গত মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তখনো মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের রাজনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতির বিষয়টি ছিল অনেক দূরবর্তী জল্পনা। যদিও বেশির ভাগ বিশ্লেষক এখন এ ব্যাপারে একমত যে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কৌশলনীতির লক্ষ্য জ্বালানি বিনিময়ের চেয়েও বড় কিছু। প্রশ্ন আছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে সেই জায়গা কি নিতে চায় চীন? নিজেদের শক্তি দেখাতে বেইজিং কি তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সেনা মোতায়েন করবে?
এই দুটি প্রশ্ন যৌক্তিক এবং পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি, রাজনীতি ও কূটনীতিতে বেইজিংয়ের সম্পৃক্ততা যেভাবে বাড়ছে, তাতে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ও আন্ত–আঞ্চলিক গতিধারা পরিবর্তনে বেইজিংয়ের সামর্থ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পরাশক্তির প্রতিযোগিতা রয়েছে। ওই অঞ্চলে আমেরিকার ভূমিকা এবং সামরিক ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের উপস্থিতি বিবেচনায় নিলে চীনের কৌশলনীতি প্রকৃতপক্ষেই আপনার কৌতূহল জাগাবে।
তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চীনের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ রয়েছে। চীন তাদের অপরিশোধিত তেলের ৫৩ শতাংশের বেশি আমদানি করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। জ্বালানির এই বাজার নষ্ট হোক, সেটা কখনোই চাইবে না বেইজিং। পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর চীনের নির্ভরশীলতা এবং এই সংবেদনশীলতার কারণে সামরিক সংঘাতের যে শঙ্কা—এই বিবেচনায় ওই অঞ্চলে চীনের সেনা মোতায়েন করতে চাওয়া যৌক্তিক বলে মনে হবে।
যৌক্তিক হলেও এই ধারণা কি সঠিক? সম্ভবত না।
যুক্তরাষ্ট্র কি ভাবছে কিংবা কোনটা তাদের কাছে গ্রহণীয় হয়, সেটা বিবেচনায় না নিয়ে চীন তাদের মতো করেই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করবে।মধ্যপ্রাচ্যে যদি কখনোই বড় পরিসরে চীনের সেনাবাহিনীর মোতায়েন না–ও হয় তারপরও দেশগুলোতে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গণ্য হবে।
বেইজিংয়ে জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে, এমন দুটি ক্ষেত্র হলো জ্বালানির উৎপাদন ও পরিবহন। প্রথমটার ক্ষেত্রে কোনো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা কিংবা আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘাত সবচেয়ে বড় হুমকি তৈরি করতে পারে। জ্বালানি পরিবহনের বিষয়টিতে আরও কিছু বৈচিত্র্যময় বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা, সমুদ্রপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ ঘটনা হতে পারে নৌ অবরোধ।
যতক্ষণ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ওপর চীনের নির্ভরতা থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তেলের উৎপাদন ও পরিবহনের ক্ষেত্রে এ ধরনের হুমকি বাস্তব বিষয় হয়ে থাকবে।
যাহোক, চীনের নেতারা বাস্তববাদী এবং তারা সন্দেহ ও সংবেদনশীলতা—এই দুইয়ের পার্থক্য বোঝেন। মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ওপর অতিনির্ভরতার কারণে সেই বাজার কোনোভাবে নষ্ট হবে কি না, সেই প্রশ্নে বেইজিং মনে করে, এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও সংবেদনশীল হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর কারণ হলো, তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যকে যেমন দরকার চীনের ঠিক একইভাবে ক্রেতা হিসেবে চীনকে দরকার মধ্যপ্রাচ্যের।
এ ছাড়া তেল উৎপাদন ও পরিবহনের মতো সংকট সৃষ্টি হলে চীন একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এর অভিঘাত এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপের তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ওপর পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র হোক, চীন হোক, এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, কেউই তা চাইবে না।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এখন সবচেয়ে বড় বিরোধের জায়গা হলো তাইওয়ান। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সামরিক বৈরিতা শুরু হলে, ওয়াশিংটন তাদের সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে চীনের জ্বালানি সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন তৈরি পারে, যাতে করে তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের অভিযানের সক্ষমতা কমে যায়। সম্ভবত চীন এ ধরনের ঘটনার জন্য নিজেদের আরও সময় নিয়ে প্রস্তুত করতে চাইবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি পরিবহনে নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরও কঠোর হতে চাইবে।
কিন্তু চীনের সংবেদনশীলতাকে দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, জ্বালানি রপ্তানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নৌ অবরোধের বিষয়টি পরাশক্তির মধ্যকার সম্ভাব্য যুদ্ধের বিবেচনায় চীনের জন্য কম উদ্বেগের বিষয় হতে পারে। বিশ্বের জ্বালানি বাজারে সমস্যা তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের নৌ অবরোধে বেইজিং যদি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের তেলের বড় বাজারটা হারিয়েও ফেলে, তারপরও ওই অঞ্চলে চীনের সামরিক উপস্থিতি লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় লাভজনক হবে না। মধ্যপ্রাচ্যে এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট বছরে ৭০ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০২৩ সালে চীনের সামগ্রিক প্রতিরক্ষা বাজেট ২২৪ বিলিয়ন ডলার। মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংকে যদি ওয়াশিংটনের সমান সামরিক ব্যয় করতে হয়, তাহলে তাদের মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় করতে হবে।
চীনের প্রাথমিক ও সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কৌশলগত হুমকি এখন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। চীনের সামরিক মনোযোগের কেন্দ্র এখন সেটিই।
এ ছাড়া চীন এখন তাদের জ্বালানি নিরাপত্তাঝুঁকি কাটাতে কম মূল্য দিতে হয়, এমন একটা পথ বেছে নিয়েছে। চিরশত্রু ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে শান্তি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছে বেইজিং।
এর মধ্য দিয়ে চীন মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কাঠামোতে নিজেদের প্রধান এক খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। জ্বালানি উৎপাদক দেশগুলো ও চীনের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে যাতে পারস্পরিক নির্ভরতা তৈরি হয়, সেই কাজটাই করছে বেইজিং।
নিঃসন্দেহে এই হাতিয়ারটা সামরিক শক্তি ব্যবহারের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে মার্কেন কৌশলপ্রণেতাদের মধ্য মিশ্র অনুভূতি রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, চীন মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নিরাপত্তা তদারককারী হয়ে উঠছে—এ ব্যাপার নিয়ে ওয়াশিংটন সচেতন আছে। অন্যরা আবার মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বেইজিংকে বিদায় করে দেওয়া প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র কি ভাবছে কিংবা কোনটা তাদের কাছে গ্রহণীয় হয়, সেটা বিবেচনায় না নিয়ে চীন তাদের মতো করেই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করবে। মধ্যপ্রাচ্যে যদি কখনোই বড় পরিসরে চীনের সেনাবাহিনীর মোতায়েন না–ও হয় তারপরও দেশগুলোতে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গণ্য হবে।
ইয়ান সান চায়না প্রোগ্রামের পরিচালক এবং ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের পূর্ব এশিয়া প্রোগ্রামের সহ-পরিচালক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে