যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে একটি ফিলিস্তিনবিরোধী জনসমাবেশ থেকে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, ‘রাফা, রাফা, আমরা এখানে আসছি।’ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সংবাদমাধ্যম এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমবর্ধমান আন্দোলন নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ভরে উঠছে, প্রতিবাদ, প্রতিবাদকারীদের উদ্দেশ্য, পাল্টা প্রতিবাদ, পুলিশের কর্মকাণ্ড—এমন সব বিতর্ক দিয়ে। চিরচেনা বিশ্লেষকেরা যেন খুব আরাম করেই ভুলে যাচ্ছেন এসব ঘটনা আসলে কী কারণে ঘটছে।
বাস্তব গল্পটা গাজার মাটিতেই ঘটে চলেছে। বাদবাকি যা কিছু তার সবটাই পার্শ্বগল্প। কিছু গণহত্যার সমর্থক অনেক গোষ্ঠীই এই পার্শ্বগল্পের ওপরই মূল দৃষ্টিটা আটকে রাখতে চান।
বাস্তব গল্পটা সেই সমাজের, যেখানে এখন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। গাজার সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। গল্পটা সেই সমাজের, যেখানে মানুষের ভবিষ্যৎ ও জীবনের মৌলিক সান্ত্বনাটুকুও ঝুঁকিতে। গল্পটা তাদের, যারা এখন ইসরায়েলের পরবর্তী জাতি হত্যামূলক অভিযানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সর্বোপরি, গল্পটা ১৫ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির, যারা দক্ষিণ গাজার রাফায় গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের অনেকেই এবার নিয়ে সাতবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গল্পটা সেখানকার ছয় লাখ শিশুর, যাদের অনেকেই নতুন করে এতিম হয়েছে। গল্পটা তাদের, যারা না খেয়ে, পানি পান না করতে পেরে মরতে বসেছে।
বছরের পর বছর ধরে রাফা শহরের মানুষের ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আসছে। ১৯৫৬ সালে ইসরায়েলিদের আগ্রাসন ও দখলদারত্বের সময় প্রথম তারা গণহত্যার শিকার হয়েছিল। সেবার ইসরায়েলি সেনারা রাফা শরণার্থীশিবিরে অবস্থিত ইউএনআরডব্লিউএ (ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজি) স্কুলের দিকে লোকজনকে নিয়ে গিয়ে গুলি চালিয়েছিল। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সেখানে ১১১ জনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল, যাদের ১০৩ জনই শরণার্থী।
রাফা এখন গাজার শেষ জায়গা, এখনো যেখানটা ইসরায়েল পুরোপুরি ধুলায় মিশিয়ে দেয়নি। এমনিতেই রাফায় ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বাস করতেন। কিন্তু এখন পাঁচ গুণের বেশি মানুষ সেখানে আশ্রয় নিয়ে আছেন। এই রাফাকেই যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, তখন গাজায় আর কি অবশেষ থাকবে?
সংস্থাগুলো সতর্ক করছে যে রাফায় কোনো ধরনের অভিযান হলে আরও বেশি ফিলিস্তিনিকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া। একটা চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এমনিতেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মশা, মাছি, কীটপতঙ্গ রোগবালাই ছড়িয়ে দিচ্ছে।
গাজা সিটি, খান ইউনিসে যা হয়েছে, তার থেকে রাফায় ভিন্ন কিছু ঘটবে না। ওই বসতিগুলো ইসরায়েল পুরোপুরি মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করে দিয়েছে। গত সাত মাসের অভিজ্ঞতা থেকে যদি কেউ মনে করে ভিন্ন কিছু ঘটবে, তাহলে সেটা নিষ্পাপ ধারণা হবে।
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে কি অস্ত্রবিরতি চুক্তি হবে? উত্তর হলো দুই দিকের নেতৃত্বই চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী, কিন্তু প্রতিপক্ষ শত্রু তাদের ওপর দায় চাপায় কি না, সেটার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে, চুক্তির মধ্যে শর্ত যা-ই থাকুক না কেন, ইসরায়েলি বাহিনী রাফাকে দোজখে পরিণত করবেই।
রাফায় আটকে পড়া ফিলিস্তিনিরা মানসিক পীড়নের শিকার হচ্ছে। তিন মাস ধরে তারা দেখছে, আন্তর্জাতিক বিতর্ক চলছে রাফায় ইসরায়েলি বাহিনী অভিযান চালাবে নাকি চালাবে না। তারা জানে যে তাদের ওপর যন্ত্রণা ও দুঃস্বপ্ন অবধারিতভাবে আসছে, কিন্তু তারা জানে না, সেটা কখন আসবে। বাইরে থেকে অনেকে বুঝতে পারছে না, ইসরায়েল স্থল অভিযান শুরু না করলেও রাফায় নিয়মিত বোমা হামলা করে আসছে।
খুব ভাগ্যবান দু-একজন রাফা সীমান্ত দিয়ে মিসর পাড়ি দিতে পারছেন। সে জন্য তাদের বড় অঙ্কের অর্থ জোগাড় করতে হচ্ছে। ৫ হাজার ডলার জোগাড় করতে পারলেই প্রাপ্তবয়স্ক কেউ ফিস দিয়ে সীমান্ত পার হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে ইসরায়েলের মিত্রদেশগুলোর সবাই রাফায় অভিযান না চালানোর জন্য ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে। এই প্রথম পশ্চিমারা অন্তত দাবি করল, ইসরায়েল যেন সামনে না এগোয়। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, গাজার মানুষ তাদের ছোট্ট একটু আকাশের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে না।
কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষা নিয়ে তাঁর অবস্থানে অনড় আছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন থেকে সাম্প্রতিক বিবৃতিতে জোর দেওয়া হয়েছে, বেসামরিক লোকদের কীভাবে রক্ষা করা হবে, সেই পরিকল্পনা থাকতে হবে অভিযান পরিকল্পনায়।
নেতানিয়াহু খুব পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন যে ইসরায়েল রাফা অভিযানে যাবেই। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ শুধু রাফায় অভিযান নয়, নির্মূল অভিযানের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, গাজার সব মানুষের ভাগ্যে সেটাও হওয়া দরকার।
এই তত্ত্ব কি বাস্তবে কাজে আসবে? হামাস নেতাদের হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলকে তো নিরাপদ করতে পারেনি। গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস বোমা হামলা আট মাসে প্রবেশ করেছে। কিন্তু সেই হামলা নতুন সদস্য সংগ্রহ ও তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে হামাসকে কোনো সমস্যায় ফেলেনি। নেতানিয়াহুর অভিযান হামাসকে বরই পরমায়ু দিয়েছে। তারা আরও বেশি কট্টর হচ্ছে।
রাফায় আগ্রাসন জিম্মিদের মুক্তির ক্ষেত্রেও কোনো সহযোগিতাও করবে না। ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি সংস্থা স্পষ্ট করে বলছে, গাজায় আর কোনো নিরাপদ জায়গা অবশেষ নেই। মিসর বড় ধরনের শরণার্থী সংকটের ভয় করছে। এ অবস্থায় দেশটি চাইছে না সিনাই উপত্যকায় ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা যাক। রাফা থেকে মানুষজন গাজার উত্তর দিকে যেতে চাইলে সেটা খুবই বিপজ্জনক হবে। কারণ, পুরো জায়গাটি ভবনের ধ্বংসস্তূপ আর অবিস্ফোরিত বিস্ফোরকে পূর্ণ। আবার অনেকে এতটাই ছোট, বৃদ্ধ আর আহত যে তাদের পক্ষে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়াটা অসম্ভব।
এ ছাড়া রাফা থেকে যাঁরা বের হতে চান, তাঁদের জন্য নানা স্তরের চেক পয়েন্ট বসিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সেনারা যদি মনে করেন, রাফার কারও বয়স লড়াই করার মতো, তাহলে তাঁকে আর বাইরে বের হতে দিচ্ছে না। সুতরাং, ফিলিস্তিনের সব তরুণকে নির্বিচার শাস্তি দেওয়া চলছে।
গাজা সিটি, খান ইউনিসে যা হয়েছে, তার থেকে রাফায় ভিন্ন কিছু ঘটবে না। ওই বসতিগুলো ইসরায়েল পুরোপুরি মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করে দিয়েছে। গত সাত মাসের অভিজ্ঞতা থেকে যদি কেউ মনে করে ভিন্ন কিছু ঘটবে, তাহলে সেটা নিষ্পাপ ধারণা হবে।
রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, গাজায় যা ঘটতে চলেছে, তার জন্য বিশ্ব তৈরি নয়। ইসরায়েলকে থামাতে ব্যর্থ হওয়া ও গাজায় তাদের গণহত্যা চালাতে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে শাসনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কবর রচিত হওয়া।
ক্রিস ডয়েল, লন্ডনে অবস্থিত কাউন্সিল ফর আরব-ব্রিটিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের পরিচালক
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে