বীভৎস একটি ঘটনার ১৮ বছর পর সেটার মূল্যায়ন কেমন হওয়ার কথা—এ প্রশ্ন বারবার মনে এসেছে এ বছরের ২১ আগস্ট দিনটিতে। আওয়ামী লীগের জনসভায় বর্বর গ্রেনেড হামলার ১৮ তম বার্ষিকী পার হলো এ বছর। খুব মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করছিলাম রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও আপাত-অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা এ ঘটনাকে এখন কীভাবে দেখেন। খেয়াল করলাম, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ঘটনা এমন বীভৎস পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেটা ভেঙে ফেলেছে এ রাষ্ট্রের কাঠামোটিকেই। এটা কীভাবে, সে আলোচনায় যাওয়ার আগে তুলনীয় একটি বিষয় নিয়ে কিছুটা আলাপ করা যাক।
কমিউনিস্ট বিপ্লব সফল হওয়ার পর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে জাতীয় মনস্তত্ত্বে নানা মাধ্যমে একটি ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ক্রমাগত। সেটা হচ্ছে ‘নিপীড়িত ও অপমানিত হওয়ার শতবর্ষ’ (সেঞ্চুরি অব হিউমিলিয়েশন)। মোটাদাগে এ সময় হচ্ছে ১৮৩৯ সাল থেকে কমিউনিস্টদের হাতে চীনের মূল ভূখণ্ডের শাসনভার যাওয়া পর্যন্ত (১৯৪৯ সাল)।
এই শতবর্ষে চীনে ইউরোপীয়দের (মূলত ব্রিটিশদের) আফিম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দুটি ‘আফিম যুদ্ধে’ চীন পরাজিত হয়েছিল। প্রথম যুদ্ধে ব্রিটেন একা এবং দ্বিতীয় যুদ্ধে যুক্ত হয় ফ্রান্স ও আমেরিকাও। পরাজিত চীনের জনগণকে আফিমে আসক্ত করে বিরাট ব্যবসা করে পশ্চিমারা। উপর্যুপরি চীনকে হংকং ছেড়ে দিতে হয় ব্রিটেনের হাতে। এ সময়ে রাশিয়া চীনের ওপরে আক্রমণ করে এবং এর উত্তর-পূর্ব দিকের কিছু অংশ দখল করে নেয়, যার মধ্যে রয়েছে বর্তমানের ভ্লাদিভস্তক ও সাখালিন দ্বীপ। কিছু পরেই পর্তুগিজদের আক্রমণের মুখে হাতছাড়া হয় চীনের ম্যাকাও।
এর কিছুদিন পর জাপানের দখলে চলে যায় তাইওয়ান এবং কোরিয়া উপদ্বীপ থেকে চীনের প্রভাব শেষ হয়ে যায়। এরপর বক্সার বিদ্রোহীদের শক্তিতে আশান্বিত হয়ে চীন সেখানকার পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, যাদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, রাশিয়া, জাপান, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও স্পেন। এখানেও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় চীন। ‘সেঞ্চুরি অব হিউমিলিয়েশন’-এর শেষ পর্যায়ে জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া দখল করে এবং ১৯৩৭ সালে পুরো চীন আক্রমণ করে। সেই আক্রমণের সময় চীনের নানকিং শহরে জাপানের এক বীভৎস হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হয় (নানকিং ম্যাসাকার)।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা। সে সময়ের ক্ষমতাশীল দল হিসেবে বিএনপির সরকারের দায়িত্ব ছিল এ ঘটনার একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করা। কিন্তু অতি আলোচিত, কুখ্যাত জজ মিয়া-কাণ্ড সে সময় বিএনপির ভূমিকাকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস বলে আসলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। ইতিহাসমাত্রই কম বা বেশি ব্যক্তিনির্ভর (সাবজেক্টিভ)। ফলে, এ সময়ে ঘটা ঘটনাগুলোয় ঠিক কতটা কী হয়েছে, মৃত্যুর সংখ্যা কত, এসব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বয়ান আছে। যেমন নানকিং ম্যাসাকারে চীনের দাবিমতো তিন লাখের বেশি মানুষ হত্যা কোনোভাবেই জাপান মেনে নেয়নি; তাদের হিসাবে এ সংখ্যা অনেক কম। তবে বাস্তব ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, চীন এই ১০০ বছরে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাপানের হাতে ভয়ংকর নিপীড়ন ও অপমানের শিকার হয়েছে—এমন একটা বয়ান সমাজে জারি রেখেছে। এ বয়ানের ফল নিয়ে আলোচনা করব কলামের শেষের দিকে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা। সে সময়ের ক্ষমতাশীল দল হিসেবে বিএনপির সরকারের দায়িত্ব ছিল এ ঘটনার একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করা। কিন্তু অতি আলোচিত, কুখ্যাত জজ মিয়া-কাণ্ড সে সময় বিএনপির ভূমিকাকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তখনকার ভুক্তভোগী দল আওয়ামী লীগের কাছে এ বিষয়গুলো কতটা নির্মম মনে হয়েছে তা আমরা অনুমান করতে পারি। শুধু সে সময়ের কথাই-বা কেন বলছি, বর্তমানেও বিএনপির পক্ষ থেকে ২১ আগস্ট নিয়ে যে ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়, সেটা আওয়ামী লীগের ক্ষোভ ও ক্ষুব্ধতায় প্রলেপ দেওয়ার মতো কিছু নয়।
খুব ভালো হতো, যদি এ বিষয়ে সে সময়ের ক্ষমতাসীন দল বিএনপি তার ব্যর্থতাগুলো স্বীকার করে নিত। কিন্তু বাংলাদেশের দায় অস্বীকারের সংস্কৃতিতে দলটি ব্যতিক্রম হতে পারল না। সবকিছু ছাপিয়ে এখন এ প্রশ্ন হওয়া উচিত, মর্মান্তিক ঘটনাটির রেশ এ দেশের মানুষকে আর কত দিন ও কীভাবে টেনে যেতে হবে?
২১ আগস্টের ঘটনাকে সামনে এনে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিএনপির রাজনীতি করার অধিকার নেই। এমনকি কেউ কেউ বিএনপিকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি পর্যন্ত করেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের এসব বক্তব্যকে বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি (রেটোরিক) হিসেবে বিবেচনা করে আলোচনা করা যেতেই পারে। কিন্তু বিষয়টা কি এতটা সরল?
আমাদের সমাজে ২১ আগস্টের ফলাফল নিয়ে নানা মহল থেকে যে বয়ান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা ভয়ংকর। কলাম কিংবা টিভির টক শোর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে প্রায়ই আমি দেখি, অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করেন যে দলটি তার প্রতিযোগী (কিংবা প্রতিপক্ষ) দলের প্রধানকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে সেই দলের সঙ্গে কোনো রকম রাজনৈতিক সমঝোতা কীভাবে সম্ভব? এভাবেও কেউ বলার চেষ্টা করেন, আপনি আমাকে খুন করার জন্য চেষ্টা করেছেন, আপনার সঙ্গে আমার কোন আলোচনা-সমঝোতার প্রশ্নই আসে না।
বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ, একদলীয় শাসনের দেশ নয়। সংবিধানে যেহেতু এখনো পাঁচ বছর অন্তর একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের কথা আছে, তাই এখনো কাগজে-কলমে হলেও নির্বাচনটি হতে হয়। কখনো সেটা একতরফা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাওয়ার মতো নির্বাচন, আবার কখনো সেটা রাতের বেলা ব্যালট বাক্স ভরে রাখার মতো অকল্পনীয় ঘটনার নির্বাচন।
গত দুটি নির্বাচন যেভাবে হয়েছে এ দেশে, তাতে সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও এগুলোর পক্ষে খুব শক্তভাবে কথা বলতে পারেন না। তাই তাঁরা সরকারের যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার পথে কিছু পরিস্থিতিকে ডেকে আনেন, যেগুলো দিয়ে তাঁরা পরোক্ষভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আওয়ামী লীগ অনৈতিক ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় থেকে গেলেও সেটা দরকার ছিল। এর মধ্যে আনা হয় উন্নয়নের বয়ান, আনা হয় জঙ্গিভীতি, সর্বোপরি প্রধান বিরোধী দলটির সঙ্গে ২১ আগস্টের স্মৃতিসহ নানা যৌক্তিক কারণে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা না থাকার কথা।
দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে ২১ আগস্টকেন্দ্রিক দুই দলের মধ্যকার সংঘাতকে ইদানীং প্রায়ই সামনে আনা হয়। এটাও বলা হয়, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষ থেকেই পাল্টাপাল্টি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে সেটা মিটমাট হতে কয়েক প্রজন্ম লেগে যেতে পারে। যাঁরা এ ধরনের বক্তব্য দেন, তাঁরা ভুলে যান, দুজন ব্যক্তির মধ্যে বিরোধ, এমনকি প্রাণসংহারজনিত সমস্যা থাকা আর দু-দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ থাকা একেবারেই এক নয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে কেউ চাইলে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না-ই রাখতে পারেন। চাইতে পারেন বিচারিক ব্যবস্থায়, এমনকি বিচারিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে কোনো মোক্ষম সময়ে কোনো কৌশলে তার ওপরে চরম প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু একটি দলকে শত্রুজ্ঞান করে রাষ্ট্রক্ষমতা যেকোনো মূল্যে দখল করার পক্ষে যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সরকার ক্ষমতায় আছে প্রায় ১৪ বছর। হামলার তদন্ত, বিচার—সব এ সরকারের ক্ষমতায় থাকার সময় হয়েছে। তদন্ত নিয়ে এবং চূড়ান্ত আসামির তালিকা নিয়ে বিএনপির অবশ্য অভিযোগ আছে, কিন্তু এ আলোচনায় এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের কথা হচ্ছে, একটা ভয়ংকর অপরাধ হয়েছে এবং সে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমতাসীনেরা চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। তাঁদের বিচার হচ্ছে এবং সব ধাপ শেষ করে সেই বিচার কার্যকর করা হোক।
একটা ব্যক্তিগত অপরাধ বা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক লক্ষ্যে পরিচালিত হত্যাকাণ্ড মিলিয়ে দেখা সমীচীন হবে না, তা আমরা জানি। এটাও জানি, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে, থাকে। কিন্তু আমরা এটাও জানি, যে যথাযথ নির্বাচন না করে যেকোনোভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার অস্ত্র হিসেবে কোনো রাজনৈতিক ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করাটাও অগ্রহনযোগ্য।
চীনের ওপর শত বছর ধরে যা হয়েছে, সেটা ভয়ংকর অন্যায়, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। চীন তার শত বছরের নিপীড়িত ও অপমানিত হওয়ার ক্ষতকে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মে চাঙা রেখেছে। ওই সময় থেকে চীনের নিশ্চয়ই শিক্ষা নেওয়ার আছে; বিশেষ করে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে নিজের প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু অতীত সেই ইতিহাসের ভিত্তিতে নিজের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা ধরে রেখে, এমনকি আরও চাঙা করে তুলে চীন এখন অনেকটাই আগ্রাসী দেশে পরিণত হয়েছে। একসময় অত্যাচারের শিকার হয়েছিল বলে এখন চীন অন্য দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তাব করবে সেটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো বিষয় নয়।
২১ আগস্টের ঘটনা দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককে আঘাত করেছে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য এ আঘাতের তীব্রতা নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি। তাদের ভেতরের সেই ক্ষতের প্রতি সর্বোচ্চ সংবেদনশীলতা ও সহমর্মিতা জানিয়েও বলতে চাই, এটা যথাযথ নির্বাচন ছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখাকে কোনোভাবেই জায়েজ করে না।
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক