সংস্কারপ্রক্রিয়ায় সমঝোতার বিকল্প নেই

১৯৮৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, ১০০টি রাষ্ট্র ১৮৯টি সংবিধান গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ১৫৫টি ছিল নতুন বা পুনঃস্থাপিত সংবিধান। সংবিধান সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী দলিল হিসেবে তৈরি করা হয়। তাই সেখানে সংশোধনের বিধান থাকলেও পূর্ণ প্রতিস্থাপনের বিধান খুব কম ক্ষেত্রেই রাখা হয়। তা সত্ত্বেও ৩০ বছরে ১৫৫টি সংবিধানের পুনর্লিখনের প্রয়োজন হয়ে পড়া প্রমাণ করে যে সংবিধান লেখার প্রক্রিয়ায় সাধারণত কোনো গলদ থেকে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কোনো দেশে যে প্রজন্ম সংবিধান লেখে সেই প্রজন্ম আর পুনির্লিখনের সময় নেতৃত্বে থাকে না। ফলে তাদের ভুলের শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্ম কাজে লাগাতে পারার সুযোগ কম।

সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়া সাধারণত অরাজক ও অস্থির পরিবেশে শুরু হয়। গভীরভাবে তাড়িত হয় পরিস্থিতির সংঘাতময় বাস্তবতা দ্বারা। সাধারণত সংবিধান পুনর্লিখনের প্রয়োজন পড়ে যখন রাষ্ট্র ক্ষমতার সাংঘর্ষিক পালাবদল ঘটে। সেই সময় নতুন বিজয়ী শক্তির অস্তিত্বজুড়ে থাকে পরাজিত শক্তির যত তিক্ততা। সেই জন্য আগের শক্তির ভুলগুলোকে শুধরে নেওয়াই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। দেশের সবার কল্যাণ কীভাবে হবে বা দীর্ঘ মেয়াদে কী করণীয় সেটা গৌণ হয়ে পড়ে। তা ছাড়া শক্তির শূন্যস্থান পূরণ করতে অনেক গোষ্ঠীস্বার্থ সংঘাতে লিপ্ত হয়। তাই দ্রুত কোনো সমাধানে আসার চাপ সৃষ্টি হয়। গভীর চিন্তাভাবনার বা আলোচনার সময় তখন পাওয়া যায় কম।

যতই সংঘাতময় পরিস্থিতি থাকুক না কেন, জনকল্যাণকর সংবিধান তৈরির প্রধান উপাদান হলো সমঝোতা। সমঝোতার উদ্দেশ্য সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অংশীদারের প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য পূরণ। আর সমঝোতা সাধারণত অর্জন হয় যুক্তিতর্কের মাধ্যমে। অতিরিক্ত আবেগ বা অবাস্তব সময়সীমায় আবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে থেকে। তবে সব সময় সমঝোতা অর্জন করা যায় না। তখন সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় দর-কষাকষির এবং কিছু ক্ষেত্রে ভোটের সুযোগ থাকা উচিত। বিশেষ করে যখন আপস–মীমাংসার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। যখন সমঝোতা অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন আপস অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আপস এমন একটা বন্দোবস্ত যেখানে প্রতিটি পক্ষ মনমতো সবকিছু পায় না, কিন্তু একটা চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য কিছু ছাড় দিতে রাজি হয়।

সমঝোতা এবং আপসের মধ্যে পদ্ধতি এবং পরিণামে পার্থক্য থাকে। আপস হয় সাধারণত পারস্পরিক ছাড়ের মাধ্যমে। আর সমঝোতা এমন একটা চুক্তি অর্জন করতে চায় যা পরস্পর বিরোধী দাবি অতিক্রম করে সব পক্ষের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছায়। অন্য কথায় সমঝোতা এমন একটা কর্মপন্থা খোঁজে, যা সব পক্ষের মূল প্রয়োজনগুলো পূর্ণ করে। তবে সেই অবস্থায় পৌঁছাতে সব পক্ষের প্রাথমিক অমিলের স্তর অতিক্রম করতে হয়।

সমঝোতাকে ‘সংবিধান অনুমোদনের আনুষ্ঠানিক মানদণ্ড’ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। একটা সংবিধানের কিছু অংশ আপস বা ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হতে পারে। তবে সেটা যদি সর্বসম্মতিতে অধিষ্ঠিত হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে সংবিধানের মৌলিক নীতির ওপর ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে যদি কোনো সংবিধানের অধিকাংশ ধারা, বিশেষ করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ধারা ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হয়, তবে সেটা ভবিষ্যতে অস্বস্তি বা বর্জনের শিকার হতে পারে। কারণ, যারা ছাড় দেয় তারা পরে তাদের সিদ্ধান্তের জন্য আফসোস করতে পারে।

যে সংবিধানগুলো ব্যাপক সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, সেগুলো সাধারণত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি সৃষ্টি করে। পরে এদের চ্যালেঞ্জ বা বর্জনের সম্ভাবনা কম থাকে। অপর দিকে যে সংবিধানগুলো শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে গৃহীত হয়, সেগুলোতে যারা ভোটের প্রক্রিয়ায় পরাজিত হয়, তাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অসন্তোষ থেকে যায়। অবশ্য সমঝোতা অর্জন সম্ভব না হলে আপস জরুরি হয়ে পড়ে। আর আপস অসম্ভব হয়ে পড়লে, ভোট তখন একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়।

সংবিধান লেখার সময় সব পক্ষকে রলসের ‘অজ্ঞতার পর্দা’ তত্ত্বকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই তত্ত্ব বলে যে ন্যায়–অন্যায় বিচার করতে বিচারকদের নিজের গোষ্ঠীস্বার্থ এবং গোষ্ঠী দৃষ্টিকোণ বাদ রেখে সমাধান খুঁজতে হয়। এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে খুব সহজে অপরাপর গোষ্ঠীর সম্ভাব্য আপত্তি বোধগম্য হয় ওঠে। সংবিধান প্রণয়নকারীরা ন্যায্যতার এই সর্বজনীন মাপকাঠি মেনে নিলে তারা সেই নীতিগুলোর ওপর সম্মত হতে পারে, যা সবার জন্য ন্যায্য বলে মনে হয়।

যখন সমঝোতায় কোনোভাবেই পৌঁছানো যায় না, তখন আপস অপরিহার্য হয়ে ওঠে। একটা সুবিধা হলো আপসগুলো সব পক্ষকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে না পারলেও অনেক সময় তারা কিছু বিতর্কের সমাধান করতে কাজে লাগে।

আপসগুলো পার্থক্য দূর করতে সাহায্য করলেও যখন দেওয়া ছাড়গুলো তাদের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হয়, সেগুলো পরে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে যে সংবিধান ব্যাপক সমঝোতা অর্জন করে, সেটা কম অসন্তোষের সৃষ্টি করে। কারণ, অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি সংযুক্ত এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে মনে করে থাকেন।

সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়া সফল করার জন্য সব প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি মূল কোনো গোষ্ঠী সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে যায়, তাহলে পরে তারা সংবিধানটি প্রত্যাখ্যান করতে মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। মনে করতে পারে যে এতে তাদের স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব করা হয়নি। সংবিধান প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের যুক্তিভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করাটা সমঝোতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। যুক্তিভিত্তিক আলোচনা নিশ্চিত করে যে অংশগ্রহণকারীরা একে অপরের অবস্থান এবং উদ্দেশ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা মূল্যায়ন করার সুযোগ পায়।

আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে যে সংবিধান তৈরি হয়, সেগুলোতে তাড়াহুড়ো করে চাপিয়ে দেওয়া বা সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটের ওপর তৈরি হয় না বলে তা অধিক স্থায়িত্ব লাভ করে এবং পরে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। সমঝোতার ভিত্তিতে পাওয়া সংবিধান অধিক বৈধতা উপভোগ করে। কারণ, তার মধ্যে সব পক্ষের গুরুতর বিবেচনার প্রতিফলন থেকে যায়।

ইন্দোনেশিয়া, তিউনিসিয়া, ভারতসহ অনেক অনুকরণীয় সংবিধানের ক্ষেত্রে, সংবিধানগত প্রক্রিয়াগুলো ব্যাপক আলোচনার এবং বিস্তৃত সমঝোতার ফসল ছিল। প্রতিটা ক্ষেত্রেই কিছু বিষয় আপসের মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছিল, তবে সার্বিক প্রক্রিয়ার গণতান্ত্রিকতার ওপর ব্যাপক সমঝোতা ছিল। এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে, যদিও আপস কখনো কখনো প্রয়োজনীয়, সব পক্ষের সার্বক্ষণিক লক্ষ্য হওয়া উচিত সমঝোতা অর্জন, কারণ সমঝোতা শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সৃষ্টি করে।

নাগরিক অংশগ্রহণ মূল্যবান হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আচরণ সংবিধানপ্রক্রিয়ার সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক এলিটরা সংবিধান তৈরি এবং তার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। যে সংবিধান সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, তা ভবিষ্যতে বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা কমিয়ে একটা শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে সহায়তা করে।

সবশেষে সবচেয়ে কার্যকরী সংবিধানপ্রক্রিয়া সেগুলো, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং যা আলোচনা এবং সমঝোতা জোরদার করে। এ প্রক্রিয়ায় তৈরি সংবিধান হয়ে ওঠে স্থায়ী, গণতান্ত্রিক এবং সমাজের সম্মিলিত মূল্যবোধের প্রতিফলন, যা পরে চ্যালেঞ্জ বা বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। জাতি ঐক্যের আবহে তখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশ সামনেই সংবিধান কমিশন থেকে একটা সংবিধান প্রস্তাব পেতে যাচ্ছে। সেই প্রস্তাবে কী থাকবে, সেটা নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা চলছে, কিন্তু প্রস্তাব সামনে এলেই কীভাবে সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হবে, সেটা নিয়ে আলাপ সামনে চলে আসবে। এ লেখায় যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে বাস্তবায়ন প্রশ্নের এককথায় উত্তর হচ্ছে—সমঝোতার মাধ্যমেই আমরা সংস্কার প্রস্তাবের টেকসই বাস্তবায়ন পেতে পারি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে নিজে এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার কোনো ম্যান্ডেট নেই। তারা নিজেরা যতই রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসার প্রস্তাব দিক না কেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো ন্যূনতম দাবিতে ঐকমত্যে আসার সম্ভাবনা একপ্রকার নেই। যেসব দল বা শক্তি সংস্কারের আগে নির্বাচন মেনে না নেওয়ার বিষয়ে একজোট, তারা নির্বাচনকামী পেশাদার দলগুলোর নামমাত্র সংস্কার প্রস্তাব কোনোভাবেই মেনে নেবে না। অন্যদিকে পেশাদার ও পেশীভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতা উপভোগ করার বিষয়ে ছাড় দিতে হয়, এমন সংস্কার মেনে নিতে আগ্রহী হবে না।

এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব হয়ে উঠবে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিয়ে একটা জাতীয় সমঝোতা পরিষদ গড়ে তোলা এবং সেই পরিষদের কার্যবিধি ঠিক করে দেওয়া। পরিষদ যাতে ঠিক লাইনে থাকে, সে জন্য সংস্কার কমিশন সমঝোতা প্রক্রিয়া পরিচালনার দায়িত্বে থাকতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজ, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, পেশাজীবী ও শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী এসব অংশের প্রতিনিধিরাও যাতে সমঝোতা পরিষদে যুক্ত হতে পারেন, কমিশন সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারে।

আলোচনা যাতে সমঝোতায় আসাকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে সব সময় সামনে রাখে, কমিশন সেই গুরুদায়িত্ব নিতে পারে। আলোচনা যাতে অতিরিক্ত আবেগ আর তাড়াহুড়ার চাপমুক্ত হয়ে যুক্তির ভিত্তিতে হয়, সেই ব্যবস্থা করতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সমঝোতা সম্ভব না হলে কিছু ছাড় দিয়ে আপস–মীমাংসার আলোচনা করার পেছনের দরজা হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিষদ যাতে সাধারণত ভোটাভুটি থেকে দূরে থাকে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। একান্তই যদি আপস বা ভোটের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কমিশন সমঝোতা পরিষদকে মনে করিয়ে দিতে পারে যে যা–ই হোক না কেন শেষমেশ সংস্কার প্রস্তাবে সবার নিরঙ্কুশ সম্মতি বিঘ্নিত হওয়ার মতো কোনো কাজ করা থেকে পরিষদ যাতে বিরত থাকে।

জনমনে আশঙ্কা যে সংস্কার প্রশ্নে বড় দলগুলো তাদের অবস্থান নিয়ে অনড় থাকবে এবং সংস্কারপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমাজের ভেতর বৃহৎ ঐক্যের লক্ষ্যে সমঝোতা পরিষদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা নিলে অনেক রাজনৈতিক দল এবং অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা জনগণ এই প্রস্তাবের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন দেবে। সেই চাপে তখন বড় দলগুলো এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত না হওয়ার গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ সামনে নিয়ে আসতে পারবে না। একবার সব পক্ষকে টেবিলে বসাতে পারলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দক্ষতার সঙ্গে সমঝোতা প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। দেশ যে সংকটে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে উঠে এসে দেশ নতুন পথের দিশা পেতে শুরু করবে।

  • সৈয়দ হাসিব উদ্দিন হোসেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের একজন রাজনৈতিক কর্মী

hasibh@gmail.com