাইরে রেখে চীনবিরোধী জোট গড়ে কী ফায়দা পাওয়া যাবে?
আদতে ভারতই এই শতাব্দীর একমাত্র শক্তি যে কিনা পিপলস লিবারেশন আর্মির সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে। বিতর্কিত হিমালয় সীমান্তে চীন চোরাগোপ্তা কায়দায় ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ার পর যে উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক অচলাবস্থা শুরু হয়েছিল, তা পঞ্চম বছরে পড়েছে।
এর বাইরে ভারত মহাসাগরে নেতৃস্থানীয় সামুদ্রিক শক্তি হিসেবে ভারত সক্রিয় রয়েছে। সে কারণে অবশ্যই দক্ষিণ চীন সাগর থেকে চীনের পশ্চিমমুখী নৌ অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ভারতকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ‘অকাস’-এর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তার নিরাপত্তা অংশীদারির কথাও বলে আসছে। কিন্তু ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তায় অস্ট্রেলিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে না, যতক্ষণ না দেশটি পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিনে সজ্জিত না হতে পারছে। আর আগামী এক দশকে অস্ট্রেলিয়ার হাতে এই সাবমেরিন পৌঁছাবে বলে মনে হয় না।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, এখন পর্যন্ত চীনের প্রতি বাইডেনের নমনীয় আচরণে ইতিবাচক ফল মিলেছে সামান্যই। তার বিপরীতে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সম্প্রতি তাইওয়ানের ওপর বলপ্রয়োগের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের উসকানি বেড়েই চলেছে।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র যদি তার বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে না আসে, তাহলে দেশটি চীনকে তাইওয়ানে আক্রমণ করা কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত গাঁটছড়া বাঁধতে বিরত রাখতে ব্যর্থ হতে পারে, ঠিক যেমনটি রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণ থেকে বিরত রাখতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল।
ফলে এ কথা বলা যায়, ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা বজায় রাখতে স্পষ্ট কৌশলগত মিশনভিত্তিক একটি শক্তিশালী কোয়াডের কোনো বিকল্প নেই। একটি সুসংহত আঞ্চলিক কৌশল গড়ে তোলার বিষয়ে গড়িমসি করলে তা চীনা সম্প্রসারণবাদকে আরও সক্ষম ও শক্তিশালী করবে।
ফলে বাইডেন ও তাঁর সহযোগী কোয়াড নেতাদের অবশ্যই এই মিশনকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য কাজ করতে হবে এবং বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা কৌশল অনুসরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে। অন্যথায় কোয়াড একধরনের ‘পোটেমকিন’ (বাহ্যিক মুখোশ লাগানো পরিস্থিতি বিশেষ যা দেখে লোকেরা বিশ্বাস করে, পরিস্থিতি ভালো আছে, তবে প্রকৃত অবস্থা তা নয়। ১৭৮৭ সালে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথরিন ক্রিমিয়া সফর করার সময় গ্রিগরি পোটেমকিন নামের একজন ফিল্ড মার্শাল সম্রাজ্ঞীকে খুশি করতে একটি নকল গ্রাম বানিয়েছিলেন। সম্রাজ্ঞী চলে যাওয়ার পর সেই গ্রামও সরিয়ে ফেলা হয়। ওই ঘটনার সূত্র ধরে ‘পোটেমকিন’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে।) গোষ্ঠী হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
সবাইকে বুঝতে হবে, ওপরে ফিটফাট কিন্তু ভেতরে সারশূন্য হয়ে যাওয়া জোট দিয়ে চীনকে বোকা বানানো যাবে না।
● ব্রহ্ম চেলানি দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ