আমেরিকার উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচিফাইল ছবি: রয়টার্স

রাশিদ খালিদি প্যালেস্টাইন বিষয়ে আমেরিকার খুব বিশিষ্ট একজন পণ্ডিত। সাম্প্রতিক তিনি এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের বেহাল উচ্চশিক্ষার চমৎকারভাবে বর্ণনা দিয়েছেন।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এডওয়ার্ড সাইদ চেয়ার পদ থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খালিদি বলেন, ‘আমি আর এই যন্ত্রের অংশ হতে চাইনি।’

কোন যন্ত্রের কথা বললেন তিনি। ব্যাখ্যা দিয়েছেন খালিদি। ‘আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা যেভাবে শুধু নগদ অর্থ উপার্জনের যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে, তা দেখে আমি হতাশ এবং আতঙ্কিত। উচ্চশিক্ষা এখন কেবল টাকা কামানোর, এমবিএ, আইনজীবী দ্বারা পরিচালিত হেজ ফান্ড-কাম-রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। এর ক্ষুদ্রাংশ শিক্ষায় নিয়োজিত। এখানে টাকাই সবকিছু নির্ধারণ করে। বিদ্যা ও জ্ঞানের প্রতি এর সম্মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।’

যে পরিস্থিতি খালিদিকে আগেভাগে অবসর নিতে বাধ্য করেছে, তা সম্ভবত নিকট ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে হোয়াইট হাউসে ফিরে এসেই তিনি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালাবেন।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমবর্ধমান টিউশন ফি উল্লেখ করেছিলেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় পড়ালেখা করা ট্রাম্প দোষ দিয়েছেন ‘উগ্র বামপন্থীদের’। এরা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘মার্ক্সবাদী উন্মাদদের হাতে তুলে দিয়েছে’। ট্রাম্পের সহপ্রার্থী, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক জেডি ভ্যান্স, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ‘শত্রু’ বলে তকমা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে আক্রমণ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

উচ্চশিক্ষায় এই ট্রাম্পের নতুন জমানা যা অর্জন করতে চায়, তার বিস্তৃত কাঠামো ইতিমধ্যেই হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের নীলনকশা ‘প্রকল্প ২০২৫’-এ উঠে এসেছে। এই প্রকল্পটি সব বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি উদ্যোগের বিলুপ্তি এবং সব শিক্ষাসামগ্রী থেকে ‘লিঙ্গ মতাদর্শ’ এবং সমালোচনামূলক বর্ণতত্ত্ব অপসারণের আহ্বান জানিয়েছে। এই পরিকল্পনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি নীতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছে। সেখানে প্রাধান্য পাবে বিশ্বাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রকল্প ২০২৫ ঋণ মওকুফ কর্মসূচি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।

ট্রাম্প এই মেয়াদে এসবের পুরোটা হয়তো অর্জন করতে পারবেন না। তবে উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁর নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আগামী বছরের মধ্যেই সেগুলোর কিছু কিছু বাস্তবায়িত হতে পারে।

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি এবং ব্যাপক হারে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনাও উচ্চশিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে মার্কিন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  ৪ লাখ ৮ হাজার অনথিভুক্ত শিক্ষার্থী রয়েছেন। অনেক রাজ্য এই শিক্ষার্থীদের টিউশন এবং রাজ্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি রাজ্য অনথিভুক্ত অভিবাসীদের পাবলিক কলেজে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আরও অনেক বেশি পাবলিক প্রতিষ্ঠান হয়তো বাধ্য হয়ে বা সরাসরি চাপে পড়ে এ ধরনের নীতি গ্রহণ করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প ‘উগ্র বামপন্থী অনুমোদনকারী’ এবং ‘মার্ক্সবাদী বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিপন্থীদের’ বরখাস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই জায়গায় এমন লোকদের নিয়োগ দিতে বলেছেন, যাঁরা ‘আমেরিকান ঐতিহ্য এবং পশ্চিমা সভ্যতা রক্ষা করার’ একটি নতুন মানদণ্ড বজায় রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখনই আগাগোড়া সব জায়গায় ট্রাম্প এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবেন হয়তো। তবে তিনি সহজেই একটি প্রবিধান পাস করতে পারেন, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ থেকে সরে যেতে চাপ দেবে।

ট্রাম্পের নতুন আমলে সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক সম্প্রদায়ের উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ, ট্রাম্প ন্যায়বিচার বিভাগ এবং ফেডারেল নাগরিক অধিকার আইনগুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। আটকে দিতে পারবেন প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল। সহজেই তিনি ফিলিস্তিন সংহতি কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে পারবেন।

স্কুলে লিঙ্গবৈষম্য নিষিদ্ধ করা আইনগুলো সম্ভবত বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠবে। এই আইন রক্ষণশীলদের খুবই অপছন্দের। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারও ট্রাম্পের অধীনে আক্রমণের শিকার হবে। তিনি প্রকাশ্যে ফেডারেল ঋণ মওকুফ কর্মসূচি এবং কম আয়ের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য গৃহীত কর্মসূচিকে ‘অবৈধ এবং অন্যায়’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রশাসন এগুলো বাতিল করার জন্য প্রস্তুত। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে লক্ষাধিক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবেন।

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি এবং ব্যাপক হারে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনাও উচ্চশিক্ষার ওপর প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে মার্কিন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে  ৪ লাখ ৮ হাজার অনথিভুক্ত শিক্ষার্থী রয়েছেন। অনেক রাজ্য এই শিক্ষার্থীদের টিউশন এবং রাজ্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত মাত্র তিনটি রাজ্য অনথিভুক্ত অভিবাসীদের পাবলিক কলেজে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আরও অনেক বেশি পাবলিক প্রতিষ্ঠান হয়তো বাধ্য হয়ে বা সরাসরি চাপে পড়ে এ ধরনের নীতি গ্রহণ করতে পারে।

তবে অন্যদিকে কিছু মানুষ ট্রাম্পের উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনাকে আমেরিকান জনগণের ইচ্ছা হিসেবে দেখছেন। প্রশাসনের প্রকাশ্যে ঘোষিত মতাদর্শ অনুযায়ী পুরো খাতকে পুনর্গঠনের অভিপ্রায়ের সঙ্গে আপস করার জন্য তারা প্রস্তুত বলে মনে হয়।

তবে কিছু মানুষ এই অনাগত ঝড় প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্বাচনের পরে আগস্ট মাসে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি প্রফেসরসের (এএইউপি)প্রেসিডেন্ট টড উইলসন বলেন, ‘আমরা এমন একটি মুহূর্তে রয়েছি, যা আগামী কয়েক দশক ধরে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমাদের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমেরিকার গণতন্ত্রের ভিত্তি। এরাই আমাদের সামাজিক গতিশীলতা, উদ্ভাবন এবং অগ্রগতির ইঞ্জিন। আমরা ফ্যাসিস্টদের সেগুলো কেড়ে নিতে দিতে পারি না। এখনই লড়াই করার সময়।’

নির্বাচনের পরেই উইলসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি যুক্তি দেন যে এই খাতে ক্রমহ্রাসমান সরকারি অর্থায়ন, বাড়তে থাকা ছাত্রঋণের বোঝা এবং একাডেমিক স্বাধীনতার ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আরও তীব্র হবে।

  • সোমদীপ সেন রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত