অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সরকার একটি ‘মহা ইঞ্জিন’। এর সব কটি অংশ একসঙ্গে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।
আমার শিক্ষক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আখলাকুর রহমান সরকার পরিচালনা করাকে আকাশে বিমান পরিচালনার সঙ্গে তুলনা করতেন। তিনি বলতেন, বিমান চালাতে হলে কেবল বিমানের ইঞ্জিনকে নিয়ন্ত্রণ করলেই চলবে না, এর বাইরের পরিপার্শ্বিক অবস্থা যথা আবহাওয়া, দৃশ্যমানতা (ভিজিবিলিটি) ইত্যাদি বিষয়ে সূক্ষ্ম নজর রাখতে হবে।
বাস্তবে সরকার পরিচালনা করা বিমান পরিচালনা করার চেয়ে অনেক কঠিন কাজ। কারণ, সরকারকে কাজ করতে হয় মানুষ নিয়ে, সমাজ নিয়ে; এগুলোকে নিয়মের মধ্যে রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করা যন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
ঐতিহাসিক গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জনগণের ব্যাপক আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে; কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপদেষ্টার বলতে সোনা যায়, সরকারি যন্ত্রের কোন কোন অংশ ভালোভাবে কাজ করছে না। তারা কখনো কখনো উষ্মা প্রকাশ করছেন এবং হতাশাও ব্যক্ত করছেন।
উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশের পাশাপাশি জনপ্রশাসন ব্যবস্থার ধ্যান–ধারণা ও চিন্তা-চেতনায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাপ্তির পাশাপাশি রাষ্ট্রের কেন্দ্রে চলে আসে জনগণ ও সমাজ।
জনপ্রশাসনের একটি অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনা এবং জনপ্রশাসনকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা।
প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে পুরোনো কর্তৃত্ববাদী আচার-আচরণের পরিবর্তে মানবিক সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়, যাতে প্রশাসনের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ টিম স্পিরিট নিয়ে একত্রে কাজ করে।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে, জনপ্রশাসনে ‘টিম বিল্ডিং’ আধুনিক জনপ্রশাসনের একটি অন্যতম প্রধান কাজ। প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে প্রশাসনের দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ বাড়ানোর জন্য আমরা মানবিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও টিম বিল্ডিংয়ের কাজটি যথাযথভাবে করতে পারছি কি না? টিমকে যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে পারছি কিনা?
১২ নভেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তথ্যের অবাধ প্রবাহের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি গুজব ও অপতথ্য প্রচারের প্রতিরোধে গণমাধ্যমের অগ্রণী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। এ ধরনের মতবিনিময় সভা অংশীজনদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি ও তথ্যপ্রবাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসার দাবি রাখে। আশা করি এ ধরনের মতবিনিময় সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হবে।
এই মতবিনিময় সভার সংবাদটি এবং সভার ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিতে দেখা যায়, উপদেষ্টা এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব দুটি বড় চেয়ারে বসেছেন। অন্যদিকে সভায় অংশগ্রহণকারী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং সম্পাদকেরা সাধারণ ছোট চেয়ারে বসেছেন। এ ধরনের আসনব্যবস্থা কেবল তথ্য মন্ত্রণালয়ে নয়, দেশের অন্য সব মন্ত্রণালয়, সরকারি, আধা সরকারি অফিস এমনকি জেলা, উপজেলা পর্যায়ের সভাগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আসনব্যবস্থা বাংলাদেশে একটি সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে, যা কেবল সরকারি অফিসে সীমিত নয়, রাজনৈতিক দল এমনকি বেসরকারি সংস্থায়ও বিস্তার লাভ করেছে।
অনেকে বলতে পারেন, সভায় কে কোথায় এবং কোন ধরনের চেয়ারে বসল তা একটি তুচ্ছ বিষয়, এ নিয়ে আলোচনা করার কী আছে; কিন্তু আসলে বিষয়টি এত তুচ্ছ নয়। কারণ, রাষ্ট্রীয় পদ ও ক্ষমতার স্তর বিন্যাসের পার্থক্য বোঝানোর জন্য আসনব্যবস্থার এই তারতম্য করা হয়। এটি ব্রিটিশদের প্রবর্তিত একটি ঔপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
ঔপনিবেশিক সময়ে, ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিরা স্থানীয় কর্মকর্তাদের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে চেয়ারকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতেন। কাজেই এটি কেবল বসার আসন নয়; ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক এবং ক্ষমতার স্তর বিন্যাসের পরিচায়ক। এর মাধ্যমে আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সভায় কার কী ভূমিকা, কে কী বলতে পারবেন এবং কার কথার মূল্য কতটুকু থাকবে। এ ধরনের অপসংস্কৃতির মধ্য দিয়ে ক্রমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কর্তৃত্ববোধের জন্ম নেয়।
আসলে সভার চেয়ারের তারতম্য সমাজের অন্তর্নিহিত বৈষম্যেরই একটি প্রতীক। যদিও ব্রিটিশরা তাদের দেশে পুরোনো বৈষম্যমূলক আসনব্যবস্থা পরিহার করেছে অনেক আগেই; কিন্তু বাংলাদেশ এখনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি বহন করে চলছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা ব্যাপক। এই আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে জনপ্রশাসনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করতে হবে। প্রথমেই জনপ্রশাসনকে আরও কার্যকর ও জনমুখী করতে হবে। পুরোনো আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে এবং সরকারের সব অঙ্গকে আরও সক্রিয় করে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনব্যবস্থা; যাতে রাষ্ট্রের সব অংশীজনকে সরকারের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও স্বপ্নের সঙ্গী করা যায়।
সভায় অর্থপূর্ণ আলোচনা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্যমূলক আসনব্যবস্থা একটি বড় প্রতিবন্ধক। কারণ, এর ফলে সভায় অংশগ্রহণকারী অনেকেই মন খুলে কথা বলেন না, বা বলতে সাহস করেন না। আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ‘বিশিষ্ট’ আসনে বসা ক্ষমতাশীল কর্তাব্যক্তি। যার ফলে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় একপেশে এবং অনেক সময় অনুপযোগী ও জনস্বার্থের পরিপন্থী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করা, সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির বিপরীতে একটি নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ধারার প্রবর্তন করা । জুলাই গণ–অভ্যুত্থনের চিন্তা-চেতনা ও প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে স্বভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে এখনো সরকারি সভায় এই বৈষম্য কেন?
এগুলো কেবল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্পৃহার পরিপন্থী নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসনেরও পরিপন্থী। এটা ঔপনিবেশিক মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে এবং একই সঙ্গে বৈষম্যের সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করে তোলে। আসনের ক্ষেত্রে বৈষম্য যদি করতে হয়, তবে তা হওয়া উচিত প্রয়োজনের তাগিদে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের শারীরিক প্রয়োজনে; ক্ষমতায় কে কোন পদে আছেন তার ভিত্তিতে নয়।
বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘদিন কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীন ছিলাম। যেখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হতো কেন্দ্রীয়ভাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল কতিপয় ব্যক্তির হাতে। সাধারণ মানুষের বা অংশীজনদের রাষ্ট্রীয় কাজে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না বললেই চলে।
যেকোনো গণ–অভ্যুত্থান বা বিপ্লব মানুষের চিন্তাচেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এই গণ–অভ্যুত্থানও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষ এখন নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি সচেতন। প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে আগের মতো কর্তৃত্ববাদী প্রশাসন এখন হয়তো আর আগের মতো কাজ করবে না। এখন সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জনপ্রশাসন চালাতে হবে। সরকারি সভায় আসনব্যবস্থার এ ধরনের ভেদাভেদ অংশীজনদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন সৃষ্টি করে যা সরকারি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যর সঙ্গে অংশীজনদের সম্পৃক্ত করতে একটি বড় অন্তরায়।
বৈষম্যবিরোধিতা একটি বিমূর্ত ধারণা। এটিকে বাস্তবে কার্যকর রূপ দিতে হলে আমাদের চিন্তাচেতনা এবং ব্যক্তিগত আচার-আচরণ থেকে শুরু করতে হবে। চিন্তাচেতনায় সংস্কার না হলে সংবিধান সংস্কার করেও আশানুরূপ ফল লাভ না–ও হতে পারে। কারণ, একনায়কত্ব সংবধিানে জন্ম নেয় না, জন্ম নেয় আমাদের চিন্তায় ও চেতনায়।
এ দেশে এখন সামন্তব্যবস্থা না থাকলেও আমাদের প্রত্যেকের মনের ভেতরে একটি ‘সামন্তপ্রভু’ বসে আছে। সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই বিখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিক লিও তলস্টয় তার বি থিংক ইউরসেলফ গ্রন্থে বলেছেন, প্রত্যেকেই বিশ্বকে পরিবর্তন করতে চায়; কিন্তু কেউই নিজেকে পরিবর্তনের চিন্তা করে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা ব্যাপক। এই আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে জনপ্রশাসনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করতে হবে। প্রথমেই জনপ্রশাসনকে আরও কার্যকর ও জনমুখী করতে হবে। পুরোনো আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে এবং সরকারের সব অঙ্গকে আরও সক্রিয় করে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনব্যবস্থা; যাতে রাষ্ট্রের সব অংশীজনকে সরকারের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও স্বপ্নের সঙ্গী করা যায়।
প্রশাসনিক পরিবর্তন ও সংস্কারের একটি প্রাথমিক ধাপ হতে পারে সব সরকারি ও আধা সরকারি সভায় বৈষম্যমূলক আসনব্যবস্থার অবসান ঘটানো। সভাগুলো আরও অংশগ্রহণমূলক ও প্রাণবন্ত করা, যাতে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়ায় সভায় অংশগ্রহণকারী সবাই নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা ও সক্ষমতা দিয়ে অবদান রাখতে পারে।
এই ছোট্ট পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিরাট মহাযজ্ঞের যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর হবে এবং বাংলাদেশ একটি উদার কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যেখানে সবাই সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে সমাজে বাঁচতে পারবেন।
গোলাম রসুল অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা