বাধা ডিঙিয়ে হয় না পাখা মেলা
জন্ম থেকেই জোটে না কানাকড়ি সময়ও
তবু প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।
আপসে মেনে নেওয়া যেন নিয়তি তোমার।
যতক্ষণ ওই নিষ্ঠুর চাপানো নিয়তির তীব্র যন্ত্রণা কুরে কুরে না খায়
যতক্ষণ না তা অসহনীয় হয়ে ওঠে
ততক্ষণ যেন তা তোমার গায়ে সয়ে রয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
[জন লেনন (১৯৪০-১৯৮০)–এর ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’ গানের ভাবালম্বনে]
১
সমাজে শ্রম কিংবা শ্রমিকের জীবনের মূল্য কত? তার পরিমাপ বা চিত্রায়ণ হয় কীরূপে? সেই ভাবনায় জন লেননের কালজয়ী গান ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’–এর কথা মনে পড়ে। গানে গানে যুক্তরাজ্যের কবি–চিত্রশিল্পী–লেখক-গায়ক-সংগঠক জন লেনন শ্রমিকের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই…প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।’ মনে পড়ে রোকেয়া সাখাওয়াতের লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধের লাইন, ‘শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া লওয়া হয়।’ রোকেয়া সাখাওয়াত যদিও নারীদের অবস্থা নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, কিন্তু এ কথা সব নারী–পুরুষ শ্রমিকের বেলায় সমান প্রযোজ্য। এমনই সেকাল-একালে সময় যত গড়ায়, নতুন এ জমানার নারী ও পুরুষ শ্রমিক যেন আধুনিক দাসের লেবাসে পর্দায় পা রাখেন। এ বিষয়ে সমাজের ওপরতলা থেকে খোদ শ্রমজীবীদের বাহাস-লড়াই ইতিহাসে কালে কালে চলমান থাকে। কখনো কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক দিনে, আন্দোলনমুখর মুহূর্তে কিংবা কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে এ আলাপ ওঠে তুঙ্গে। ‘জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান’ আমাদের সেই রকম ক্ষণে হাজির করেছে। তাই এ যাত্রায় লড়াইয়ের ময়দানে, পুলিশের লাঠি-বারুদ-কাঁদানে গ্যাসের শেল কিংবা বন্দুকের নলের মুখে, মন্ত্রণালয়ের টেবিলে, জুলাই–পরবর্তী নানা সংস্কার কমিশনে অথবা দেশি–বিদেশি সরকার-মালিকদের নির্দেশনামা-পরিকল্পনা-রোডম্যাপে কিংবা সুধী সমাজের গবেষণা-সভা-সেমিনারে জাতীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির আলাপে শ্রমিক কল্যাণ প্রশ্নের ঠাঁই জুটেছে।
এটাকে কেউ কেউ ইতিহাসের দায় মেটানোর ও পাকাপোক্ত জবাবদিহির কাঠামো তৈরির সুযোগ বলেও চিহ্নিত করতে পারেন। একই সঙ্গে চিহ্নিত করতে পারেন চব্বিশ গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থী-শ্রমজীবী, নারী-শিশুর জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এক সুবর্ণরেখায়। সন্দেহ নেই, এই রেখা বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বিশেষ মুহূর্ত। এই মুহূর্তের দায় খুব তাড়াহুড়োয় বা রাতারাতি পূরণ সম্ভব নয়, তা–ও জানি। কিন্তু দিন শেষে এই দায় অপূরণীয় থাকলে আর যেই ছাড়ুক, ইতিহাস পিছু ছাড়বে না।
২
সমাজে শ্রমজীবীর আসল পরিচয় কী? তাঁর পাওয়া না–পাওয়া বা অধিকারই–বা কী? জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের সংযোগ কী? সমাজের বাস্তব পাটাতনে এই হিসাব-নিকাশ বাদ দেওয়ার পথ নেই। নতুন করে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এখন আবশ্যক। কারণ, শ্রমিকের মৌলিক অধিকার কী অবস্থায় আছে, সেই আলাপ ছাড়া দেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও উন্নতির অগ্রগতির পরিমাপ সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ সশরীর বিদায় হলেই শ্রমিক ও জনগণের জীবনমানে উন্নতি হয় না। মন ও মননে গেড়ে বসত করা ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির সমূলে বদল হলে তবেই শ্রমিকের নাগরিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভয়মুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়। সুগম হয় জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ। তাই সমাজে বিরাজমান শ্রেণি-জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্যের আলোকে এই চাওয়া-পাওয়ার সীমাকে পাঠ করতে হবে। বিশেষভাবে এ ক্ষেত্রে যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক, নারী শ্রমিকের ওপর চাপানো ঘর-গেরস্তালি ও কর্মস্থলের দ্বৈত বোঝা এবং শ্রম খাত ও শ্রমিকের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রশ্নও।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলনে জান, জীবিকা ও জবানের অধিকার, নারী-পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গের সম–অধিকার এবং নাগরিক মর্যাদা প্রথম চাওয়া। পাশাপাশি দরকার ক্ষতিপূরণ ও মজুরির মর্যাদাপূর্ণ মানদণ্ড নির্ধারণসহ ন্যায়সংগত অধিকারের বাস্তবায়ন, যা পূরণে দেশে একটি অভিন্ন গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, মর্যাদাপূর্ণ খাতভিত্তিক ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরির মতো সব অধিকারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তেমনি আবশ্যক মতপ্রকাশ, সংগঠন ও প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ইউনিয়নের চর্চা বন্ধে আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন চলমান রাখা।
একই সঙ্গে শ্রমিক ও শ্রম খাত–সম্পর্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ [শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, শ্রম শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়াতন আইআরআই, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ ইত্যাকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) সর্বত্র জবাবদিহি, গণতান্ত্রিক চর্চা, স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকেও প্রতিষ্ঠিত করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার সময় এটা। এসব বাস্তবায়নের খাতিরে যথাযথ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা-উদ্যোগ ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই।
মাঠের লড়াই, আইনি লড়াই ও সাংস্কৃতিক লড়াই—এই তিন ময়দানেই সমসক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন আবারও শ্রমিক ও জনগণের হাতছাড়া হবে। তাই শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় নির্ধারণ এবং অধিকার বাস্তবায়নের রাজনীতি নতুন মাত্রায় সক্রিয়-সজ্জিত রাখা এখন সময়ের আকাঙ্ক্ষা। দিন শেষে শ্রমিকের জীবন কেমন হবে, সেটি কেবল শ্রমিকপক্ষ কিংবা উদ্যোক্তারা বিচ্ছিন্নভাবে নির্ধারণ করেন না। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। ফলে একে রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে বিচার করার পথ নেই।
শ্রমিকের জীবনমান ও শ্রম খাতের বিকাশের সঙ্গে পুরো দেশের নাগরিকের জীবন, গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। তাই এ খাতের উন্নয়ন বাস্তবায়নে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও মনোনিবেশ করা শ্রমিক আন্দোলনের এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক কর্তব্য। বাংলাদেশের আর যেকোনো সময়ের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়কে গুলিয়ে ফেললে ইতিহাসে সেই ভুলের মাশুল টেনে বেড়াতে হবে।
বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তি প্রায় সাড়ে সাত কোটি। মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তারা। তরুণ নারী-পুরুষ মিলে ভোটের হিসাবেও এটি কোনো অংশে ছোট নয়। অথচ এর প্রায় ৮৫ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। যাঁদের কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। তাঁদের জীবনে মঙ্গল প্রদীপের ছোঁয়া লাগাতে এবং শ্রম ও শিল্প খাতকে শক্তিশালী করতে কী কী প্রয়োজন? সেই আলাপ অন্যান্য আলাপের সঙ্গে এখন সামনের সারিতে। অন্তর্বর্তী সরকারই কেবল নয়, শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের এবং প্রবীণ-নবীন দুই প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের কাছেও বিশেষ ভূমিকা জাতি আকাঙ্ক্ষা করে এই সময়ে।
এই ভূমিকার সীমা কানাগলিতে আটকে থাকার নয়। এই প্রশ্নে সরব হওয়া কর্তব্য দেশপ্রেমিক-জনস্বার্থের পক্ষে থাকা ছাত্র-শিক্ষক, নারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, আইনজীবী, গবেষক, লেখকসহ নানা পেশার সংগঠক–সংগঠনের সচেতন নাগরিকের। যাতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত হয়।
কোনো রাষ্ট্রে জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা, ভোটাধিকার, জবাবদিহি দিন দিন নাই হতে থাকলে সমাজ কী চেহারা নেয়, তা সবার জানা। স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছায়, ক্ষমতা হয়ে উঠে ব্যক্তির গোষ্ঠীর লুটপাটের হাতিয়ার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসে। ক্রমে ফ্যাসিবাদ শিকড়ে–বাকড়ে ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জমিনে–আসমানে।
৩
শ্রমিকের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে শ্রম আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন সংশোধন ও সংস্কার উদ্যোগের মধ্যেও এর গুরুত্ব টের পাওয়া যায়। এটি সমাজের আয়না বা দর্পণের মতো। বিশেষত, সমাজের ওপরতলার জন, ক্ষমতাশালী দল ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রম আইনের চলাচল। আইন কখনো হতে পারে রক্ষাকবচ, কখনোবা মারণাস্ত্র। যদিও ৮৫ ভাগ শ্রমিক এর আওতার বাইরে, তারপরও গণ–অভ্যুত্থানে পাওয়া নতুন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আইনে পরিবর্তন ও সংস্কার নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। কেননা, ভবিষ্যতে সব শ্রমিকের স্বীকৃতি, তাঁদের কপালের লিখন এবং এই খাতের বিকাশে শ্রমিকের হিস্যা কতটুকু, কতটুকু জবান ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থাকবে—এসবের পূর্বাভাস মিলবে আইনে। অনুগ্রহ বা দয়াদাক্ষিণ্যে নয়, আইনে নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি জন্মায়। তাই বর্তমান আইনের সংস্কার ও পরিবর্তন এমন হওয়া দরকার, যাতে তার ফলাফল শতভাগ শ্রমশক্তি ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারে। দরকার বাস্তবায়নের জন্য লড়াই। সংবিধান, শ্রম আইনবিধি, ফৌজদারি আইন, পারিবারিক আইন, নারী নীতি, নারীবিষয়ক প্রস্তাবনা যাতে পারস্পরিক সংঘাতপূর্ণ, দ্বন্দ্বের বা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী-অগণতান্ত্রিক না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ যাতে ঘটে শ্রম আইনে, তার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে সবাইকে।
সংসদ আইন প্রণীত হওয়ার স্থান। বিগত সময়ে মালিক বা উদ্যোক্তারা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে গিয়েছেন, আইন তৈরি করেছেন। সেখানে মালিকপক্ষের স্বার্থই প্রধানত রক্ষিত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রবলভাবে তৈরি করেছেন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ। আইন প্রায়ই ব্যবহৃত হয়েছে নিপীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অস্ত্র আকারে। সংবিধানে সংগঠন ও মত প্রকাশ করা জনগণের মৌলিক অধিকার বলা হলেও সংগঠন করাতেই এসেছে সরকার-মালিকের সম্মিলিত কায়দায় যত বাধা। সংবিধানে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের পক্ষের সংগঠনগুলো। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমশক্তি ব্যবস্থাপনার নামে এমন বাধা–নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যাতে নিয়মনীতির মধ্যে ইউনিয়ন করা কঠিনতর হয়।
‘সিংহকে বশে’ রাখার চিন্তার প্রভাব যেন খুঁজে পাওয়া যায় ইউনিয়ন করার আইনি বিধিবিধানে। রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে শতকরা হার আরোপসহ নানা যে শর্ত, তা পূরণ প্রায়ই অসম্ভব। কারণ, এসব পাহাড়সম শর্ত আদতে নিষেধের সমান। প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়নের অন্যতম বাধা এসব শর্ত। অর্থাৎ স্পষ্ট ও সহজ বিধির বদলে পরোক্ষভাবে এমন বিধান আইনে যুক্ত আছে, যাতে শ্রমিক স্বার্থে প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হতে না পারে। মালিকপক্ষের যত ভীতি এই ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন সংগঠন ও সংগঠকদের নিয়ে।
বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমন রেজিস্টার্ড ইউনিয়ন-ফেডারেশন যার বেশির ভাগ মালিক-সরকারের ‘বশে’ থাকা বা বিদেশিদের সুনজরে থাকা। এ রকম ‘বশে’ থাকা ইউনিয়ন শ্রমিক কল্যাণের প্রকৃত আধার হওয়ার চরিত্র হারাতে বাধ্য। এ ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের খুব সামান্য কিছু সংগঠনকে দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে রেজিস্ট্রেশন পেলেও তা কাগজে–কলমে আছে। বাস্তবে ততটা চর্চার সুযোগ থাকে না। রেজিস্ট্রেশন করলে, সংঘগুলোর সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃত হলে, সবার তাতে স্বীকৃতি ও আইনি অধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় শ্রমিকের স্বার্থের পক্ষের সংঘগুলো ক্রমেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে এই প্রক্রিয়ায়। প্রকৃত ইউনিয়ন তৈরির সব পথই যেন রুদ্ধ, অনিয়ম-দুর্নীতি যখন নিয়ম, তখন মাঠের আন্দোলনই সংগঠিত ও দাবি আদায়ের অন্যতম পথ হয়।
শ্রম আইনের সঙ্গে আদালতেও রয়েছে জটলা। শ্রম আদালতের শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত সর্বত্র নেই বাংলা ভাষার প্রচলন। শ্রম আইন তৈরি হয়েছে এমন বাংলা ভাষার গঠনে, যা সাধারণ শ্রমিক তো দূরে থাক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্যও নাকানিচুবানির দশা। দ্রুত নিষ্পত্তি নেই মামলার, নেই পর্যাপ্ত আদালত। শ্রমিক কখনো শ্রম আইনে ছাঁটাই-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কখনোবা ফৌজদারি মামলায় জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। এত কিছুর পরও আইনকে ধরাছোঁয়ার বাইরে কিংবা মধ্যপন্থা বা সরল দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। আইন নিয়ে সরব থাকার সময় এটা। তবে সরবে পঞ্চমুখ হয়ে উচিত কথা বললেই সব সমস্যার সমাধান হবে বা রাত পোহালে সব বাস্তবায়ন হবে, তা–ও নয়। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়েও আমার-আপনার শ্রমিক প্রশ্নে নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া এবং তার ঘোষণা নিতে দোটানা থাকলে, সেটার হিসাবও ইতিহাস করবে। তরুণ প্রজন্ম, আগামী প্রজন্ম করবে। তাই রব তুলতেই হবে এই সময়ে। একসময়ে তার প্রতিধ্বনি হবেই।
এযাবৎ বিদ্যমান মজুরি, শ্রমঘণ্টা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার—কোনোকিছুই শ্রমিকের আকাঙ্ক্ষার স্মারক নয়। কর্মপরিবেশ, নারী-পুরুষের সমান অবস্থান, দক্ষতা—সব ক্ষেত্রেই অধিকার দিন দিন যেন সংকুচিত হচ্ছে। নারীরা শ্রমশক্তির বড় অংশ হলেও নাগরিক মর্যাদা তো দূরে থাক, দক্ষ শ্রমিক হওয়ার সুযোগটুকু পাচ্ছেন না। মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি, ডে–কেয়ার, যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা, অভিযোগ নিষ্পত্তিসহ নানা দাবি করে আসছেন তাঁরা। আইন আর ন্যায্যতার ফারাক টেনে শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছেন। সর্বোপরি দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতিতে বেহাল আছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা। তাই বর্তমান কাঠামোয় লড়াই করে ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তিতে শ্রমিকদের পাওনাগুলো আদায়ে মতাদর্শিক ও মাঠের লড়াই জীবন্ত থাকা দরকার।
লুটেরা ও নয়া উদারনীতি অর্থনীতির প্রাধান্য ও জাতীয় অর্থনীতির যথাযথ বিকাশ না হওয়ায় আমাদের দেশে আর দশটা গণতান্ত্রিক দেশের মতো শ্রমিকদের অবস্থান ও অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। সুরক্ষিত হয়নি শিল্প খাত। সুরক্ষার বদলে একধরনে নীতিবিরুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চার সুযোগ সরকার ও মালিকপক্ষ এযাবৎকাল জারি রেখেছে। দিন শেষে সেই চর্চা এই খাতের ক্ষয়ই ডেকে এনেছে। দাঁড় করিয়েছে এক বুমেরাং সিন্ডিকেট চক্র, যা দুষ্টচক্রের মতো এই খাতকে বারবার আঘাতে হেনেছে। বঞ্চিত করেছে শ্রমিককে।
শ্রমিকের অধিকার অনিশ্চিত রেখে উৎপাদশীলতা ও শ্রম খাতের বিকাশ সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি মালিকশ্রেণিরও আসতে হবে। হয়তো এর জন্য শ্রমিক ও অর্থনীতির গতিপথকে আরও বিকশিত ও রক্তাক্ত হতে হবে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক-ভূরাজনৈতিক অবস্থার এবং শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দক্ষতা তৈরির কারণে বাংলাদেশে সামনে রপ্তানিভিত্তিক খাতে অমিত সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। সেই সম্ভাবনা অর্জনে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাসহ প্রবীণদেরও নতুন করে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু আন্তর্জাতিক নয়, দেশীয় নতুন নতুন বাজার, খাত ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী না হলে আত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে।
৪
দেশের মেহনতি শ্রমিক-কৃষকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে, যখন রাষ্ট্রব্যবস্থায় জবাবদিহি-স্বচ্ছতা-তথ্যর অধিকার নিশ্চিত হবে। এসবের ফয়সালা শেষমেশ মাঠের লড়াইয়ের মস্ত বড় ময়দানেই হয়। কেবল টেবিল টকে আর খাতার পাতায় নয়। গণ-অভ্যুত্থান ও ইতিহাস তা–ই বলে এখনো। সেই ময়দানে বারবার ধস নামবে, লক্ষ্যচ্যুত হবে, যদি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে লড়াই ও সম্মিলিত চিন্তার ঐক্য না হয়। কী চাই, কেন চাই, কোথায় আমার আত্মমর্যাদা পদদলিত হয়, কোথায় আমার দেশ ও দশের মঙ্গল হয়, কোথায় আমি মাথা উঁচু করে দাঁড়াই, কোথায় আমি নিজেই নিজেকে পণ্যের মতো বিক্রি করি কিংবা নিজে শ্রেণির বিরুদ্ধে দাঁড়াই—সেসব চিন্তা ও বোঝাপড়ার ঐক্য না হলে বারবার শ্রমিক ও সমাজের অর্জন পরাজিত হবে, বেহাত হবে।
স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সময়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো অনেক শক্তিশালী ছিল। ’৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি সফলে আদমজী, ডেমরা থেকে লাখে লাখে শ্রমিক বেরিয়েছিলেন। ছাত্রদের শক্তিকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন তাঁরা। এই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়েই অর্জিত বিজয়ের পথ। কিন্তু শ্রমিকের মুক্তি আসেনি। ’৮৪ সালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রমিকেরা। গঠিত হয়েছিল স্কপ। ’৮৪ সালের বাংলাদেশে নজিরবিহীন শ্রমিক ধর্মঘট পালিত হয়েছে। কিন্তু তখনো শ্রমিকের মুক্তি আসেনি রাজনৈতিকভাবে। শ্রমিকের শক্তি বারবার পথ দেখিয়েছে, কিন্তু বিজয় অর্জন করতে পারেনি রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে। শ্রমিকনেতা হিসেবে সেই দায় থেকে মুক্ত শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী-সংগঠকেরাও।
নব্বই কিংবা শূন্য দশকের ইতিহাসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ’২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন টিকিয়ে রাখতে ময়দানের লড়াইয়ের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আদর্শিক লড়াই অনিবার্য। শ্রমিকদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী–সংগঠক ও রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা ছাড়া এই সাংস্কৃতিক লড়াই করা কঠিন। খুন হয়ে প্রাণ হারানোর ১০ বছর আগে ১৯৭০ সালে জন লেনন ও আরও অনেকেই ওই সময়ে শক্তিশালী গান ও সুরে সেই লড়াই করেছিলেন। তাঁদের রচনায় তাঁরা হাজির করেন পুঁজিবাদী সমাজের কায়দা-কানুনে শ্রমিককে প্রকৃতিগতভাবেই ছোট বা হীন প্রমাণ ও চিত্রায়ণের দৃশ্যগুলো। সেখানে উঠে আসে, কীভাবে আড়াল হয় শ্রমিকের দুর্দশার প্রকৃত কারণ বা রাষ্ট্র ও অর্থনীতিব্যবস্থার নিষ্ঠুর রহস্য। এমনভাবে শ্রমিকের চরিত্র আঁকা হয়, যাতে শ্রমিক যেকোনো মর্যাদা পাওয়ারই যোগ্য নন, সেই ভাবনায়ই মহিরুহ হয়। মহিরুহ হয় খোদ শ্রমিকের মনে, অভ্যাসে আচরণে ও সমাজে। ফলে শ্রমিক নিজেকে ছোট ভাবতে বাধ্য হন। ভেবে ভেবে কুরে কুরে মরেন, হীনম্মন্য হন, আত্মমর্যাদা নিয়ে টান টান হয়ে দাঁড়ানোর তাকত খুঁজে পান না। এসবের তালে তালে তরুণ প্রজন্মসহ সমাজের বাদবাকিরাও শেখেন শ্রমিক তুচ্ছতাচ্ছিল্যেরই পাত্র। এভাবে শ্রমিক ক্রমে পর-দূরের হয়ে ওঠেন সমাজে।
মধ্যম আয়ের দেশ বলে বড়াই করলেও মন-মেজাজে এখনো ঔপনিবেশিক শাসনামলের রেশ টেনে টেনে এগোচ্ছে রাষ্ট্র ও নাগরিকেরা। ওই আমেজেই সম্পর্ক গড়েছে শ্রমজীবী, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরস্পর। স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছে রাষ্ট্র। প্রবল শ্রেণি ও আয়বৈষম্যের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতপাতের বৈষম্যও গভীর হয়েছে। সেখানে শ্রমিকমাত্রই ‘ছোটলোক, ইতর, ফকিন্নি, গ্রাম্য, নোংরা, ছোট জাত’ নিচুতলার বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, ‘আনকালচার্ড’ বা সংস্কৃতিমনা নন—এমনই নানা অচ্ছুত বিশেষায়ণে পরিচিত।
শ্রমিকের কাজ বরাবরই ইতিহাসে নিম্নমান ও নিম্ন মূল্যের কাজ ছিল। ইতিহাসে উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শিল্পবিপ্লবের সময় পশ্চিমে ‘ব্লু কলার’ ও (গাঢ় নীল রঙের পোশাক পরে করা কাজ) ‘হোয়াইট কলার’ জব (সাদা ধবধবে কলারের পোশাক পরে করা কাজ) প্রচলন শুরু হয়। ব্লু কলার কাজ সাধারণত নিম্ন আয় ও শ্রেণির মানুষের জন্য ছিল, যাঁরা শারীরিকভাবে পরিশ্রম করতেন। হোয়াইট কলারের কাজ ছিল উচ্চ বা শিক্ষিত শ্রেণির জন্য, যাঁরা মানসিক শ্রমে নিযুক্ত থাকতেন। হোয়াইট কলার চাকরি হলো সাধারণত অফিস, ব্যবসা বা প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ব্লু ও হোয়াইট কলার জবের মতো বৈষম্যের নজির গেড়ে আছে বাংলাদেশেও। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে লাখ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে তৈরি হয়েছে এই দেশ, যাঁদের অধিকাংশই শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ। সেই দেশে আজ ৫৪ বছর পর্যন্ত বিভাজন-বৈষম্য দূর করতে পারেনি। শ্রমিকের সংজ্ঞায়নসহ নানা আইনকানুন ও সামাজিক মূল্যবোধে জারি আছে সেই বৈষম্য।
শ্রমিকের সংজ্ঞা-পরিচয়ের মধ্যে শুধু তাঁর সুযোগ–অধিকারই কেড়ে নেওয়া হয় না, ছোটও করা হয়। পরিহাস হলো এই ‘ছোটলোক’ মেহনতির ‘নোংরা’ হাতের নিংড়ানো সস্তা শ্রমে-ঘামে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের প্রভাত ও তথাকথিত ‘পরিচ্ছন্ন’ জীবন শুরু হয়। প্রাপ্তি ঘটে উঁচু ও মাঝারিতলার মানুষের অমূল্য অবসর, শিল্প ও জ্ঞানচর্চার ফুরসত, শিল্পপতি, শিল্পী হওয়ার সুযোগসহ ডালপালা মেলে নানামুখী প্রতিভা। জায়গা পায় ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পদ-বৈভব-বিলাস নির্মাণের সুযোগ। রচিত হয় সমাজের এক নির্দিষ্ট শ্রেণির ‘সাফল্য’গাথা। অর্থনীতিতে আসে উন্নয়নের সুবাতাস, মেট্রোরেল-পাতাল সেতুর যুগ। এ সবই ‘মেহনতি’ শ্রমিকের জীবন ও শ্রমের মূল্যকে পদে পদে পদদলিত করার গল্প।
সন্দেহ নেই, শ্রমিককে ‘নীচ-ছোট’ জাত কিংবা ‘অসভ্য-বর্বর’ হিসেবে পরিচিত করা ও অবমূল্যায়নের আদর্শিক সৌধ নির্মাণ না করলে তাঁর শ্রম শোষণের নিষ্ঠুরতাকে জায়েজ করা যায় না। এই সৌধের বিপরীত মতাদর্শিক গঠন ও ঐক্য নির্মাণ শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে এখন জরুরি করণীয়।
৫
শ্রমিকেরা কত আয় করেন, সেটা সবার জানা। বেঁচে থাকার মজুরি নেই, নেই কথা বলার অধিকারও। এই নিয়ে আওয়াজ তুললে শুরু হয় তুলকালাম। মূল ধারার রাজনীতিতে মিছিল-সমাবেশে ‘জমায়েত’ হিসেবে হাজির থাকা ছাড়া শ্রমিকের যেন বেশি কিছু করার নেই। তেমনি মৃত্যুতেও তাঁরা সংখ্যা। প্রাণ ও স্বপ্নের স্বীকৃতি জোটে না তাঁদের ললাটে। ক্ষতিপূরণের হিসাবেও তাঁরা সংখ্যাই। যত কমসংখ্যা, তত কম খরচ, কম ক্ষতিপূরণ, কম দায়। এভাবেই রানা প্লাজা-তাজরীন ফ্যাশনসের অবকাঠামো ও অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডে মৃত মানুষের সংখ্যা গণনা করা হয়। কিন্তু যাতে পয়সা খরচ হয় না, তেমন সামান্য মর্যাদা বা আর কিছুও কী পান শ্রমিক? একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র শ্রমিককে নির্দ্বিধায় ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলে ডাকা হয়। তাঁরা কেন ‘আপনি’ হওয়ার নয়? প্রশ্নটা কী কখনো এই ভদ্র সমাজের ভদ্র মগজে এসেছে। সম্বোধনের তরিকাই শক্ত করে জানান দেয়, ‘আপনি’ ডাকে যত্সামান্য যে সম্মান, ততটুকু পাওয়ারও ‘অযোগ্য’ তাঁরা এই সমাজে।
বাংলা শব্দের বিশাল ভান্ডারে ‘তুই-তুমি-আপনি’র চর্চা কেবল স্নেহ–মমতা–সম্মান বা ভালোবাসা প্রকাশেরই অর্থে নয়, প্রকাশিত হয় শ্রেণির ক্ষমতার প্রকাশ হিসেবেও। নারীকে ‘মহিলা’ নামে চিহ্নিত করে তাঁর কাজকে মহল, অন্দরমহলে সীমাবদ্ধ করে অবমূল্যায়নই করা হয়। এভাবেই চলে ভাষার ক্ষমতা ও রাজনৈতিক চর্চা। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে শ্রমিকের সুরত নির্মাণে। সমাজের মনে গড়া হয় ‘শ্রমিক’–এর পরিচয়।
শ্রমিকের কাজ যেন বড়জোর অনুগ্রহের জন্য ক্ষমতাশীলদের দুয়ারে দুয়ারে মাথা ঠুকে মরা। মর্যাদা পাওয়ার অধিকার বা কিসমত কোনোভাবেই নেই তাঁদের। মনে পড়ে, ছোটবেলার রচনা বইয়ে শ্রমের মূল্য নিয়ে কথা। মনে পড়ে, শ্রমিক আন্দোলনের নানা অভিজ্ঞতা। কিংবা সভা–সেমিনারে দেশীয় উদ্যোক্তাদের আবেগাপ্লুত বক্তব্য। যে বক্তব্যে মালিকশ্রেণি নিজেদের ‘শ্রমিকবান্ধব’ হিসেবে উপস্থাপন করত, শ্রমিককে নিজের পরিবার, ভাইবোন এমনকি কখনো সন্তানের সঙ্গেও তুলনা করত। কিন্তু বাস্তবে সেই সম্পর্ক স্পষ্টতই বিরাজ করে না। আত্মীয়তা তো দূরের বিষয়, অর্থনীতির প্রাণভোমরা শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে অন্তত সম্বোধনের যে সম্মান বা সংস্কার, সেটুকু কী নতুন বাংলাদেশের নতুন মালিকশ্রেণি কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চিত করতে পারবে?
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে আয়োজন আনলে এই কালের তরুণেরা শ্রমের ও শ্রমিকের মূল্য সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারবেন, তার কোনো যথার্থ উদ্যোগ নেই এই দেশে। উন্নয়নের জোয়ারের বড়াই থাকলেও শ্রমিকের ইতিহাসের যথার্থ কোনো সংরক্ষণ নেই। এ দেশে আছে চরকায় সুতা কাটা থেকে শুরু করে পোশাক কারখানায় মেশিনে পোশাক তৈরির লম্বা ইতিহাস। রয়েছে সোনালি আঁশের দেশে পাটকল, কাগজের কল বা চা খাতসহ অন্যান্য খাতের উত্থান-পতনেরও সমৃদ্ধ ঘটনা। অর্থনীতির মোড় ঘোরার মতো নানা গল্প। আছে মজুরি, গণ–অভ্যুত্থানসহ আন্দোলনে শ্রমিকের আত্মদানের গল্প। কিন্তু এসব কোনো ইতিহাসই শ্রমিককে বীরের আসনে বসাতে পারেনি এই জমিনে।
তাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা পাঠ্যপুস্তকে, রাস্তার মোড়ের ভাস্কর্যে, মিডিয়া প্রচারণায় কেবল মহান বীর হয়ে ক্ষমতাশীলরাই থাকবেন না, থাকবে শ্রমিকের বীরত্বগাথা, পথে শ্রমিকের ভাস্কর্য, তৈরি হবে রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনসের মতো স্থানে স্মৃতিসৌধ। সংরক্ষিত হবে সেসব ঐতিহাসিক স্থান। তৈরি হবে শহীদ মিনার, জাদুঘর, গবেষণাগার ইত্যাদি। সড়কের নাম হবে মজুরি আন্দোলনে প্রাণ হারানো শ্রমিক আঞ্জুআরা কিংবা গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ সুমন বা শুভশীলের মতো পোশাকশ্রমিকসহ আরও শ্রমিকদের নামে। থাকবে শিক্ষা সিলেবাসে মাধ্যমিক থেকে নানা পর্যায় শ্রম বিষয় ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ কোর্সের অংশ হিসেবে। এর ধারাবাহিকতায় খেত–খামারে বা শ্রম এলাকায় নির্দিষ্ট সময় যুক্ত থাকবেন শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেবার স্টাডিজের মতো বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। গণ-অভ্যুত্থানে কিংবা নানা শ্রমিক আন্দোলনে প্রাণ হারানো ব্যক্তিরা কেবল রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের স্বীকৃতি বা টাকার অঙ্কে ক্ষতিপূরণে সীমায়িত হবেন না। অর্জিত হবে শ্রমিকের মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি। এই সব স্বীকৃতি একদিন সকালে দরজায় হঠাৎ প্রিয়জনের মতো কড়া নাড়বে না। তার জন্য কাঠখড় পোড়া আন্দোলন–সংগ্রাম করতে হবে ময়দানে ও মননে।
৬
আমাদের আকাঙ্ক্ষা শুনে কেউ হতোদ্যম করার কৌশলে বলতে পারেন ‘চাঁদে গিয়ে হাট বসাতে স্বপ্ন দেখছি’। কিন্তু এটা সত্য, চাঁদে হাট হয়তো বসানো সম্ভব নয়, সেটা আমাদের আকাঙ্ক্ষাও নয়। কিন্তু দূরকে দেখতে পাওয়া এবং সেই দূর–ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া বিচক্ষণতা। চাঁদে নামতে না পারলেও কাদা-মাটিতে কণ্টক ভরা পথে আমাদের নামতে হবেই। ঐক্যবদ্ধভাবে চিন্তার মেলবন্ধনে একদল নেতৃত্ব তৈরি হওয়া এবং তার মশাল তরুণ প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারলে কিছু একটা ঘটবেই। এই পারাতে আমাদের মাটি-জলে-শ্রমিক পাড়ায়-রাজনীতিতে চাঁদের হাট বসবে।
শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় একদল নেতৃত্ব গঠনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও মালিক স্বার্থে তৈরি ট্রেড ইউনিয়নের চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে স্বচ্ছ-জবাবদিহিমূলক ও প্রকৃত ইউনিয়ন তৈরির আইন ও পরিবেশ তৈরিতে উদ্যোগ-আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে। এই পথ লড়াই খুব ফুলেল বা লালগালিচার মখমলের মতো পেলব নয়; বরং মনের ভেতর ও বাইরে রক্তক্ষরণের মতো। এর সঙ্গে লড়তে যেমন সংগঠিত শারীরিক শক্তির প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মনের জোর ও চিন্তার ঐক্য।
অবিকশিত অর্থনীতি-রাজনীতি ও গণতন্ত্র, ভোটাধিকারহীন ভয়যুক্ত পরিবেশে টিকে থাকলে শ্রমিককে তাঁর অধিকার আদায়ের পদে পদে রাষ্ট্র ও মালিকের অনেকেই বাধা দেবে, বলপ্রয়োগ করবে। এরপর আইনের মধ্য দিয়ে জেল–জুলুম চলবে। তারপরও যদি আপনি বশে না থাকেন, রাষ্ট্র ও তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ব্যবহার করবে তার আদর্শিক হাতিয়ার। কোনোভাবে পুঁজিপতিদের পক্ষের বাইরে আপনাকে পরাস্ত করা না গেলে প্রতিদিন নেশার মতো নিজের বিরুদ্ধেই বুঁদ করে রাখা, ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার অস্ত্র ব্যবহৃত হবে আপনাকে কাবু ও ক্লান্ত করতে। আপনার সামনে বৈষয়িক প্রলোভনের ফানুস ওড়ানো হবে। সেই ফানুস আর বুদ্বুদের নেশায় আপনি আরও বুঁদ হবেন। ফিরে আসতে চাইবেন আবার আসক্তের মতো নেশায় বুঁদ হবেন এই চক্রে। শ্রমিক হয়ে শ্রমিকশ্রেণির বা শ্রেণির রাজনীতির পক্ষে না দাঁড়িয়ে খোদ নিজ শ্রেণির বিপক্ষে দাঁড়াবেন। বুলডোজারের মতো তাদের ক্ষমতা নানাভাবে আপনাকে মানসিকভাবে দুর্বল-চুরমার করার চেষ্টা চালাবে। আপনার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে অপপ্রচার করতেও তারা বিরত হবে না। আপনাকে ছোট করার সব রকম চেষ্টা করবে। যেমনটা বলেছেন জন লেনন। আদর্শ গড়া আর ভাঙা হবে একান্ত নিবিড় পরিবেশে। আপনি টেরও পাবেন না প্রায়শই। ক্ষমতাধরদের সুরে সুরে আপনি বলবেন, ‘গরিবের করোনা হয় না’, ‘গরিবের আল্লাহ আছে’। এই বলে করোনার উপসর্গ ঢাকবেন, চাকরি বাঁচাবেন। অথচ আপনার অজান্তেই আপনি শারীরিক শ্রমিকই রয়ে যাবেন। হয়ে পড়বেন জড়বস্তুর মতো। কিন্তু নাটকের এই পর্বেই রাজনীতি অপরিহার্য। জরুরি রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও শ্রেণির রাজনীতি। তা না হলে মালিকের পোষ্য ও বশে থাকা ইউনিয়নের কান্ডারি হবেন আপনি। শ্রমিকের বিপক্ষের গবেষক হবেন। কেউ ঠেকায় রাখতে পারবে না। একমাত্র রাজনীতি, দেশ ও শ্রেণির প্রতি অঙ্গীকার পারে আপনাকে রক্ষা করতে এবং শ্রমিকশ্রেণির ও গণতন্ত্রের পক্ষের যোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করতে।
তাই এক আকাশের নিচে সবাই এক হয়েও অপর থাকার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। মস্ত বড় ময়দানে ঐক্যবদ্ধ লড়াই, আইনি লড়াই সঙ্গে সঙ্গে চালাতে হবে সাংস্কৃতিক লড়াই। মুক্তবাজার ও বিশ্বায়নের যুগে স্থানিক-আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই শ্রমিকের অধিকারের পক্ষে উদ্যোগ, লড়াই ও সংহতি জারি রাখা জরুরি। এই কালে বাংলাদেশের শিল্প খাত, যাতে বিদেশিদের সিংহভাগ মুনাফার চারণ ক্ষেত্রে পরিণত না হয়, তার জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি তৈরি করতে হবে।
কোনো রাষ্ট্রে জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা, ভোটাধিকার, জবাবদিহি দিন দিন নাই হতে থাকলে সমাজ কী চেহারা নেয়, তা সবার জানা। স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছায়, ক্ষমতা হয়ে উঠে ব্যক্তির গোষ্ঠীর লুটপাটের হাতিয়ার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসে। ক্রমে ফ্যাসিবাদ শিকড়ে–বাকড়ে ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জমিনে–আসমানে। সেই জমিনে শ্রমিকের পাওনা কম হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মনের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ফ্যাসিবাদকে সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবিলা করা চারটিখানি কথা নয়। সেই লাগাতার লড়াই-ই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথরেখা।
তাসলিমা আখতার সভাপ্রধান, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি; আলোকচিত্রী এবং সদস্য শ্রম সংস্কার কমিশন। taslima_74@yahoo.com