মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজাতির পূর্ণতার পরম উৎকর্ষ সাধনের জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে পৃথিবীতে পাঠান পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল প্রভাতলগ্নে। সমগ্র সৃষ্টিজগৎ পড়ল দরুদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
প্রিয় নবীজি (সা.)–এর জীবন পরিক্রমায় অনেক ধাপ বা পর্ব রয়েছে। প্রথম ধাপ খলকে নবী (সা.) অর্থাৎ নবীজি (সা.) সৃষ্টি। এ হলো সৃষ্টি সূচনার আদি পর্ব। দ্বিতীয় ধাপ তাঁর বিলাদাত বা মিলাদুন নবী (সা.) তথা দুনিয়াতে শুভাগমন অর্থাৎ জন্মপর্ব। এটি হলো মা আমিনার গর্ভ থেকে দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত।
তৃতীয় ধাপ সিরাতুন নবী (সা.), এটি হলো ভূমিষ্ঠের পর থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত। চতুর্থ ধাপ বিআসাত বা জহুরে নবুয়ত অর্থাৎ নবুয়ত প্রকাশের পরের জিন্দেগি।
এটি হলো ৪০ বছরের পর থেকে ৬৩ বছর বয়স তথা ওফাত পর্যন্ত প্রায় ২৩ বছর। পঞ্চম ধাপ বারজাখে হায়াতুন নবী (সা.), এটি হলো ওফাতের পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়। ষষ্ঠ ধাপ হায়াতে উখরবি বা পরকালীন জীবন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই আপনার জন্য ইহকাল অপেক্ষা পরকাল উত্তম।’ (সুরা-৯৩ দুহা, আয়াত: ৪)
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের প্রায় সাত মাস আগে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। জন্মের পর তিনি কয়েক দিন মাতৃস্তন্য পান করেন। পরে তৎকালীন আরবের প্রথা অনুযায়ী ধাইমা হালিমা সাদিয়া (রা.)-এর দুগ্ধ পান করেন। অল্প বয়সে তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে লালিত হন। তাঁর আট বছর বয়সে পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন। তখন তিনি চাচা আবু তালিবের দায়িত্বে পালিত হন। ১২ বছর বয়সে তিনি আবু তালিবের সঙ্গে ব্যবসায়িক কাফেলায় সিরিয়ায় গমন করেন।
কিশোর ও তরুণ বয়সে তিনি মানবসেবা ও জনকল্যাণে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি হজরত খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। খাদিজা (রা.)-এর আগ্রহে ও অভিভাবক আবু তালিবের নির্দেশে ২৫ বছর বয়সে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে হজরত খাদিজা (রা.)–এর শুভ পরিণয় হয়।
প্রিয় নবীজি সেখানে গিয়ে একটি আদর্শ সমাজ ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিশ্চিত করে একটি সনদ স্বাক্ষর করেন, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। হিজরতের এক বছরের মাথায় মদিনা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে বদরযুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরের বছর ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে নবীজি (সা.) প্রায় দেড় হাজার সাহাবি নিয়ে উমরাহ করতে মক্কায় আসেন। মক্কার কুরাইশদের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তাদের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য চুক্তি সম্পাদন করে ফিরে যান। এটি বিখ্যাত ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত।
তখন খাদিজা (রা.)–এর বয়স ৪০ বছর, এর আগে তাঁর আরও দুটি সংসার হয়েছিল, সে স্বামীদ্বয় মৃত্যুবরণ করেন। ২৫ থেকে ৫২ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের ২৭ বছর একমাত্র বিবি খাদিজা (রা.)–কে নিয়ে দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেন। নবীজি (সা.)–এর সন্তানসন্ততি কতজন—এ নিয়ে মতভেদ আছে। সর্বসম্মত অভিমত হলো তাঁর সন্তানের সংখ্যা ছয়। তন্মধ্যে পুত্রসন্তান ছিলেন হজরত ইব্রাহিম ও হজরত কাসেম এবং কন্যাসন্তান ছিলেন হজরত ফাতেমা, হজরত জয়নব, হজরত রোকাইয়া ও হজরত উম্মে কুলসুম। এর মধ্যে হজরত কাসেম ও কন্যা চারজন হজরত খাদিজা (রা.)-এর গর্ভে এবং হজরত ইব্রাহিম হজরত মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে জন্মলাভ করেন।
৩৫ বছর বয়সে মহানবী (সা.) কাবা শরিফ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন ও তা স্বহস্তে প্রতিস্থাপন করেন। এ সময় তিনি সর্বত্র ‘আল আমিন’ বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত হন। ৩৭ বছর বয়স থেকে তিনি হেরা গুহায় অবস্থান করে ধ্যানমগ্ন হতে শুরু করেন। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে মহানবী (সা.) নবুয়ত লাভ করেন। প্রথম তিন বছর তিনি ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্তজনদের কাছে ইসলাম প্রচার করেন। তার একপর্যায়ে চাচা হজরত আমির হামজা (রা.) ও হজরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং সাহাবির সংখ্যা ৪০ পূর্ণ হয়। ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে নবুয়তের চতুর্থ বছরে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সহধর্মিণী হজরত খাদিজা (রা.) ও চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন। এটিকে ‘আমুল হুজন’ বা দুঃখের বছর বলা হয়। ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য তায়েফ গমন করেন। ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে মিরাজ বা ঊর্ধ্বগমন সংঘটিত হয়। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন।
প্রিয় নবীজি সেখানে গিয়ে একটি আদর্শ সমাজ ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিশ্চিত করে একটি সনদ স্বাক্ষর করেন, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। হিজরতের এক বছরের মাথায় মদিনা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে বদরযুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরের বছর ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে নবীজি (সা.) প্রায় দেড় হাজার সাহাবি নিয়ে উমরাহ করতে মক্কায় আসেন। মক্কার কুরাইশদের থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তাদের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য চুক্তি সম্পাদন করে ফিরে যান। এটি বিখ্যাত ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত।
বছর না গড়াতেই কুরাইশরা বারবার চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে। ফলে দুই বছর পর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। তিনি কোনো প্রতিশোধ না নিয়ে, সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এ বছর তিনি ওমরাহ পালন করে মদিনায় ফিরে যান।
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে দশম হিজরিতে মহানবী (সা.) হজ সম্পাদন করেন, যা বিদায় হজ নামে পরিচিত। এর অল্প দিন পরেই তিনি পৃথিবী ত্যাগ করেন। হজে সোয়া লাখ সাহাবির উপস্থিতিতে তিনি যে ভাষণটি দেন, তা ‘বিদায় হজের ভাষণ’ হিসেবে বিখ্যাত। এটি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার সনদরূপে স্বীকৃত।
এর প্রায় ৯০ দিনের মাথায় ৬৩ বছর বয়সে তিনি মদিনায় মসজিদে নববী-সংলগ্ন পূর্ব পাশে হজরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরায় ওফাত লাভ করেন। সেখানেই তাঁর সমাধি বা রওজা মোবারক।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম