বিশ শতকের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে দুই বাংলা ফুটবল–অন্তপ্রাণ ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ‘ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান’ আর বাংলাদেশে ‘আবাহনী-মোহামেডান’—এই বোল তখন হরিবোলের মতো জারি ছিল। ওপার বাংলায় ইস্ট বেঙ্গল সমর্থকদের মোহনবাগান সমর্থকেরা খোঁচা মেরে বলতেন ‘বাঙাল’ আর মোহনবাগান সমর্থকদের ইস্টবেঙ্গলওয়ালারা বলতেন ‘ঘটি’। ‘বাঙাল-ঘটি’র ফুটবলঘটিত সাপে-নেউলে দশায় দশকের পর দশক গেছে।
এই বাংলায় আবাহনী-মোহামেডানেরও আদায়-কাঁচকলায় ‘পারাপারি’ ছিল। এই দুই দলের বলের জোর দেখতে দর্শকে মাঠ ভরে যেত। দুই দলের সমর্থনে পুরো দেশ দু ভাগ হয়ে যেত। ফুটবল উত্তেজনায় দেশ কাঁপত।
উত্তম কুমার অভিনীত ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিটি আজও বাংলার ফুটবলের বৃহত্তম বিজ্ঞাপন আর সেই ছবির ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ গানটি আজও বাংলা ফুটবলের সেরা থিম সং হয়ে আছে।
ফুটবল নিয়ে বাঙালিদের, বিশেষত বাংলাদেশিদের মধ্যে সেই উন্মাদনা আর অবশিষ্ট নেই—এমন কথা অন্য মৌসুমে চললেও বিশ্বকাপ মৌসুমে অচল। কারণ বিশ্বকাপে যখন বিশ্ব কাঁপে, তখন বাংলাদেশিদের কাঁপুনি অন্যদের চেয়ে বেশি বই কম থাকে না। তখন স্পষ্টতই বোঝা যায়, বাংলাদেশিদের ফুটবল জ্বরটা আগের মতোই ১০৪ ডিগ্রিতে আছে। তবে সেটা হয়ে গেছে সিজনাল ফ্লু। সেই জ্বর চার বছর পর পর আসে।
বিশ্বকাপের পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই দেশ মূলত দুই ভাগে ভাগ হয়। এক ভাগে থাকে ব্রাজিল। আরেক ভাগে আর্জেন্টিনা। আসর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের গায়ে জার্সি ওঠে। মোড়ে মোড়ে ব্যানার ফেস্টুন ওঠে। মাইকিং হয়। মিছিল-মিটিং পর্যন্ত হয়। দলের পক্ষ নিয়ে তর্কাতর্কি হয়। হাতাহাতি হয়। মারামারি হয়। স্বামী-স্ত্রীতে ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত হয়।
১৮ ডিসেম্বর, রোববার রাতে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কত লাখ কেজি মিষ্টি বিতরণ হয়েছে, কতজন আনন্দের চোটে হার্টঅ্যাটাক করেছে, কতজন উদ্ভট কত কিছু করেছে, তা ফেসবুকের লগবুকে জমা হয়ে আছে। বিশ্বকাপের আসরে নিজের দেশ না থাকার পরও পাবলিকের এই আপাত অহেতুক আর্জেন্টিনা-উন্মাদনা অনেকের কাছে ‘লঙ্কায় রাবণ মরল, বেহুলা কেঁদে বিধবা হলো’ টাইপের আদিখ্যেতা মনে হতেই পারে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের মানুষ কোনো না কোনো উপায়ে দুটো পক্ষে ভাগ হয়ে থাকতে ভালোবাসে।
সারাক্ষণই তাদের মাথার মধ্যে ‘আমরা’ আর ‘তারা’ কাজ করে। আমরা যদি মেসি, তারা নির্ঘাত এমবাপ্পে। আমরা উচ্ছে তো তারা করলা। আমরা আওয়ামী লীগ তো তারা বিএনপি।
বিভক্তিপ্রীতি হয়তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি; তবে এই গ্রুপিংয়ের ব্যাপারটা আমাদের মতো এত আমোদের সঙ্গে উদ্যাপন আর কোনো জাতি করতে পারে বলে মনে হয় না। ভাগ হওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে। ভাগ হতে পারলে এক ভাগ আরেক ভাগকে খোঁচানো যায়। গা গতরে চুলকানি থাকলে তা চুলকে চুলকে ক্ষত করে ফেলার মধ্যে যে আনন্দ পাওয়া যায়, ভাগে ভাগে পরস্পরের মধ্যে খোঁচাখুঁচি করার মধ্যে তার চেয়ে বেশি আরাম পাওয়া যায়। সে কারণেই আমরা ভাগ হতে চাই। দুই ভাগ, চার ভাগ বা তারও বেশি ভাগে ভাগ হতে চাই। বিভক্তির জন্য কোনো উপলক্ষ না পাওয়া গেলে উপলক্ষ পয়দা করি। কারণ যত ভাগ তত নেতা।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা—দলাদলির মধ্যে স্বাভাবিক ক্রীড়াধর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আনন্দ যতটা না আছে, সম্ভবত খেলাকে উপলক্ষ করে খোঁচাখুচির মধ্যে তার চেয়ে বেশি আরাম আছে। এই কারণে চায়ের দোকান থেকে ফেসবুকের নিউজফিড—সবখানে যে যাকে পারে ল্যাং মারে, যে যাকে পারে কাঠি করে।
কিন্তু দিন শেষে আনন্দের কথা হলো, দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল নিয়ে দলাদলি বড় কোনো মারামারি ও খুনোখুনিতে গড়ায়নি। আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-কমিউনিস্ট–বাঙালি–অবাঙালি—সব ঘরানার লোক ছিল। ব্রাজিলভক্তদের মধ্যেও তাই ছিল। অর্থাৎ ফুটবল আমাদের দুই ভাগ করলেও সেই দুই ভাগে জাতি-ধর্ম-রাজনৈতিক আদর্শের ভাগ ছিল না।
বিশ্বকাপ থেকে আগে ভাগে ব্রাজিল বাদ পড়ায়, মানে হেরে যাওয়ায় ব্রাজিল-সমর্থকদের কারও বাড়িতে কোনো আর্জেন্টিনা-সমর্থক হামলা করেনি। কোনো ব্রাজিল সমর্থককে মামলা মোকদ্দমার ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়নি। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ব্রাজিলভক্তদের মন হয়তো খানিকটা খারাপ হয়েছে, কিন্তু নেইমার শিবিরের কেউ মেসিকে শাপশাপান্ত করেনি। মেসি সমর্থক বিপদে পড়লে নেইমার সমর্থক বসে থাকতে পারেনি। দু-একজন ছাড়া সবাই খেলার খোঁচাখুঁচি খেলার মাঠে তুলে রেখেছেন।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা—দলাদলির মধ্যে স্বাভাবিক ক্রীড়াধর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আনন্দ যতটা না আছে, সম্ভবত খেলাকে উপলক্ষ করে খোঁচাখুচির মধ্যে তার চেয়ে বেশি আরাম আছে। এই কারণে চায়ের দোকান থেকে ফেসবুকের নিউজফিড—সবখানে যে যাকে পারে ল্যাং মারে, যে যাকে পারে কাঠি করে।
আমাদের রাজনীতিতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা গোছের দলাদলির চল থাকলে দেশটা বেঁচে যেত। তাহলে বিএনপির পরাজয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থক উল্লসিত হতো, আওয়ামী লীগের পরাজয়ে বিএনপি বিজয় মিছিল বের করত; বিজয়ীরা বাড়ি বাড়ি মিষ্টি বিতরণ করত; কিন্তু বিজয়ী বিজিতকে ধনে-প্রাণে নিশ্চিহ্ন করতে চাইত না। বিএনপি কর্মীর বাড়িতে ডাকাত পড়লে আওয়ামী কর্মী ঘুমিয়ে থাকত না। চার বছর পর পর সিজনাল ফ্লুর মতো যেভাবে বিশ্বকাপ জ্বর সবাইকে ভর করে, সেইভাবে পাঁচ বছর পর পর জনগণের মধ্যে নির্বাচনী জ্বর আসত। নেতারা ডাক দিতেন, ‘খেলা হবে!’ কিন্তু সেই ‘খেলা হবে’ হুংকারের মধ্যে ভয়ংকর সহিংসতার হুমকির দ্যোতনা নিহিত থাকত না।
ভোটার হিসেবে সেই সহিংসতামুক্ত নির্বাচনী খেলার স্বপ্ন দেখা কি খুব একটা অলীক কিছু?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]