দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মহলে এখন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা হবে কি হবে না। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না। না এলে রাজনৈতিকভাবে তার অবস্থান কী হবে? সরকার আরও একটি একতরফা নির্বাচন করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কি না। জামায়াতে ইসলামী কী ভূমিকা নেবে? জাতীয় পার্টি এবারেও সরকারের সহযোগী হিসেবে মাঠে থাকবে, না স্বতন্ত্র অবস্থান নেবে?
গণতন্ত্রের সার কথা হলো আলোচনা–বিতর্কের মধ্য দিয়ে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করা। কিন্তু বাংলাদেশে খুব কম ক্ষেত্রেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। নির্বাচনী সংকট নিয়ে ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথের পক্ষে স্যার নিনিয়ান ও ২০১৩ সালে জাতিসংঘের পক্ষে ফরনান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।
সফল হননি। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক-মহাসচিব দফায় দফায় আলোচনা করেও সমস্যার জট খুলতে পারেননি।
নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও বলছেন, বর্তমান সরকারই নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকবে। তবে সরকারের চরিত্র ও আকার কিছুটা ভিন্ন হবে। ওই সরকার দৈনন্দিন কাজ করবে, নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। নির্বাচনের বিষয়ে তারা নির্বাচন কমিশনকে সর্বোতভাবে সহায়তা করবে। বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলগুলোর দাবি, যে নামেই হোক না কেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। আওয়ামী লীগের মহাজোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিও মনে করে, দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তবে তারা বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাও সমর্থন করে না।
তাহলে নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামোটা কী হবে? আওয়ামী লীগ বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। বিএনপি বলছে, নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তাহলে কি বিএনপিকে বাদ দিয়েই ২০১৪ সালের মতো একটি নির্বাচন হবে? সেই নির্বাচন কি দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন হলো, জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না। মনে রাখতে হবে নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি জনগণ। নির্বাচনে তাদের প্রতিনিধি বাছাইয়ের উন্মুক্ত সুযোগ থাকতে হবে। একতরফা নির্বাচনে সেই সুযোগ থাকে না।
নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ফর্মুলা বা রূপরেখার কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো বর্তমান সংসদ থেকে ১০ জন সদস্য পদত্যাগ করে তাদের শূন্য আসনে উভয় পক্ষের মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্দলীয় ১০ জনকে নির্বাচিত করে এনে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা।
সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠনের কথাও বলেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি সরকারি ও বিরোধী দল থেকে সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব দিলেও আওয়ামী লীগ সেটি গ্রহণ করেনি। তখন আওয়ামী লীগ বলেছিল, খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী রেখে কোনো সমাধান হতে পারে না। এখন বিএনপিও বলছে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে না।
তাহলে সংকটের সমাধান কোথায়? সেবারে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এক হয়ে বিএনপি সরকারকে সংবিধান সংশোধন করতে বাধ্য করেছিল। এবারে বিএনপি আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে পারবে কি? আবার বাধ্য করতে পারলেও জনগণকে যে অপরিমেয় ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, তার বহনের ক্ষমতা কি দেশের আছে? সে ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে দুই পক্ষের মতৈক্যে পৌঁছানো জরুরি বলে মনে করি।
নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ফর্মুলা বা রূপরেখার কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো বর্তমান সংসদ থেকে ১০ জন সদস্য পদত্যাগ করে তাদের শূন্য আসনে উভয় পক্ষের মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্দলীয় ১০ জনকে নির্বাচিত করে এনে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বইয়ে প্রায় অনুরূপ একটি রূপরেখার কথা আছে। এতে বলা আছে, ‘নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ২০টি আসন থাকবে। ২০টি আসনের মধ্যে ১০টি আসনের জন্য সরকারি দল ২০ জন দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবে।
আবার বিরোধী দল বাকি ১০টি আসনে ২০ জন নির্দলীয় ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবে। জাতীয় সংসদ সরকারি দলের ২০ জন থেকে ১০ জন এবং বিরোধী দলের ২০ জন থেকে ১০ জনকে নির্বাচিত করবে। এই ২০ সদস্যদের মধ্য থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন গোপন ভোটের মাধ্যমে। ব্যালটে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে লটারির মাধ্যমে একজনকে প্রধানমন্ত্রী করা হব।’ (অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, আকবর আলি খান, প্রথমা প্রকাশন ২০১৭)
আরেকটি বিকল্প প্রস্তাব হলো; বর্তমানে সংসদে আছেন এমন ১০ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে, যাঁরা পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবেন না। সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলোর মধ্যে এমন ১০ জন সদস্য পাওয়া কঠিন নয়, যাঁরা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করবেন। অন্তত বাকী জীবন ‘সাবেক মন্ত্রীর’ তকমা ব্যবহার করতে পারবেন।
বৃহস্পতিবার সমকাল বিএনপির নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখাবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে একজন বিশিষ্ট নাগরিককে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি মনে করে, ১৯৯০ সালের মতো রাজনৈতিক মতৈক্য হলে সংবিধানের ভেতরে থেকেও নির্দলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। তাদের মতে, ১৯৯৬ সালে বিএনপি জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারও বিরোধী দলের দাবি মেনে নেবে।
নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে একজন বিশিষ্ট নাগরিককে বিএনপির বেছে নেওয়ার কারণ তারা মনে করে সাবেক প্রধান বিচারপতি আওয়ামী লীগের ‘দলীয় লোক’ ছিলেন। একই যুক্তিতে আওয়ামী লীগ কেএম হাসানকে মেনে নেয়নি।
সরকারের পক্ষ থেকে এখনো বিএনপির প্রস্তাবের কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে সংলাপ নিয়ে চাপানউতর আছে। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, ‘যখন তারা (বিএনপি) বলবে আমরা ইলেকশনে অংশগ্রহণ করতে রাজি আছি, আমরা অংশগ্রহণ করব।’ এর জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগে সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে তারা পদত্যাগ করবে। তারপরই সংলাপ হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও চায় নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংলাপ হোক।
প্রশ্ন হলো, নির্বাচনকালীন সরকারের চেহারাটা কেমন হবে? সরকার মানে ১০ জন বা ২০ জনের মন্ত্রিসভা নয়। সরকার মানে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র, যার মধ্যে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন থাকবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকবে। ৩০০ আসনে নির্বাচনী মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করতে ১৩/১৪ লাখ কর্মকর্তা–কর্মচারীর প্রয়োজন হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এই ব্যক্তিবর্গ গোপনে বা প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ নিলে নির্বাচনকালীন সরকারে ১০ বা ২০ জন ‘মহাপুরুষ’ বসিয়েও কোনো লাভ হবে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
ই–মেইল: [email protected]