এরপরেও কি আজারবাইজান–রাশিয়ার সম্পর্ক টিকে থাকবে

ফ্লাইট ৮২৪৩-এর এই পরিণতি কি রাশিয়া ও আজারবাইজানের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে?

এই সপ্তাহে বড়দিনে বিমান দুর্ঘটনায় ৩৮ জনের মৃত্যুতে আজারবাইজান শোকের মধ্যে ডুবে আছে। সেই সময় নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের শেষ দিন। আজারবাইজান তাদের সীমান্তের কাছে, আর্মেনিয়ার আকাশসীমায় থাকা একটি রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছিল।

সঙ্গে সঙ্গে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে ফোন করেন। নিজের, দেশের পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করে ক্ষমা চান। তারপর দোষীদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়।

চার বছর পর, প্রেক্ষাপট প্রায় উল্টো হয়ে গেছে।

২০২৪–এর ২৫ ডিসেম্বর, আজারবাইজান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৮২৪৩ বাকু থেকে চেচনিয়ার গ্রোজনিতে যাত্রা শুরু করে। ৬৭ জন যাত্রী এবং ক্রুসহ প্লেনটি রাশিয়ার আকাশসীমায় গ্রোজনির কাছে পৌঁছানোর পর ভূমি থেকে ছোড়া গুলির আঘাতপ্রাপ্ত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিমানটি পূর্ব দিকে গতিপথ পরিবর্তন করে কাজাখস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় আকতাউয়ের কাছে বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় মাত্র ২৯ জন বেঁচে ছিলেন।

যদিও রুশ কর্মকর্তারা প্রথমে অনুমান করেছিলেন যে প্লেনটি পাখির ঝাঁকের সাথে ধাক্কা খেয়েছিল বা প্লেনের ভেতরে থাকা অক্সিজেন ট্যাংক বিস্ফোরিত হয়েছিল। তবে আঘাতের ধরন রুশ আকাশ প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত ভূমি থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে মেলে বলে মনে হয়েছে। শনিবার, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই ‘দুঃখজনক ঘটনায়’ দুঃখ প্রকাশ করলেও রাশিয়ার পক্ষ থেকে সরাসরি দায় স্বীকার করেননি। তিনি দাবি করেন যে ওই এলাকায় ইউক্রেনীয় ড্রোন উপস্থিত ছিল।

তবে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ রাশিয়ার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার এবং বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। ২০২০ সালে যেমন দায়িত্বশীলতা দেখিয়েছিলেন, এই ঘটনায় তেমনই আশা করছেন আলিয়েভ।

‘আজারবাইজান এখন একই প্রত্যাশা করছে। তবে আমরা সেরকম কিছু এখনো দেখতে পাইনি’, বলেন মাম্মাদভ। ‘যদি রাশিয়া আংশিক ক্ষমার পথ বেছে নিয়ে থাকে, তাহলে আমরা আশা করব পরবর্তী সময়ে রাশিয়া ক্ষমা, শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণ নিয়ে তদন্ত চালিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’

অনেক আজারবাইজানির কাছে এ শুধু তাদের বিমান আর নাগরিক হারানোর প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা বরং রাশিয়া কীভাবে এই ঘটনায় সাড়া দেয় সেটার। বাকুর বাসিন্দা লেইলা আল–জাজিরাকে  বলেন, ‘যা এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে তা হলো প্লেনটা আঘাত পাওয়ার পর রাশিয়ার ভূখণ্ডে অবতরণের অনুমতি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এই ব্যাপারটা মানুষ ক্ষমা করতে পারছে না’।

আজারবাইজানের কর্মকর্তাদের দাবি, রাশিয়ায় জরুরি অবতরণের অনুমতি না পেয়ে পাইলটরা বাধ্য হয়ে ক্যাস্পিয়ান সাগর পেরিয়ে আকতাউয়ের দিকে গতি পরিবর্তন করেন। যদি প্লেনটি রাশিয়ায় অবতরণের সুযোগ পেত, তাহলে হয়তো জীবনগুলো রক্ষা করা যেত। কিন্তু এর বদলে প্লেনটিকে কাজাখস্তানে পাঠানো হয়। লেইলা আরও বলেন, ‘মানবতার অভাব এবং জবাবদিহির অভাবই মানুষকে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করছে।’

তাহলে ফ্লাইট ৮২৪৩-এর এই পরিণতি কি রাশিয়া ও আজারবাইজানের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে?

আজারবাইজান এক সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র। তেলসমৃদ্ধ দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার উত্তরের বিশাল সীমান্ত রয়েছে আর তাদের মাঝে সম্পর্ক জটিল। তবে বাল্টিক দেশগুলোর মতো পুরোপুরি শত্রুতাপূর্ণ নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর আজারবাইজান সাময়িকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু ১৯২০ সালে, রেড আর্মি আক্রমণ করে আজারবাইজানকে পরবর্তী সাত দশকের জন্য মস্কোর অধীনে ফিরিয়ে আনে।

১৯৯১ সালে আজারবাইজানের স্বাধীনতা লাভের প্রথম কয়েক বছর দ্বিধায় কাটে। রাজধানী বাকুতে দুটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ছিল ক্রেমলিনের সমর্থনপুষ্ট। এরপর আজারবাইজান নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের বিরোধ নিয়ে আর্মেনিয়ার সঙ্গে তিক্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে রাশিয়া আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। মস্কো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করেছে এবং কারাবাখে শান্তিরক্ষী সৈন্য মোতায়েন করেছে। আবার একই সময়ে রাশিয়া উভয় পক্ষের কাছে অস্ত্রও বিক্রি করে।

এই শান্তিরক্ষী সৈন্যরা গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আজারবাইজানি বাহিনী কারাবাখ দখল করার সময় কোনো ভূমিকা নেয়নি। ফলে প্রায় সমগ্র আর্মেনিয়ান জনগণ পালিয়ে যায়। অথচ আর্মেনিয়া রাশিয়া নেতৃত্বাধীন একটি ন্যাটোসদৃশ জোট, কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (CSTO)-এর সদস্য। এই বছর এপ্রিল মাসে, বাকু যখন কারাবাখে তার নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করে, তখন রুশ শান্তিরক্ষীরা অবশেষে অঞ্চলটি থেকে সরে যায়।

মোটের ওপর, প্লেন দুর্ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা বাদ দিলে, রাশিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে সম্পর্ক ভালো। ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে আজারবাইজান কোনো পক্ষ নেয়নি। তারা দক্ষিণ ককেশাসে রাশিয়ার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। দেশটি ইরান থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ নিয়ন্ত্রণ করে। তেমনি, অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে রাশিয়ার গুরুত্ব আজারবাইজানের কাছে অনেক।

আজারবাইজানের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে প্রথম স্থানে রয়েছে ইতালি, দ্বিতীয় স্থানে তুরস্ক এবং তৃতীয় স্থানে রাশিয়া। এই দিক থেকে, আজারবাইজান ও রাশিয়ার জন্য বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ।

আজারবাইজানের বেশির ভাগ বিমান রাশিয়া হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যেত, অন্তত এই ঘটনার আগে। দক্ষিণ ককেশাসে সবচেয়ে বড় রুশ সম্প্রদায় বাস করে। এদের সংখ্যা প্রায় ১,২০,০০০। আবার প্রায় ১০ লাখ আজারবাইজানি রাশিয়ায় বসবাস করেন। সব মিলিয়ে আজারবাইজান রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে আগ্রহী নয়।

  • নিকো ভোরোবিয়োভ একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং লেখক।