এক দশকের বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করছেন, অনেক অর্জনও আছে আপনার। সবকিছু মিলিয়ে এখন কেমন আছেন?
রুমানা মনজুর: খুবই ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। যেকোনো কিছু করতেই অন্যদের চেয়ে আমার একটু বেশি সময় প্রয়োজন হয় জানেন। জীবনের যুদ্ধ তো আর থামেনি। একটা অর্থপূর্ণ জীবন তৈরির চেষ্টা করছি। যাতে আমার সন্তান এবং পরবর্তী প্রজন্ম উৎসাহ পায়। এখন বই প্রকাশনা নিয়ে ব্যস্ত। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হবে।
শারীরিকভাবে আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছি। আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারতাম না, কষ্ট হতো; শরীরের ভারসাম্য রাখতে পারতাম না। এখন তা পারি। ঘরের মধ্যে একা সবই করতে পারি, তবে বাইরে সাহায্য প্রয়োজন হয়।
মানসিকভাবে কেমন আছি যদি জানতে চান, তাহলে বলি, সেই সংগ্রামটা কমেনি। একজন দৃষ্টিহীন মানুষের যেসব প্রতিবন্ধকতা থাকে, সেসব তো আছেই আমার। আমার ৫ বছরের ছোট্ট বাচ্চাটার বয়স এখন ১৮ হলো। আমার সামনেই ও বড় হলো, অথচ মা হয়ে ওর বড় হওয়াটা কেমন, দেখতে পারলাম না।
আপনার জীবনের ঘটনা নিয়ে লেখা বই ‘আউট অব ডার্কনেস: রুমানা মনজুরস জার্নি থ্রু বিট্রেয়াল, টায়রনি অ্যান্ড অ্যাবিউজ’। লেখক ডেনিস চং এ বইয়ের কাজে বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন। বই সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
রুমানা মনজুর: ডেনিসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল মধ্যস্থতাকারী সংস্থার (এজেন্ট) মাধ্যমে। আমি চেয়েছিলাম লেখা হোক। এ বইতে আমি সাবজেক্ট। মূলত আমার ছোটবেলা থেকে শুরু করে আমার পড়ালেখা, বিয়ে, সংসার, সন্তানের জন্ম, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এবং কানাডায় এসে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইউবিসি) ফিরে নতুন করে আইন নিয়ে পড়ালেখা শুরুর সব কথা তুলে ধরা হয়েছে বইতে। আমার মা-বাবার কথাও আছে এতে।
বইয়ের জন্য ডেনিস বাংলাদেশে গিয়েছিলেন কোভিড শুরু হওয়ার আগে আগে। মূল বইয়ের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে। তখন বাংলাদেশে যাঁদের পেয়েছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে কথা বলেছেন ডেনিস। ফলে বইটির জন্য অনেক সময় দিতে হয়েছে লেখককে। এ বছর প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এটি ৩৩০ পৃষ্ঠার বই।
বইয়ে আমার জীবনের ঘটনার পাশাপাশি রয়েছে মানুষ হিসেবে আমাদের কেমন হওয়া উচিত, আমাদের কর্তব্য কী—এসব প্রসঙ্গ। ইউবিসিতে প্রকাশের পর কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, ক্যালগিরি ও টরন্টোতে আলাদা আলাদা করে প্রকাশনা উৎসব হবে। অটোয়াতে প্রি-পাবলিকেশন হয়েছে।
■ অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে, কিন্তু থেমে না যাওয়াই হচ্ছে প্রাণশক্তি। মনে হয়েছে, মানুষের প্রাণশক্তিকে (হিউম্যান স্পিরিট) কোনো খারাপ শক্তি কখনো হারাতে পারে না।
■ অর্থপূর্ণ জীবন মানে নিজের পদচিহ্ন রেখে যাওয়া। এমন কোনো ভালো কাজ করে যাওয়া, যাতে শুধু সমকালীন নয়, পরের প্রজন্মও সেখান থেকে শিখতে পারে।
■ গৃহস্থালি সহিংসতার ঘটনায় নারীদের সচেতন থাকা খুব জরুরি। এটা শুধু নিজের জন্য নয়, সন্তানের জন্যও প্রয়োজন। পরিবারের মানুষের এ ব্যাপারে সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।
বইটি নিয়ে পেঙ্গুইন প্রকাশনী একটি ছোট্ট ভূমিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে লেখা ‘টেস্টামেন্ট টু দ্য হিউম্যান স্পিরিট’ কথাটি দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে? বইটি বাংলাদেশে পাওয়া যাবে?
রুমানা মনজুর: বাংলাদেশে পেতে হয়তো আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন হবে। প্রকাশনীর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যোগাযোগ করার ব্যাপার আছে। এখানে বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ভূমিকার দরকার হবে। বাংলাদেশে বইটির অনুবাদ হতে পারে মানে অনুবাদের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি।
দেখুন, দৃষ্টি হারানোর পর সব সময় মনে হয়েছে, মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে আমার জীবন সম্পূর্ণ অন্য রকম হয়ে গেল। সবকিছু দেখতে পারতাম, কিন্তু এক মুহূর্তের ঘটনা আমার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছে। তবু আমি থেমে যাইনি।
অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে, কিন্তু এই থেমে না যাওয়াই হচ্ছে প্রাণশক্তি। মনে হয়েছে, মানুষের প্রাণশক্তিকে (হিউম্যান স্পিরিট) কোনো খারাপ শক্তি কখনো হারাতে পারে না।
আমি আবার নতুন করে শুরু করেছি। এমনকি নিজের পড়ার বিষয় বদলে নিয়েছি। নিজেকে আরও বেশি অর্থপূর্ণ করতে চেয়েছি। এটাই প্রাণশক্তির কথা, যেটা ওখানে বলা হয়েছে।
অর্থপূর্ণ জীবন বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
রুমানা মনজুর: অর্থপূর্ণ জীবন মানে নিজের পদচিহ্ন রেখে যাওয়া। এমন কোনো ভালো কাজ করে যাওয়া, যাতে শুধু সমকালীন নয়, পরের প্রজন্মও সেখান থেকে শিখতে পারে। তাদের জন্য কাজ করে যাওয়াই অর্থপূর্ণ জীবন। এ জন্য আমি আমার পেশা পর্যন্ত বদলে ফেলেছি। এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজের দৃষ্টি হারানোর পর।
দুর্ঘটনার আগে আমি ইউবিসিতে পড়তে এসেছিলাম এনভায়রনমেন্টাল সিকিউরিটি নিয়ে। পিএইচডির আগে মাস্টার্সের কোর্স শেষ করতে হয় এই বৃত্তির আওতায়। আমি সেটাই পড়ে বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ঘটনার পর যখন আবার কানাডায় ফিরলাম, তখন বিষয় বদলে পড়া শুরু করলাম আইন নিয়ে। এরপর জুরিস ডক্টর হলাম।
এখন কানাডার ফেডারেল গভর্নমেন্টের একজন আইনজীবী আমি। মানুষের আইনের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। শুধু নারীর প্রতি সহিংসতা নয়, আমার কাজ সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে।
আমার জীবনে যেমন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, বাংলাদেশে লাখ লাখ নারীর সেই সমস্যায় আছেন। তাঁরা সেটা সহ্য করে যাচ্ছেন। বইটি মূলত জীবনসঙ্গীর সহিংসতা (ইন্টিমেট পার্টনারের ভায়োলেন্স) নিয়ে টেক্সট বুক বলতে পারেন। বই পড়ে একজন নারীও যদি নতুন করে ভাবতে শেখেন, তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক হন, তাহলেই মনে হবে বইটি সার্থক।
দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার জন্য স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অথবা পড়ালেখা করতে যে প্রতিবন্ধকতা হয়, সেগুলো কীভাবে অতিক্রম করেন?
রুমানা মনজুর: স্বাভাবিকভাবেই আমি আর সরাসরি বই পড়তে পারি না। পড়তে হয় কম্পিউটারে। জব এক্সেস উইথ স্পিরিট নামে একটি সফটওয়্যার আছে। এটি মূলত স্ক্রিন রিডিংয়ের কাজ করে। আরেকটি আছে অ্যালেক্সা। এটাও আমাকে সাহায্য করে, তবে এখন অ্যালেক্সা কম ব্যবহার করা হয়। চলাফেরার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা আছে। এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কারও সহযোগিতা ছাড়া উঠতে পারি না।
কানাডায় হ্যান্ডি ডার্ট নামে একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আছে। ওরা ডোর টু ডোর সেবা দেয়। ঘরের দরজা থেকেই এই ট্রান্সপোর্ট সেবা কর্মক্ষেত্রে পৌঁছে দেয়, আবার কাজ শেষে বাড়ি পৌঁছে দেয়। আগে থেকে বুক করে রাখতে হয়। অনেক দিন ধরে এটা ব্যবহার করি। তবে বাসার ভেতর আমি অনেকটা স্বচ্ছন্দ। নিজের কাজের অনেক কিছু এখন একা একা করতে শিখেছি।
আপনার মা-বাবা কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে থাকেন। মেয়ে আপনার সঙ্গে থাকে। সবাই নিশ্চয়ই সহযোগিতা করে? বাংলাদেশে আসতে চান?
রুমানা মনজুর: মা-বাবা আমার সঙ্গেই এখানে চলে এসেছিলেন। প্রথমে আমরা একসঙ্গেই ছিলাম। এখনো কাছাকাছি থাকি। মাত্র সাত মিনিটের ড্রাইভের দূরত্ব আমার বাসা থেকে তাঁদের বাসা। নিয়মিত দেখা হয়। যখন আসি, তখন মেয়েটা খুব ছোট ছিল। তখন থেকেই মায়ের সব কাজে সহযোগিতা করে আসছে। ও আসলে সহযোগিতা করতে বাধ্যও হয়েছে।
মেয়েই আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। ওর জন্য লড়াইটা করে যেতে পারছি। ২০১১ সালে এখানে আসার পর থেকে নানা রকম পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়েছে। এত সংগ্রামের মধ্যে আমার বাংলাদেশে যাওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। এখন মেয়ে বড় হয়েছে। এই জানুয়ারিতে ওর ১৮ হলো। হয়তো সামনে কখনো আসব বাংলাদেশে।
সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য কিছু বলবেন?
রুমানা মনজুর: বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য সংসার ভেঙে বেরিয়ে আসা অনেক কঠিন। ছোটবেলা থেকেই তাঁদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়, ‘তুমি মরে যাও, কিন্তু সংসার ঠিক রাখো।’ তাঁরা দাঁতে দাঁত চেপে মানিয়ে নেন। সহিংসতা সয়ে যান।
বিচ্ছেদের কথা বলতে গেলে কী হয়, আমি তাঁর বড় উদাহরণ। আমার সংসারেও কিন্তু অনেক রেড সিগন্যাল ছিল। কিন্তু ওই যে আমিও মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে গিয়েছি।
বাধ্য হয়ে যখন বিচ্ছেদের কথা বললাম, তখন আমার পরিণতি কী হলো সেটা তো সারা দেশের মানুষ জানে। সারা জীবনের জন্য দৃষ্টি হারালাম। কিন্তু আমি বলব, মেয়েরা খুব শক্তিশালী। গৃহস্থালি সহিংসতার ঘটনায় তাঁদের সচেতন থাকা খুব জরুরি। এটা শুধু নিজের জন্য নয়, তাঁর সন্তানের জন্যও প্রয়োজন। পরিবারের মানুষের এ ব্যাপারে সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ। মোদ্দা কথায়, নারীকে তাঁর নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি বুঝতে হবে। এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন নারীর পক্ষে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। তাঁদের অনেকের উপার্জন থাকে না, সমাজও সমর্থন করে না। সেই নারীরা কী করবেন?
রুমানা মনজুর: বাংলাদেশের নারীরা অনেক সক্ষম, বুঝতে হবে নিজের শক্তিটা কোথায়। বাংলাদেশের নারীরা অনেক শক্তিশালী। একজন মা, যিনি নিজের সন্তানের জন্য কী করে ফেলতে পারেন কল্পনাও করা যায় না। তিনি সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। আর প্রান্তিক জনপদের নারীরও সক্ষমতা আছে। দেখবেন, তিনি কিছু না কিছু কাজ জানেন। সবার সক্ষমতা এক রকম থাকবে না।
আমি যদি দৃষ্টি হারিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারি, তাহলে যেকোনো নারী পারবেন বলে বিশ্বাস করি। হয়তো তিনি ভালো সেলাইয়ের কাজ জানেন অথবা অন্য কোনো হাতের কাজ ভালো পারেন। ফলে একজন মেয়ে তাঁর মানসিক শক্তি থাকলে স্বাবলম্বী হতে পারবেন না, এমনটা আমি বিশ্বাস করি না।
নারীর জন্য যদি তাঁর গৃহে সহিংসতার আশঙ্কা থাকে, তাহলে তাঁকে সেটার সমাধান নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। সহ্য করে করে শেষ হয়ে যাওয়া কখনো সমাধান নয়। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের প্রাণশক্তিই তাকে বিজয়ী করে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রুমানা মনজুর: বাংলাদেশের মানুষ আমাকে এখনো মনে রেখেছে, এটাও আমার জন্য অনেক পাওয়া। সবাইকে বলব আমার জন্য দোয়া করতে। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।