তাঁরা পাবেন মহার্ঘ ভাতা, অন্যরা কি টিসিবি ট্রাকের লাইনে দাঁড়াবে

সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন সরকারি ব্যক্তিবর্গের বাইরের মানুষদের কী হবে?

মহার্ঘ মানে বড় উপহার। মহা +অর্ঘ্য= মহার্ঘ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য রাষ্ট্র বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত যে ভাতা প্রদান করে তা মহার্ঘ ভাতা নামে পরিচিত।
গত রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান।

তাঁর ভাষ্য হলো, একটি পে কমিশন গঠন সময়সাপেক্ষ বিষয়। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সর্বস্তরের কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে। কর্মরতদের পাশাপাশি অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এবার মহার্ঘ ভাতার সুবিধা পাবেন। কত শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করতে কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

আমরা জানতে পারছি, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেওয়া যায়, তা নিয়ে কাজ চলছে। পিয়ন থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পর্যন্ত সবাই মহার্ঘ ভাতার সুবিধা পাবেন। সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর একটি নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করার কথা।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে অষ্টম বেতন স্কেল কার্যকর হয়। সে সময় নতুন স্কেলের সুপারিশ না করলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির (ইনক্রিমেন্ট) প্রস্তাব ছিল বেতন কমিশনের। ২০২৩ সালের জুলাইয়ের আগপর্যন্ত প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পান। এটাকে অনেকে নির্বাচনী বছরে সরকারি কর্মীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। তবে ২০২৪ সালে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়নি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে যেসব যুক্তি দিয়েছেন, তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দাম ও সংসারের অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারি কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব যৌক্তিক।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার অযৌক্তিক সুবিধা দিয়েও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করতে চেয়েছে; বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের বিনা সুদে গাড়ির ঋণ ও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ভাতা। এ ছাড়া সরকারের হঠাৎ মনে হয়েছিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষেও একটা ভাতা দেওয়া যায়।

সরকার চাইলে যে কাউকে ভাতা দিতে পারে। কিন্তু দেখার বিষয়, এর পক্ষে কী যুক্তি আছে। তাদের জানা উচিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভাতা দিলেই বাংলা নববর্ষ মর্যাদা পায় না। বাংলা নববর্ষ মর্যাদা তখনই পায়, যখন আমরা নববর্ষের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে পারব। অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের বাংলা নববর্ষের ভাতা দিয়ে সরকার সরকারি ও বেসরকারি কর্মীদের সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য আরও বাড়িয়ে দিল। সরকার জনগণের করের অর্থে সরকারি কর্মচারীদের ভাতা দিল। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও শ্রমিকেরা কেউ ভাতা পেলেন না। বৈষম্য আরও বেড়ে গেল। এর মধ্য দিয়ে উৎসব উদ্‌যাপনকেও দুই ভাগ করে ফেলা হলো না?

২০১৫ সালে সর্বশেষ বেতনকাঠামো ঘোষণা করা হয়, যাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়ালে তাঁরা দুর্নীতিতে জড়াবেন না। বৈধ উপার্জন দিয়েই তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবেন।

বর্তমানে বাংলাদেশ মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ। ধরে নিলাম, প্রতি পরিবারে পাঁচজন মানুষ আছে। সে ক্ষেত্রে ৭০ লাখ মানুষকে সরকার স্বস্তি দিল মহার্ঘ ভাতা দিয়ে। ধরে নিলাম, আরও ৭০ লাখ মানুষ আছে, যাদের মূল্যস্ফীতির খড়্গ খুব একটা স্পর্শ করবে না। এরা হলেন সমাজের বিত্তবান মানুষ। সুবিধাভোগী অংশ। কিন্তু এর বাইরে যে ১৫ কোটি মানুষ আছে, তাদের কী হবে?

কিন্তু গত ৯ বছরের অভিজ্ঞতা হলো, সরকারি অফিসে ঘুষ ও দুর্নীতি আরও বেড়েছে। আগে সরকারি কর্মকর্তারা যে হারে ঘুষ নিতেন, ২০১৫ সালের পর হারটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও সাবেক এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের ভয়াবহ দুর্নীতির আখ্যান আমরা জানি।

বেনজীর সংখ্যালঘুদের শত শত বিঘা জমি দখল করে বিলাসী রিসোর্ট করেছেন। মতিউরের ছেলে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কিনে ভাইরাল হয়েছিলেন। ফেসবুকে দেখলাম সেই মতিউর জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান নিয়েও বই লিখেছেন। বিদেশে বসে বেনজীর আহমেদও এই অভ্যুত্থান নিয়ে দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। প্রথম আলোয় খবর বের হয়েছিল, বেনজীর যে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম পিএইচডি নিয়েছেন, সেখানে তাঁর ভর্তি হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও ছিল না।
জনপ্রশাসন সচিব মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার দোহাই দিয়েছেন।  কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় তো কেবল সরকারি কর্মীদের বাড়েনি; দেশের সব নাগরিকেরই বেড়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ। ধরে নিলাম, প্রতি পরিবারে পাঁচজন মানুষ আছে। সে ক্ষেত্রে ৭০ লাখ মানুষকে সরকার স্বস্তি দিল মহার্ঘ ভাতা দিয়ে। ধরে নিলাম, আরও ৭০ লাখ মানুষ আছে, যাদের মূল্যস্ফীতির খড়্গ খুব একটা স্পর্শ করবে না। এরা হলেন সমাজের বিত্তবান মানুষ। সুবিধাভোগী অংশ। কিন্তু এর বাইরে যে ১৫ কোটি মানুষ আছে, তাদের কী হবে?

সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা ঘোষণার পর সরকার কি বেসরকারি খাতের কর্মীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে? সরকার বললেও কি তারা মানবে? মহার্ঘ ভাতা যত কম লোককেই দেওয়া হোক না কেন, বাজারে তার একটা প্রভাব পড়বে। সে ক্ষেত্রে নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। সাধারণ মানুষকে আরও বেশি কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।  

জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার দোহাই দিয়ে সরকার যখন মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা কী। টিসিবির ট্রাকের সামনে নারী-পুরুষের সারি আরও দীর্ঘ হচ্ছে। আগে দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরাই কম দামে চালসহ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়ার জন্য লাইন দিতেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, সেই লাইনে ‘ভদ্রলোকেরাও’ যোগ দিচ্ছেন। তবে লাইনে দাঁড়ানো সব মানুষ চাল পাচ্ছেন, তা-ও নয়। কেউ কেউ খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।

মনে হচ্ছে, সরকারের সমস্ত উদ্যোগ-আয়োজন সরকারি কর্মকর্তাদের জন্যই। তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্যই। তাদের পদোন্নতি ও মহার্ঘ ভাতা নিয়ে আগের ও পরের সরকার যতটা উদ্বিগ্ন, সরকারি খাতের বাইরের কর্মীদের জন্য ততটাই নির্বিকার।

বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের অবস্থা আরও শোচনীয়। তৈরিপোশাকসহ কয়েকটি খাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বেধে দেওয়া হলেও বেশির ভাগ বেসরকারি খাতে ন্যূনতম মজুরি কিংবা চাকরিবিধি বলতে কিছু নেই। নিয়োগপত্র, প্রভিডেন্ট ফান্ড কিংবা গ্র্যাচুইটি বলতে কিছু নেই। মালিকের মর্জির ওপরই তাদের চাকরি থাকা না থাকা নির্ভর করে।

মূল্যস্ফীতির খড়্গ থেকে সাধারণ ও নিম্নবিত্ত মানুষকে বাঁচাতে সরকারের সেই অর্থে পদক্ষেপ কই? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কিছু পণ্যের শুল্ক কমানো ও বাদ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর প্রভাব তো বাজারে পড়ল না। জ্বালানি তেলের মূল্য যে হারে কমানো হলো তাও সন্তোষজনক নয়। সারের দাম কমালেও কৃষকেরা উপকৃত হতেন, যেহেতু কয়েক দফায় বন্যায় তাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরাও তেমন কোনো প্রণোদনা পেলেন না। এই সব মানুষদের কথা কে ভাববে?  

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
    ই-মেইল: [email protected]