আগের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়তো সেই জৌলুশ নেই। কিন্তু এখনো দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তনের প্রধান অকুস্থল এই বিশ্ববিদ্যালয়।
দুঃখজনক বিষয় হলো ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছেন।
২০১৫ সালের শিক্ষকদের প্রতি একটি বৈষম্যমূলক পে-স্কেলের পর আবারও ‘প্রত্যয়’ নামক একটি বৈষম্যমূলক পেনশন–ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে এই কর্মবিরতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দেখিয়েছেন, কীভাবে নতুন পেনশন–ব্যবস্থা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং শিক্ষকদের সুবিধা কমিয়ে দেবে।
এটি শুধু আর্থিক দিক থেকে বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য নয়, এটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও বৈষম্যমূলক।
কারণ, একই স্কেলে একই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন তুলে একেকজন একেক রকম পেনশন পেতে পারেন না। বরং শিক্ষকদের বেতন হওয়া উচিত অন্যদের চেয়ে বেশি এবং আলাদা।
যোগ্যতা চাইবেন বিশ্বমানের আর সুযোগ-সুবিধা দেবেন বিশ্বের সবচেয়ে কম—এটি তো স্রেফ অন্যায্য চাওয়া।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন নতুন পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে?
প্রথম কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা তাঁদের জন্য প্রযোজ্য, যাঁরা বর্তমানে কোনো পেনশন পলিসিতে নেই।
যাঁরা সরকারি পেনশন পেতেন না, তাঁদের জন্যই মূলত চারটি পেনশন স্কিম চালু করা হয়—প্রবাস (প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য); প্রগতি (বেসরকারি কর্মচারী/প্রতিষ্ঠানের জন্য); সুরক্ষা (স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মীদের জন্য) এবং সমতা (স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের জন্য)।
কিন্তু হঠাৎ চলে এল সর্বজনীন ‘প্রত্যয়’। বলা হচ্ছে, সর্বজনীন অথচ তা প্রযোজ্য স্বায়ত্তশাসিত বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর।
সর্বজনীনই যদি হয়, তাহলে বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো যাঁরা সরকারি কোষাগার থেকে বেতন পান, তাঁদের সবার জন্য একযোগে তা প্রযোজ্য হলো না কেন?
যদি এক বছর পর সবার জন্য হয়ও, তাহলে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এক বছর আগে কেন?
সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে এটি চাপিয়ে দেওয়া হলো কেন? এটি কি গিনিপিগ এক্সপেরিমেন্টের মতো হয়ে যায় না!
সূক্ষ্মভাবে ভাবলে, ২০১৫ সালের পে–স্কেল, প্রত্যয় স্কিম—এগুলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার উন্নতির অন্তরায়।
শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে ও শিক্ষকদের সম্মান ধরে রাখতেই এই আন্দোলন। বেতন কম, সামাজিক সুরক্ষা কম ইত্যাদি কারণে মেধাবীদের টানতে পারবে না।
ফলে অর্থের ভিত্তিতে বিভাজিত উচ্চশিক্ষায় আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা উন্নত শিক্ষা পাবে না।
এতে পরে যাঁরা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তাঁরাও তুলনামূলক কম মেধাবীদের মধ্য থেকেই নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
একটা দুষ্টচক্রে পড়ে যাবে জাতি, পুরো শিক্ষাব্যবস্থা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন হবে বড়জোর তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করে সন্তুষ্ট থাকা।
ইতিমধ্যে এই প্রবণতা চালু হয়েছে, যখন দেখি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন শিক্ষার্থী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার, পুলিশের এসআই অথবা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১৩–১৪ গ্রেডের বেতন পেলে খুব খুশি হয়ে যায়।
ঐতিহাসিকভাবেই যেকোনো দেশ এগিয়ে যায় জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। এ কথা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন বলেই ভঙ্গুর অর্থনীতিতেও শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়েছিলেন জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ। এখন সেই বরাদ্দ ২ শতাংশের নিচে।
এত সীমাবদ্ধতার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগোচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবার ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ৬০০–এর মধ্যে এসেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভালো করছে।
এমনকি অত্যন্ত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষা ও গবেষণায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
এখানকার বেশির ভাগ শিক্ষকই নিজ যোগ্যতায় দেশের বাইরে থেকে পিএইচডি করছেন। কোনো ধরনের সরকারি বৃত্তি ছাড়া।
এ ধরনের বৈষম্যমূলক আর্থিক ব্যবস্থা চালু হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে রাষ্ট্রের। সবচেয়ে মেধাবীরা আর শিক্ষকতায় আসবেন না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যদি খারাপ হয়, তাহলে কোনো সেক্টরই ভালো কিছু করতে পারবে না। সেটা হোক আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ বা অন্য কিছু। তাই সরকারের উচিত ‘প্রত্যয়’ স্কিম, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ইত্যাদি নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা। তাঁদের যুক্তিগুলো শোনা এবং বুঝতে চেষ্টা করা।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটিশদের ৭৫০ বছরের উন্নতির পেছনে শিক্ষার অবদান ৫৯ শতাংশ। এই শিক্ষা হচ্ছে মাধ্যমিক–পরবর্তী উচ্চশিক্ষা বা টারশিয়ারি এডুকেশন।
শিল্পবিপ্লব–পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দুই পিরিয়ডের জন্যই এটা প্রযোজ্য। এই শিক্ষা না থাকার কারণেই আফ্রিকার দেশগুলো সম্পদ থাকার পরেও গরিব।
আইভরি কোস্টের খনিজের টাকায় ফ্রান্সের বাজেট হয় অথচ আইভরি কোস্ট অনাহারে থাকে।
জীবনের মৌলিক উপাদান পানি না থাকার পরেও সিঙ্গাপুর ধনী। সিঙ্গাপুরের সাবেক এক অর্থমন্ত্রীকে উন্নতির কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। উত্তরে উনি বললেন, ‘মেরিটোক্রেসি।’
তাই এ ধরনের বৈষম্যমূলক আর্থিক ব্যবস্থা চালু হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে রাষ্ট্রের। সবচেয়ে মেধাবীরা আর শিক্ষকতায় আসবেন না।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যদি খারাপ হয়, তাহলে কোনো সেক্টরই ভালো কিছু করতে পারবে না। সেটা হোক আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ বা অন্য কিছু।
তাই সরকারের উচিত ‘প্রত্যয়’ স্কিম, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ইত্যাদি নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা। তাঁদের যুক্তিগুলো শোনা এবং বুঝতে চেষ্টা করা।
আবদুল আলিম বাসের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি মালায়ায় পিএইচডি গবেষণারত।