মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁদের সর্বসাম্প্রতিক যৌথ বিবৃতিতে মিয়ানমারের ক্রমেই অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দেশটিতে একটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র চেয়েছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার নীতি এই উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকদের দুর্দশাগ্রস্ত করেছে। অন্যদিকে সামরিক জান্তাদের এই নিষেধাজ্ঞা স্পর্শও করতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতা জান্তাদের কুক্ষিগত হয়ে আছে। এই পরিস্থিতির ফায়দা ওঠাচ্ছে চীন। তারা দেশটিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করছে। চীনের জন্য মিয়ানমার হলো ভারত মহাসাগর এবং এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উৎসের প্রবেশদ্বার।
এই অগ্রগতি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চীনা সেনাবাহিনী এখন মিয়ানমারের গ্রেট কোকো আইল্যান্ডে আড়ি পাতার অবকাঠামো স্থাপনে সহযোগিতা করছে। এর অবস্থান ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপের ঠিক উত্তরে। এই দ্বীপে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর একমাত্র ঘাঁটিটি অবস্থিত।
আশির দশকের শেষে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর চীন তাদের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী এবং অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই নিষেধাজ্ঞা ২০১২ সাল পর্যন্ত জারি ছিল। বারাক ওবামার নতুন মার্কিন নীতি ঘোষণা এবং মিয়ানমার সফরের পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়।
দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা সামরিক শাসন শেষে ২০১৫ সালে মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটায় এবং অং সান সু চির মতো বেসামরিক নেতাদের আটক করে। বাইডেন প্রশাসনও আরও ব্যাপক পরিসরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। মিয়ানমারের এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের আগে সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্বিচার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়।
২০১৯ সালে সেনাপ্রধানসহ অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জারি রাখার ব্যাপারে আগ্রহ হারায় সামরিক নেতৃত্ব। নিষেধাজ্ঞা জারির দেড় বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বেসামরিক সরকারের পতন ঘটায় সামরিক নেতৃত্ব।
পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা জরুরি যে আলাদাভাবে বিদেশি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাটার একধরনের প্রতীকী গুরুত্ব আছে। কিন্তু এই উদ্যোগ মার্কিন কূটনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং অযাচিত ঘটনার জন্ম দেয়।
সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ মিয়ানমারের একমাত্র কার্যকর প্রতিষ্ঠান হলো দেশটির সেনাবাহিনী। এই বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে যোগাযোগের যে অনুপস্থিতি, তা দেশটির প্রতি মার্কিনিদের নীতির একটা দুর্বলতা। এই সীমাবদ্ধতার দরুন সু চি পশ্চিমা মানসে রীতিমতো ‘সন্ত’ হিসেবে বিবেচিত হন। ব্যাপক প্রশংসিত এই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর সম্মান ক্ষুণ্ন হয় গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ানোয়।
মিয়ানমারে চীনের এই দ্রুত বর্ধনশীল উপস্থিতি আমেরিকার জন্য কৌশলগত ক্ষতি। কৌশলগতভাবে অবস্থান বিবেচনা করলে, মিয়ানমারকে আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনার অংশ করা যেতে পারে। এ জন্য সামরিক জান্তার ইতিবাচক কিছু উদ্যোগের বিপরীতে ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা সহজ করা যেতে পারে।
এখন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে দেশটির রাজনৈতিক অগ্রগতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব রাখার সুযোগ খুবই সামান্য। উল্টো তাদের মিত্ররা নিষেধাজ্ঞার পরিসর আরও বাড়িয়েছে। মিলিটারি শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধকারীদের প্রতিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই লক্ষ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্টে যুক্তরাষ্ট্র নতুন একটি বিধান যুক্ত করেছে। এতে করে তারা সরকারবিরোধী সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে প্রাণঘাতী নয়, এমন সহযোগিতা করতে পারবে। সহযোগিতার আওতায় ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট নামে মিয়ানমারে ছায়া সরকারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্সও যুক্ত আছে। বাইডেন এখন মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী যে সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে, সেখানে স্বাধীনভাবে নানা কিছু করতে পারেন। যেমন ওবামা ইউক্রেন ও সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।
কিন্তু এর ফলে মিয়ানমারকে আরও বিশৃঙ্খলা এবং দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা হবে না। মিয়ানমারে জান্তাবিরোধীদের সশস্ত্র আন্দোলন বর্তমান সরকারকে উৎখাত করতে পারলেও দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরবে না। বরং দেশটি লিবিয়ার মতো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে অস্বস্তির কারণ হবে। পাশাপাশি পশ্চিমা শক্তি এবং চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার একটি বিকল্প যুদ্ধক্ষেত্রেও পরিণত হতে পারে এ অঞ্চল। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমার এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও পণ্য চীন ও রাশিয়া থেকে কিনেছে।
মিয়ানমারে চীনের এই দ্রুত বর্ধনশীল উপস্থিতি আমেরিকার জন্য কৌশলগত ক্ষতি। কৌশলগতভাবে অবস্থান বিবেচনা করলে, মিয়ানমারকে আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনার অংশ করা যেতে পারে। এ জন্য সামরিক জান্তার ইতিবাচক কিছু উদ্যোগের বিপরীতে ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা সহজ করা যেতে পারে। আলোচনার দরজা বন্ধ করে দেয় নিষেধাজ্ঞা। থাই সেনাপ্রধান ক্ষমতা দখলের পর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রেখেছিল। এতে দেশটির নাগরিক সমাজ শক্তিশালী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়।
মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও সেটি করা গেলে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। মিলিটারি জান্তাকে কিছু প্রণোদনা দিয়ে তাদের অবস্থান বদলে দেওয়া যায়। সিআইএ পরিচালক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ঘন ঘন চীন সফর করেছেন। বাইডেন বিশ্বের সবচেয়ে বড়, শক্তিশালী এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সেটি পারছেন, মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে অন্তত যোগাযোগটা তাঁর শুরু করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন না হলে মিয়ানমার বড় বড় শক্তির খেলার মাঠ হয়ে উঠবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর কোনো আশা আর থাকবে না।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক