ঘটনা-১
বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে, বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। ধারণা করা যায়, তিনি একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। বিবাহিত হলেও স্বামীর সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। দু-একটি ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, তিনি স্বাবলম্বী হতে চাইতেন, কিছুটা স্বাধীনচেতা ও সাহসী ছিলেন। মা-বাবা তাঁকে ঢাকায় যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি গার্মেন্টসে কাজ করার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। সেদিন রাতে অনেকটা জোর করেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। ডাকাতেরা যখন ঈগল এক্সপ্রেসের বাসটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তল্লাশি করতে আসে, তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। এরপর যা ঘটল, তা অবর্ণনীয়, ছয়জন ডাকাত বাসের মধ্যে ওই নারীকে ধর্ষণ করল। ২ আগস্ট মধ্যরাতে টাঙ্গাইলে এ ঘটনা ঘটে।
ঘটনা-২
থাকতেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায়, কাজ করতেন একটি পোশাক কারখানায়। ৭ আগস্ট ভোরে স্বামীকে নিয়ে নওগাঁ থেকে এসে গাজীপুর নগরের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় নামেন। সেখান থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলাচলকারী তাকওয়া পরিবহনের একটি মিনিবাসে করে শ্রীপুরের মাওনার দিকে যাত্রা করেন। বাসটিতে দুজন কর্মী ছিলেন। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় পৌঁছালে তাকওয়া পরিবহনের আরও তিন কর্মী বাসটিতে ওঠেন। হোতাপাড়ায় পৌঁছালে অন্য যাত্রীরা বাস থেকে নেমে যান। এরপর ওই নারীর স্বামীকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় এবং পাঁচ পরিবহনকর্মী বাসের ভেতর তাঁকে ধর্ষণ করেন।
ঘটনা-৩
মেয়েটি দশম শ্রেণির ছাত্রী, বয়স মাত্র ১৬। বাড়ি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায়। কথিত প্রেমিকের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছিলেন। সারা দিন ঘোরাঘুরির পর ৭ আগস্ট রাত আটটার দিকে আটোয়ারী উপজেলার ভারত সীমান্তঘেঁষা একটি নির্জন বাগানে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে কথিত প্রেমিক ও তাঁর এক বন্ধু। সে সময় মেয়েটির চিৎকারে স্থানীয় পাঁচ ব্যক্তি সেখানে আসেন এবং কথিত প্রেমিক ও তাঁর বন্ধু পালিয়ে যান। পরে মেয়েটি ওই পাঁচ ব্যক্তির কাছে ঘটনা খুলে বলে এবং তাঁদের কাছে সাহায্য চায়। কিন্তু সাহায্যের বদলে তাঁরাও মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন।
নিয়মনীতি মেনে ওপরের ঘটনাগুলোর যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁদের কারও নামপরিচয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেরই যেমন স্বতন্ত্র নাম, পরিচয় আছে, তেমনি অন্যদের মতো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদেরও স্বপ্ন ছিল, সাধ ‘ছিল’। ‘ছিল’ বলতে হচ্ছে। কারণ, তাঁরা যে ভয়ানক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন, এরপর দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা তাঁদের জন্য খুব সহজ কাজ নয়। আমাদের সমাজে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনায় অপরাধীদের পাশাপাশি ভুক্তভোগী নারীরও ‘দোষ’ খোঁজা হয় এবং কোনো নারী এ রকম কোনো ঘটনার শিকার হলে সেটা তাঁর ‘সম্মান বা মর্যাদার জন্য হানিকর’ বলে মনে করা হয়। ফলে এ ধরনের ঘটনার শিকার নারীর কোনো দায় না থাকা সত্ত্বেও এটা তাঁর জন্য হয়ে দাঁড়ায় সোশ্যাল স্টিগমা বা লোকলজ্জার বিষয়। এগুলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হলেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সমাজের একটি বড় অংশের মানুষ এখনো এমন ধারণার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
ওপরের প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। বেশ কয়েকজন অপরাধী ধরা পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অপরাধের স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন। বিষয়টি এখন আইনি প্রক্রিয়াধীন, যেখানে আদালত-পুলিশ-কৌঁসুলিরা তাঁদের কাজ করবেন, শুনানি-সাক্ষ্য-জেরা হবে এবং বিচারে হয়তো কারও কারও সাজাও হবে। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে যে বিষয়গুলো নেই, তা হলো যাঁরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাঁদের ট্রমা বা মানসিক যন্ত্রণার লাগব ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। ভুক্তভোগী নিম্নবিত্ত পরিবারের হলে এসব নিয়ে চিন্তা প্রায় অবান্তর, বরং মামলা পরিচালনার খরচ জোগাড় করাই দুরূহ ব্যাপার হয়ে ওঠে।
ধর্ষণের ঘটনায় একজন ভুক্তভোগী যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, কোনো অঙ্কের অর্থ দিয়েই তাঁর ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ভুক্তভোগীর মানসিক অবস্থার উন্নয়ন এবং পরবর্তীকালে তাঁর পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে এটা কিছু ভূমিকা রাখতে পারে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার একটি বিধান আছে। কিন্তু বিষয়টি আদালতের ইচ্ছাধীন রাখা হয়েছে এবং ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণও নির্দিষ্ট করা হয়নি। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় নিষ্পত্তি হওয়া ৫০টি মামলার মধ্যে মাত্র ৩টি মামলায় জরিমানার অর্থকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করার আদেশ দেয় আদালত, শতাংশের হিসাবে যা মাত্র ৬।
ধর্ষণের মতো অপরাধ কমাতে হলে আমাদের আইনি কাঠামো ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পাশাপাশি ভুক্তভোগীকে মানসিক সমর্থন ও পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়াটা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কেউ অপরাধ করলে তিনি বিচারের মুখোমুখি হবেন এবং কেউ অপরাধের শিকার হলে আইন-আদালত-রাষ্ট্র সংবেদনশীলভাবে তাঁর পক্ষে দাঁড়াবে—এ ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার পর অপরাধীর সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় করে। কিন্তু মামলা চলাকালে এই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো বিধান নেই। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভুক্তভোগীর কাছে ক্ষতিপূরণের অর্থ একাধিক উৎস থেকে আসতে পারে। শুধু অপরাধী নন, বরং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। অনেক দেশে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে ভুক্তভোগীরা ক্ষতিপূরণ পান। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ধর্ষণের শিকার নারীরা মামলা চলাকালে রাষ্ট্রের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন।
শুধু ক্ষতিপূরণ দেওয়া নয়, আদায়ের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। অনেক সময় আদালত ভুক্তভোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও পারিপার্শ্বিকতা তাঁর বিরুদ্ধে থাকে। ২০১৯ সালের মার্চে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় দুই পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণের শিকার এক নারীকে কেন ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে ধর্ষণের শিকার ওই নারী মামলাটি চালাতে রাজি হননি। এ ঘটনায় সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে, প্রভাবশালী কোনো মহলের চাপের মুখে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন কি না।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া মামলাগুলোতে সাজা হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। শত্রুতামূলক বা সাজানো মামলার বিষয়টি বিবেচনায় রাখলেও এ সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমভাবে কম। এটা আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে। কিন্তু এই বিষয়গুলোর কোনো সংস্কার বা পরিবর্তন না করে সরকার ২০২০ সালের অক্টোবরে ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করেছে। এই শাস্তি বৃদ্ধি ধর্ষণের সংখ্যা কমাতে পারেনি। এ থেকে স্পষ্ট, বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করলে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও কোনো অপরাধ কমাতে পারে না।
ধর্ষণের মতো অপরাধ কমাতে হলে আমাদের আইনি কাঠামো ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পাশাপাশি ভুক্তভোগীকে মানসিক সমর্থন ও পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়াটা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কেউ অপরাধ করলে তিনি বিচারের মুখোমুখি হবেন এবং কেউ অপরাধের শিকার হলে আইন-আদালত-রাষ্ট্র সংবেদনশীলভাবে তাঁর পক্ষে দাঁড়াবে—এ ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক