যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও তাঁর দলবলের বাংলাদেশ সফরের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপরে ওপরে হলেও বেশ উজ্জীবিত মনে হচ্ছে। তবে দেশের রাজনীতি এখন যতটা অনিশ্চিত ও জটিল জায়গায় গেছে, তাতে ভেতরে-ভেতরে কী হচ্ছে, বোঝা মুশকিল।
আওয়ামী লীগের এই উজ্জীবিত ভাবের পেছনে কিছু দৃশ্যমান কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের এবারের এই সফর ছিল সরকার ও সরকারি দলকেন্দ্রিক। বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উজরা জেয়ার বৈঠকও হয়েছে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে। সংবাদ সম্মেলনে ও সাক্ষাৎকারে উজরা জেয়া আনুষ্ঠানিক যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তাতে আওয়ামী লীগ উৎসাহিত বোধ করতেই পারে।
যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাচ্ছে। উজরা জেয়া এসে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, সম্ভাব্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা কারও নির্বাচন বর্জন বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। উজরা জেয়ার সফরে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকাকে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বিশেষ কোনো দলের প্রতি পক্ষপাত বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত হতে চায় না—এটাও পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন উজরা জেয়া।
উজরা জেয়ার এই সফর এবং এর ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে বলেই দলটির অনেকে মনে করেন। দলের পক্ষ থেকেও নেতা-কর্মী ও দেশবাসীকে তেমন একটি ধারণা দেওয়া হচ্ছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমেরিকানরা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেননি। বোঝা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ায় বিষয়টিকে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা বোঝাতে চাইছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ এখন আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন আর নয়—এমন কথা সব পক্ষই বলছে। কোনো ধরণের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা ফয়সালা ছাড়াই এই দুটি নির্বাচন হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচনে আগেই নির্বাচন নিয়ে এই অমীমাংসিত রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মীমাংসা করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পথে সেটা হবে? দুটি পথই দেখা যায়; সংলাপ ও আলাপ-আলোচনা অথবা রাজপথে ফয়সালা ও রক্তক্ষয়। দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকায় সংঘাতের আশঙ্কাই বেড়ে যাচ্ছে। তা এড়ানোর যেকোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সরকারের।
উজরা জেয়ার মুখে আনুষ্ঠানিক যেসব কথা আমরা শুনেছি, এর বাইরেও নিশ্চয়ই সরকারে লোকজনের সঙ্গে তাঁর অনেক কথাবার্তা বিনিময় হয়েছে। কূটনীতিতে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা অনানুষ্ঠানিকভাবেই বলা হয়। এই সফরে তেমন কিছু হয়েছে কি না বা হলেও তা কী, আমরা জানি না। কিন্তু সাদাচোখে আমরা দেখছি, এই সফরের পর আওয়ামী লীগের হয় সত্যিই আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, অথবা দলটি জনগণের সামনে নিজেদের উজ্জীবিত হিসেবে হাজির করার কৌশল নিয়েছে। দলের নেতাদের মুখে নতুন করে অনমনীয় ভাব ও কঠোর কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কাজেও তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির পদযাত্রায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও পুলিশ, কোথাও সরকারি দলের লোকজন এই মারমুখী অবস্থান নিয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া শুরু হয়েছে।
উজরা জেয়ার নেতৃত্বে এবারের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সব বক্তব্য ছিল সরকারে প্রতি। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন ‘অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে’ আয়োজনের ব্যাপারে তারা সরকারের কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রথমত, এতে মনে হতে পারে যে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপরই নির্ভর করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে বিরোধী দলগুলোর দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো ব্যাপার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ব্যাখ্যা যদি তা-ই হয়, তবে আওয়ামী লীগের উজ্জীবিত ও আত্মবিশ্বাসী হওয়াই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের এই ব্যাখ্যাও দেওয়া যায় যে নির্বাচনকালীন সরকার হোক, এ নিয়ে সংলাপ হোক বা বিরোধী দলকে নির্বাচনে রাজি করানো হোক; অর্থাৎ ‘একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার, সবটা করার দায়িত্বই আওয়ামী লীগ সরকারের বলে তারা মনে করে। বিরোধী দল নির্বাচনে না এলে যে নির্বাচন ‘শান্তিপূর্ণ’ হবে না, তা কে না জানে। সরকারের সেই দায়িত্বের কথাই উজরা জেয়া বলে গেছেন। কাজটি যে কঠিন বা এর রাজনৈতিক ফলাফল কী হতে পারে, তা আওয়ামী লীগের অজানা নয়।
আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে বা নিয়েছে এবং কোন ব্যাখ্যা বিবেচনায় নিয়ে কৌশল নিচ্ছে, সেটা এক বড় প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেনি, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও কোনো অবস্থান নেয়নি—এটা কি সত্যিই আওয়ামী লীগকে স্বস্তি দিয়েছে? নাকি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব দায়িত্ব সরকারের—যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান দলটির অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে? নতুন করে কঠোর অবস্থানে যাওয়া, বেশি আত্মবিশ্বাস দেখানো বা বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার মতো বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ যেভাবে সামনে নিয়ে আসছে, তা অবশ্য নিজেদের মধ্যে স্বস্তির চেয়ে অস্বস্তি বাড়ারই ইঙ্গিত দেয়।
সরকার ও সরকারি দলকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের এই সফর সম্ভবত বিএনপিকে কিছুটা দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। এই সফর এবং এর দৃশ্যমান ফলাফল দলটিকে যে খুব স্বস্তি দেয়নি, তা বোঝা যায়। উজরা জেয়ার সফরে সংলাপের প্রসঙ্গটি এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা সংলাপ চায়, তবে এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে চায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংলাপ নিয়ে বিএনপি এবং এর শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে একধরনের সংশয় রয়েছে বলে মনে হয়। তাদের অনেকেরই ভয়, বিএনপির দাবির পক্ষে আন্দোলন একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে যাওয়ার আগে এ ধরনের সংলাপ আন্দোলনের ধারাবাহিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে ও সময়ক্ষেপণের কৌশল হিসেবে সংলাপকে সামনে আনা হচ্ছে বলেও অনেকের ধারণা। উজরা জেয়ার সফর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়েছে বলে মনে হয়।
ছয় মাসের কম সময়ের মধ্যে দেশে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। ঠিক এই সময়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান হচ্ছে, সংবিধানের বাইরে একচুলও যাবে না দলটি। অন্যদিকে বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। দেশ নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক অচলাবস্থার একটি চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে পড়েছে।
নব্বইয়ের পর এ পর্যন্ত যত বড় রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা হয়েছে, তার সবই হয়েছে নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। এসব সংঘাত ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কিছু পথ ও ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
সেগুলোর কোনোটিই আজ টিকে নেই। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে সংঘাত-সহিংসতার দিকে যাওয়ার আগে যেসব সংলাপ হয়েছে, তা কাজে দেয়নি। রক্তক্ষয় ও রাজপথে একধরনের ফয়সালার পর কোনো না কোনো বন্দোবস্ত হয়েছে। ২০০৮ সালের পর এই ধারাবাহিকতা আর বজায় থাকেনি। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগে ও পরে সংঘাত হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক ফয়সালা হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সহিংসতা হয়নি এবং নির্বাচনটি ছিল অংশগ্রহণমূলক, কিন্তু একটি চরম বিতর্কিত নির্বাচন হিসেবে এটি ‘রাতের ভোট’-এর তকমা পেয়েছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন আর নয়—এমন কথা সব পক্ষই বলছে। কোনো ধরণের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা ফয়সালা ছাড়াই এই দুটি নির্বাচন হয়েছে। আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচনে আগেই নির্বাচন নিয়ে এই অমীমাংসিত রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মীমাংসা করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পথে সেটা হবে? দুটি পথই দেখা যায়; সংলাপ ও আলাপ-আলোচনা অথবা রাজপথে ফয়সালা ও রক্তক্ষয়। দুই পক্ষ অনড় অবস্থানে থাকায় সংঘাতের আশঙ্কাই বেড়ে যাচ্ছে। তা এড়ানোর যেকোনো উদ্যোগ নেওয়ার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সরকারের।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
[email protected]