যে ব্যাংকিংয়ে পাকিস্তান সফল, আমরা কেন নয়

সময়টা ছিল ১৯৯৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ। তৎকালীন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী জেফ উইলিয়ামসকে নিয়ে গিয়েছিলাম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. আকবর আলি খানের কাছে। উদ্দেশ্য—অফশোর ব্যাংকিংয়ের ওপর প্রচলিত কর কমিয়ে মালয়েশিয়া, বাহরাইন কিংবা অপরাপর দেশের মতো অফশোর ব্যাংকিংকে চাঙা করার প্রয়াস। সর্বোপরি ব্যাংকের স্থিতিপত্রের উৎকৃষ্ট ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।

এনবিআর প্রধান সময় ও সুযোগটিকে যথার্থ মনে না করায় কাজটি আর হয়নি। এখন যখন ব্যাংক তথা গ্রাহকদের সবাই বিদেশি মুদ্রার তারল্যসংকটের মধ্য দিয়ে চলছেন, তখন অফশোর ব্যাংকিংয়ের প্রয়োজনীয়তাটি বেশি মনে হচ্ছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথার্থই এ ব্যাপারকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। 

যত দূর মনে পড়ছে, বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। আর চলতি বছর অফশোর ব্যাংকিং আইন ২০২৪-এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

নতুন আইনে বিদ্যমান আগের অনেক নিয়মকানুন সংস্কার ও শিথিল করা হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

আমাদের ধারণা, ডলারের প্রবাহ বাড়লে দেশে রিজার্ভের পতনও রোধ করা যাবে। বিনিয়োগ আকর্ষণেও এটি সহায়ক হবে। 

আশির দশকে আমাদের শেখানো হয়েছিল, অফশোর ব্যাংকিং হলো প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের চেয়ে পৃথক ও ভিন্ন একটি ব্যাংকিং সেবা। আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়া—দুটিই বৈদেশিক উৎস থেকে আসে এবং বিদেশি বা সমপর্যায়ের গ্রাহকদের দেওয়া হয়। অর্থাৎ এই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুধু অনিবাসী বা অনিবাসীতুল্যদের মধ্যেই সীমিত থাকে। 

অফশোর ব্যাংকিং নিয়ে অভিযোগ হলো, এর মাধ্যমে অর্থ পাচার হয় বেশি। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনায় এই ব্যাংকিংয়ের সুবিধাই বেশি, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধিতে। এতে সব লেনদেন হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। অধুনা প্রচারিত নির্দেশনা অনুসারে, অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে পাঁচ ধরনের বিদেশি মুদ্রা— ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে।

প্রবাসীদের জন্য ডলারে আমানত রাখার সুযোগ দিয়ে ২০২৩ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

প্রবাসী পাকিস্তানিরা ইতিমধ্যে এ ব্যাংক হিসাবে প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের ওপর জমা করেছেন। এ মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে এশিয়ার শীর্ষ মুদ্রা পাকিস্তানি রুপি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩০৮ থেকে ৩১০ রুপি, বর্তমানে তা ২৭৯ রুপিতে নেমে এসেছে। ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি ১০ শতাংশের বেশি শক্তিশালী হওয়ায় দেশটির নিট রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উন্নীত হয়েছে। 

প্রজ্ঞাপনটি অনুযায়ী, ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে হিসাব খুলে প্রবাসীরা ডলারে মেয়াদি আমানত রাখতে পারবেন। মেয়াদ শেষে কিংবা যেকোনো সময়ে প্রবাসীরা ডলারে আমানত তুলে নিতেও পারবেন।

বাংলাদেশের বাইরে অবস্থানকারী প্রবাসী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক, বিদেশে নিবন্ধিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এ আমানত হিসাব পরিচালনার সুযোগ পাবেন। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে প্রবাসীদের জন্য ইতিমধ্যে দুই ধরনের ব্যাংক হিসাব চালু করে দেশের কয়েকটি ব্যাংক।

প্রথমটি হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব বা আইবি অ্যাকাউন্ট। প্রবাসীদের দেশে অবস্থানরত যেকোনো স্বজন ব্যাংকে গিয়ে এ হিসাব চালু করতে পারবেন। প্রবাসী বাংলাদেশি ওই হিসাবে ডলার পাঠাবেন এবং দেশে থাকা স্বজন হিসাবটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন।

অন্যটি হলো অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট। প্রবাসীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গিয়ে এ হিসাব খুলে সেখানে যেকোনো মেয়াদে ডলারে বা বিদেশি মুদ্রায় আমানত রাখতে পারবেন। পরে যেকোনো সময় জমাকৃত আমানত মুনাফাসহ প্রত্যাবাসন করা যাবে। 

আরও পড়ুন

এ দুভাবে জমাকৃত আমানতের মুনাফার ওপর বাংলাদেশে কোনো কর পরিশোধ করতে হবে না। হিসাব পরিচালনায় কোনো মাশুলও প্রদান করতে হবে না। এসব সুবিধার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, প্রবাসীরা অফশোর ব্যাংকিংয়ে আকৃষ্ট হবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রার আমানত বাড়বে, যা দেশের ডলার–সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারে। 

আমরা জানি, দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল তিন বিলিয়ন ডলারের ঘরে। সেই পরিস্থিতি থেকে দেশটি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে ‘রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট’ নামের একটি ব্যাংক সেবার মাধ্যমে।

প্রবাসী পাকিস্তানিরা ইতিমধ্যে এ ব্যাংক হিসাবে প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের ওপর জমা করেছেন। এ মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে এশিয়ার শীর্ষ মুদ্রা পাকিস্তানি রুপি। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩০৮ থেকে ৩১০ রুপি, বর্তমানে তা ২৭৯ রুপিতে নেমে এসেছে। ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপি ১০ শতাংশের বেশি শক্তিশালী হওয়ায় দেশটির নিট রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উন্নীত হয়েছে। 

প্রবাসী পাকিস্তানিরা অল্প কিছু নথিপত্র দিয়ে অনলাইনেই রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট চালু করতে পারেন; পুরো প্রক্রিয়াই সম্পাদিত হচ্ছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ এ হিসাব চালুর ক্ষেত্রে ব্যক্তির উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। ডলারে জমাকৃত আমানত প্রত্যাহার প্রক্রিয়াটিও বেশ সহজ। আকর্ষণীয় মুনাফার পাশাপাশি প্রক্রিয়াগত জটিলতা না থাকায় সেখানে ডলার জমা রাখতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন প্রবাসীরা। 

আড়াই বছর ধরে ডলার–সংকটের কারণে বাংলাদেশে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। ডলারের গ্রস রিজার্ভ ১৮ থেকে ২০ বিলিয়নের ঘরে (আইএমএফের শর্ত অনুসারে হিসাবায়নে) নেমে এসেছে। আর ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ নেমে এসেছে মাত্র ১৩ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টের মতো অফশোর ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশেরও পরিস্থিতির উন্নয়ন হতে পারে। যদিও অনেকে মনে করছেন, এ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ডলারে আমানত সংগ্রহ করতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা। মানুষের হাতে নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ এটি। 

এ ক্ষেত্রে তাই অনাস্থা দূরীকরণে প্রথম কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রবাসীদের পুরো প্রক্রিয়ার স্পষ্ট স্বরূপ তুলে ধরতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করতে হবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায়। ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরলে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কারণ, তখন সামগ্রিকভাবে প্রবাসী আয় বৈধ পথে আনয়ন বৃদ্ধি পাবে এবং বিদেশি মুদ্রায় প্রবাসীদের আমানতও বাড়ানো সম্ভব হবে। তবে আর্থিক খাতে সংস্কার আর স্বচ্ছতা-জবাবদিহি থেকে কখনো মনোযোগ ফেরানো যাবে না। 

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক