যখন সত্য বলার লোকের আকাল পড়ে, তখনো সাহস করে কাউকে কাউকে সত্য কথা বলতে হয়। সাম্প্রতিক কালে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিভিন্ন সভা–সেমিনারে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে যেসব কঠিন সত্য উচ্চারণ করেছেন, তা আমাদের ঘুমন্ত বিবেককে ধাক্কা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তিনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনের কথাই বলেছেন। যে ব্যক্তি পাকিস্তান আমলে দুই অর্থনীতি তত্ত্ব দিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন, তিনিই তো ইতিহাসের এই ক্রান্তিকালে বলতে পারেন, ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ।’
গত বৃহস্পতিবার অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত একক বক্তৃতায় তাঁরই ছাত্র ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলেছেন।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা প্রতিদিনই যখন প্রচার করছেন অর্থনীতির সবকিছু ঠিকমতো চলছে, কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফরাসউদ্দিন ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন আমজনতার বোধগম্য ভাষায়। এ জন্য প্রশংসা ও সাধুবাদ তিনি পেতেই পারেন।
ষাটের দশকে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন করা ফরাসউদ্দিন অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে সেখানেই দুই বছর শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি সিএসপিতে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
অতএব ক্ষমতাবলয় থেকে যাঁদের অতি ডান বা অতি বাম হিসেবে সমালোচনা করা হয়, ফরাসউদ্দিনকে সেই দলে ফেলা যায় না। তিনি বরাবরই মধ্যপন্থী। আর সাবেক আমলা কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূতপূর্ব গভর্নরই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়।
তিনি ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে একাধিক দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রথম উপাচার্যও ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকার কারণে বিএনপির শাসনামলে ওই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাঁকে অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
গত ১৫ বছরে ক্ষমতাবলয়ের বাইরে থেকেও ফরাসউদ্দিন আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেক সুপরামর্শ দিয়েছেন। সরকারি বেতন ও চাকরি কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা উপযুক্ত বেতন ও সুযোগ–সুবিধা পেলে দুর্নীতি কমে যাবে। তাঁর সুপারিশে তাঁরা উপযুক্ত বেতন–ভাতা ও সুযোগ–সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু সরকারি খাতে দুর্নীতি কমেনি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে তাঁর প্রশ্ন হলো গত ১৫ মাসে অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি অর্ধেক কমিয়ে ৫ শতাংশে আনতে পারলেও আমরা কেন পারলাম না? এর পেছনে অনেক কারণের সঙ্গে কয়েকজন আমদানিকারকের একচেটিয়া ব্যবসাকেও চিহ্নিত করেছেন ফরাসউদ্দিন। অথচ সরকার অর্থ পাচার বন্ধ কিংবা মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ না নিয়ে সবকিছুর জন্য রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার দোহাই দিচ্ছে।
আমলারা যখন দেখেন রাজনীতিকেরা দুর্নীতি করছেন, তখন তাঁরাও দুর্নীতিকে ‘ন্যায্য’ মনে করেন। আবার ব্যবসায়ীরা যখন দেখেন রাজনীতিকেরা তাঁদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছেন, তখন তাঁরা পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকদের চাঁদা দিতেন, এখন তাঁরাই সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছেন।
ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসা না আসা নিয়ে ফরাসউদ্দিন কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি আমলাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, কোনো আমলার রাজনীতিতে আসা ঠিক না। কোনো গোষ্ঠীর আখের গোছানোর জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। স্বাধীন হওয়ার সুবিধা কেউ পাচ্ছেন অতি সামান্য, কেউ অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করছেন।’
গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। একসময় প্রচণ্ড খাদ্যঘাটতির দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। মানুষের গড় আয় ও গড় আয়ু বেড়েছে। তবে গড় দিয়ে উন্নয়নের মাপকাঠি ঠিক করা অনেকটা অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যই ছিল সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যের অবসান। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই সুবিচার কি আছে? সরকারের অর্থনৈতিক নীতিই যেন এখন—যার আছে, তাকে আরও দাও। যার নেই, তাকে যেভাবে পারো ঠকাও। ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন, কিন্তু সরকার তাঁদের টিকিটিও ধরতে পারছে না। গরিব মানুষের ক্ষেত্রে যদিও ছাড় নেই। তাদের কৈফিয়তও
শোনা হয় না।
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘যখন ঋণখেলাপিওয়ালা বেশি বড় হয়ে যায়, তখন এক হাজার টাকা কৃষিঋণের কারণে কেউ জেলে যায়, আর ১০ হাজার কোটি টাকা শিল্পঋণের খেলাপি গ্রাহক সরকারের পাশে বসে। ...১০ হাজার টাকার কৃষিঋণ নিয়ে খেলাপি হলে তাকে জেলে ঢোকাব, কিন্তু ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হলে তাকে সালাম ঠুকব, এটা হতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ঋণগুলো অবশ্যই আদায় করা উচিত।’
বেসিক ব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একমাত্র সরকারি ব্যাংক হিসেবে বেসিক ব্যাংক একসময় সরকারকে মুনাফা দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা তৈরি করা। ধীরে ধীরে ব্যাংকটি খারাপ করে ফেলা হয়েছে। বেসিক ব্যাংককে যতই একীভূত করা হোক, সেটা ভালো হবে না। ওই ব্যাংক যিনি নষ্ট করেছেন, শুনেছি দেশেই আছেন। আগে ওনার নাম ভিন্ন ছিল, পরে ‘শেখ’ হয়েছেন। কার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আছেন জানি না। জানলেও নাম বলতে পারতাম না। কারণ, এই বয়সেও ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’
তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে যেমন খেদ ও বেদনা আছে, তেমনি আছে অসহায়ত্ববোধও। যে ব্যক্তি একটি ব্যাংক ধ্বংস করেছেন, যাঁর প্রশ্রয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বা বাইরে পাচার হয়েছে, সেই ব্যক্তিকে সরকার ধরতে পারছে না কেন? দুদক অন্যদের বিষয়ে যতটা তৎপর, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের ব্যাপারে ততটাই নিষ্ক্রিয়। এর ব্যাখ্যা কী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ব্যাংক একীভূত করা, টাকা ও ডলারের বিনিময় হার, আয়বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবলতা ও দুর্বলতা নিয়েও কথা বলেন।
তিনি মনে করেন, জোরপূর্বক ব্যাংক একীভূত করার ফল ভালো হয় না। খারাপ ব্যাংক ভালো করার এটা একমাত্র পথও নয়। এর বিকল্প আছে। এখন যাদের ভালো ব্যাংক বলা হচ্ছে, এমন চারটি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকই একসময় তদারক করে ভালো করেছে এবং সেটা হয়েছিল ফরাসউদ্দিনের আমলেই।
খেলাপি ঋণ ছাড়া যে দুটি বিষয়ে ফরাসউদ্দিন জোর দিয়েছেন, তা হলো অর্থ পাচার রোধ ও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। অর্থ পাচারের বিষয়ে আইএমএফের পাশাপাশি সরকারের নীরবতারও সমালোচনা করেছেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে তাঁর প্রশ্ন হলো গত ১৫ মাসে অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি অর্ধেক কমিয়ে ৫ শতাংশে আনতে পারলেও আমরা কেন পারলাম না? এর পেছনে অনেক কারণের সঙ্গে কয়েকজন আমদানিকারকের একচেটিয়া ব্যবসাকেও চিহ্নিত করেছেন ফরাসউদ্দিন। অথচ সরকার অর্থ পাচার বন্ধ কিংবা মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ না নিয়ে সবকিছুর জন্য রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার দোহাই দিচ্ছে।
ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়। কিন্তু যে সরকার জেগে ঘুমায়, তাদের জাগানো কঠিন। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের আলোচনায় সে কথার প্রতিধ্বনি করে গেলেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি